পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে তা নিয়ে আমাদের পরিবেশ। পরিবেশের মধ্যে যা কিছু থাকে তাদের বলা হয় পরিবেশের উপাদান। উপাদানের মধ্যে রয়েছে গাছপালা, ঘরবাড়ি, পশু-পাখি, রাস্তাঘাট, নদীনালা, পাহাড়-পর্বত এবং আরও অনেক কিছু। এসব উপাদান মানুষ ও অন্যান্য জীবের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। এগুলোর ক্ষতি হলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়। পরিবেশের সকল উপাদান আমাদের পরিবেশকে যেমন সুন্দর করে, আবার দূষিতও করতে পারে। প্রকৃতির অনুকূল পরিবেশে একদিন জীবন সম্ভব হয়েছিল এ পৃথিবীর বুকে। বনাঞ্চলের পরিমাণ বেশি এবং জনসংখ্যা কম থাকায় বায়ুমন্ডলে আমাদের তথা সমস্ত জীবকূলের বন্ধু অক্সিজেনের অভাব ছিল না। খাদ্য ও জলে ছিল সতেজ বিশুদ্ধতা। কিন্তু জীবনকে উন্নত করার উদ্দেশ্যে বিজ্ঞান যখন নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে শুরু করল, অমনি পরিবেশ আর আগের মতো রইল না। বিজ্ঞানের নিরঙ্কুশ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পৃথিবীতে ডেকে আনা হলো অতি যান্ত্রিকতা। ফলে প্রকৃতির সঙ্গে তার যে সাম্যাবস্থা দীর্ঘকাল ধরে বজায় ছিল, তা ধীরে ধীরে বিঘ্নিত হতে শুরু করল। দূষিত হতে শুরু করল পরিবেশ। আজ এই পরিবেশ দূষণে সমগ্র জীবজগতের অস্তিত্ব বিপন্ন হতে চলেছে। পরিবেশ দূষণ বর্তমান বিশ্বে একটি বড় সমস্যা। আমরা প্রতিনিয়ত বিভিন্নভাবে পরিবেশ দূষণ করছি। পরিবেশ আমাদের জীবন রক্ষাকারী বললে ভুল হবে না। বেঁচে থাকার জন্য যা কিছু প্রয়োজন তার সবকিছুই আমরা পরিবেশ থেকে গ্রহণ করে থাকি। প্রতি সেকেন্ডে আমরা যে অক্সিজেন গ্রহণ করি তা পরিবেশের উপাদান গাছ থেকে পাই। প্রতিনিয়ত আমরা যে খাদ্য গ্রহণ করি তা পরিবেশের দান। মানুষ নিজের জীবনের স্বস্তির জন্য বন কেটে বাড়ি, সড়ক নির্মাণ করছে, যা পরিবেশের জন্য হুমকি বয়ে আনছে। আমাদের জীবনযাত্রায় আজ একদিকে বিজ্ঞানের বিজয় গৌরব, অন্যদিকে দূষণের দুঃস্বপ্ন। বায়ু দূষণ, পানি দূষণ, শব্দ দূষণের মতো ক্ষতিকর প্রভাব এখন আমাদের নিত্য সঙ্গী।
পরিবেশ দূষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে বায়ু দূষণ। বায়ু নানাভাবে দূষিত হয়। যানবাহন, কলকারখানার কালো ধোঁয়া থেকে শুরু করে উন্নয়ন কাজের ধুলো-বালি বায়ু দূষণের অন্যতম কারণ।
যে বাতাসে আমরা শ্বাস গ্রহণ করি, সেই বাতাসই যদি দূষিত হয়ে পড়ে, স্বাভাবিকভাবেই তা আমাদের স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর হয়। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, মাথাধরা, শ্বাসরোগ, হাঁপানি, ফুসফুসের ক্যান্সার প্রভৃতি রোগের অন্যতম কারণ বায়ু দূষণের মত্রা বৃদ্ধি।
ভূমন্ডলের শতকরা ৭০ ভাগ পানি। সাগর, নদী, বিল, হ্রদ ইত্যাদির পানি বিভিন্ন প্রয়োজনে মানুষের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেই পানি যদি কোন কারণে দূষিত হয়ে পড়ে, তাহলে পৃথিবীতে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। নদীনালা, খালবিলের পানিতে কলকারখানার রাসায়নিক বর্জ্য এবং শহর ও গ্রামের পয়োবর্জ্য মিশে পানি দূষিত করছে। শস্যক্ষেতে ব্যবহৃত অতিরিক্ত কীটনাশক ও রাসায়নিক সার বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে গিয়ে পানিতে মিশে পানি দূষিত করে। দূষিত পানিতে মাছ এবং অন্যান্য জলজ প্রাণী বাস করতে পারে না। জলজ উদ্ভিদও জন্মায় না। দূষিত পানি ডায়রিয়া, জন্ডিস, পাঁচড়া, টাইফয়েড ইত্যাদি নানা রকমের রোগ ছড়ায়। শিল্প উৎপাদনে নিয়োজিত বিভিন্ন কারখানায় নানারকম রাসায়নিক ও বর্জ্য বস্তু নিয়মিতভাবে নদীগর্ভে নিক্ষিপ্ত হয়। শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গা নদীগর্ভে বিভিন্ন বর্জ্য পদার্থ নদীর পানিকে কতটা দূষিত করে, সঠিক বিচারে তা বলা কঠিন। তার উপর গৃহের উচ্ছিষ্ট এবং পৌর কর্পোরেশনের আবর্জনা সেই দূষণ ক্রিয়াকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। বায়ু ও পানি দূষণের সাথে সাথে শব্দ দূষণের কথাও উল্লেখ করার মতো। গ্রামে কম হলেও শহরে এ দূষণের মাত্রা সবচেয়ে বেশি। রাস্তায় বাস, ট্রাক, ট্যাক্সির হর্ন, কলকারখানার আওয়াজ, বোমাবাজি, মাইকের চিৎকার, মিছিলের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি এসবই স্বাভাবিক পরিবেশকে নষ্ট করে আমাদের শান্তিপূর্ণ জীবনকে বিঘ্নিত করছে। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে ৫০ ডেসিবেলের উপর শব্দের তীব্রতা সৃষ্টি হলে তা মানুষের জন্য ক্ষতিকর। বর্তমানে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন নগরীতে এর মাত্রা ৫০ ডেসিবেলের উপরে। এতে স্কুলগামী ছেলে-মেয়েরা পড়ালেখায় দিনে দিনে মনযোগ হারাচ্ছে। হৃদরোগ, মাথা ব্যথা, বধিরতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
নাগরিক হিসেবে এলাকার পরিবেশ সুন্দর রাখা আমাদের দায়িত্ব। সরকার পরিবেশ রক্ষায় বিভিন্ন ধরণের আইন প্রণয়ন করেছে। গ্রহণ করেছে বিভিন্ন ধরণের কর্মকান্ড। নাগরিক হিসেবে এসব আইন মেনে চলা আমাদের কর্তব্য। সমাজের অন্যরাও যেন সকল আইন মেনে চলে সে বিষয়ে আমাদের লক্ষ্য রাখা উচিত। এছাড়া সরকার বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি, রাস্তাঘাট পরিষ্কারের মতো যে সকল গুরুত্বপূর্ণ কাজ হাতে নেয় সেখানে আমাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে। সুস্থ ও সুন্দর জীবনযাপনের জন্য চাই সুন্দর ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বর্তমানে পরিবেশ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্দি করছে। পরিবেশ দূষণ রোধে বাংলাদেশের ভূমিকা একবারেই নগণ্য। আর পাশ্চাত্যেও শিল্পোন্নত দেশগুলো প্রায় ক্ষতিকর ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু পরিবেশ দূষণের ফলে বাংলাদেশ তার সমুদ্র তীরবর্তী নিচু অংশ হারাবে বলে বিজ্ঞানীরা বলেছেন। অন্যদেশ পরিবেশ দূষণ করবে আর আমাদের মতো সুন্দর পরিবেশ তৈরিতে সহায়তাকারী দেশ এর মারাত্মক ক্ষতিকর ফল ভোগ করবে, তা হতে পারে না। এক্ষেত্রে সরকারকে পশ্চিমা বিশ্বের কাছে নিজেদের দাবি পেশ করতে হবে। তারা যেন পরিবেশ দূষণের কাজ না করে সে বিষয়ে অবহিত করতে হবে। অতীতে বাংলাদেশের যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তার সমপরিমাণ ক্ষতিপূরণ দাবি করতে হবে।
যানবাহন থেকে নির্গত বিষাক্ত পদার্থযুক্ত কালো ধোঁয়া যাতে বন্ধ করা যায়, তার জন্য পুরোনো ইঞ্জিনচালিত গাড়ির চলাচল নিষিদ্ধ করা দরকার। কলকারখানা বা ইটের ভাটা শহর বা জনবসতির কাছাকাছি না হওয়া বাঞ্চনীয়। অপরিকল্পিতভাবে জমিতে সার ও কীটনাশক ব্যবহার থেকে কৃষকরা বিরত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া জরুরী। শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণও খুব কঠিন কাজ নয়। হর্ন ও মাইকের যথেচ্ছ ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বিশষ করে স্কুলের পাশে যেন হর্ন, মাইক বাজানো না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। রাস্তার পাশে যেন স্কুল, হাসপাতাল নির্মাণ করা না হয় সেদিকেও বিশেষ নজর দিতে হবে। সাস্থ্যসম্মত বসবাস করতে হলে দূষণমুক্ত পরিবেশ প্রয়োজন। পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখতে হলে আমাদের সবাইকে পরিবেশ দূষিত করে এমন কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকতে হবে। দূষণ প্রতিরোধের জন্য জনবসতি ও সভ্যতার সম্প্রসারণের প্রয়োজনে নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন বন্ধ করতে হবে। অরণ্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠা সম্ভব না হলেও, যেখানে সুযোগ আছে, সেখানেই গাছ লাগাতে হবে। কলকারখানার বর্জ্য যাতে পরিবেশ দূষিত না করে সে জন্য বর্জ্য পরিশোধনের ব্যবস্থা নিতে হবে। বায়ু দূষণ রোধের জন্য গাছপালার প্রতি যত্নশীল হতে হবে। বাড়ির আশেপাশে গাছপালা লাগাতে হবে। বনায়নের পরিকল্পনা নিয়ে প্রতিবছর বৃক্ষরোপণ কর্মকান্ডে অংশ নিতে হবে।
আগামী প্রজন্মের জন্য বসবাস উপযোগী পরিবেশ তৈরি করতে আমাদেরকে আরও সচেতন হতে হবে। পরিবেশ দূষিত হয়, এমন কাজ থেকে দূরে থাকতে হবে। এ কাজ করতে না পারলে পরিবেশ দূষণজনিত অপমৃত্যু কেউ ঠেকাতে পারবে না।
লেখক: ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলাম লেখক।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।