বাংলাদেশের জন্মকথা
মানুষ সামাজিক জীব। সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের একে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এই
বাংলাদেশ জাতির রাষ্ট্র (Bangladesh: State of the Nation) অর্ধশতাব্দী অতিক্রম করছে। চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে মধ্যম আয়ের উন্নয়নশীল দেশ উন্নীত হয়েছে। এই অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি সে মাত্রায় রাজনৈতিক উন্নয়ন ঘটেনি। বরং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিভাষায় ‘অনুন্নয়ন’ই ঘটেছে। সংবিধান গণতন্ত্রকে এই জাতির ‘জীবন পদ্ধতি’ হিসেবে নির্ধারণ করলেও রাজনীতিক এলিটরা গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকতা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। এক দলীয় শাসন ব্যবস্থা ও সামরিক শাসনের যাঁতাকল মুক্ত হওয়ার পর জাতি নতুন আশায় উদ্দীপ্ত হয়েছিল: এবার হয়তো রাষ্ট্রীয় জীবনাচারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু প্রধান রাজনৈতিক দল দুটোই জনগণকে হতাশ করেছে। অবশেষে নির্বাচন ব্যবস্থাও অকার্যকর হয়ে পড়েছে। জনগণের মৌলিক অধিকার ব্যাহত হয়েছে। সংসদীয় গণতন্ত্রের অনিবার্য অনুষঙ্গ বিরোধী দল কাঙ্খিত ভূমিকা পালন করতে পারেনি।
‘বাংলাদেশ জাতির রাষ্ট্র’ পৃথিবীর অন্যতম প্রধান সমগোত্রীয়তা বা সমমনোভাবাপন্ন (Homogeneous) জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও রাষ্ট্রীয় আর্দশিক ক্ষেত্রে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। শুরু থেকেই ভাবাদর্শের তীব্র সংঘাত অনুভূত হচ্ছে জাতীয় জীবনে। উন্নয়ন কৌশেলর ক্ষেত্রে অর্জিত হয়নি সমঝোতা। জাতির প্রতিষ্ঠাতা পুরুষদের সম্পর্কে নিরঙ্কুশ আনুগত্য সৃষ্টি হয়নি। রাজনৈতিক বিরোধ ‘বিবাদে’ পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিম্নস্তরে পৌঁছেছে। ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ ঘটেনি। রাজনৈতিক প্রথা ও প্রতিষ্ঠানগুলো অবক্ষয়িত হয়েছে। ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষিত হয়নি। শিক্ষা ব্যবস্থা বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে। দুর্নীতিতে সয়লাব হয়েছে দেশ। সুশাসন পরিত্যক্ত হয়েছে। জনগণের জীবনযাত্রা দুর্বিষহ রূপ পরিগ্রহ করেছে।
এ অবস্থার জন্য রাজনৈতিক এলিটরা একে অপরকে দায়ী করছেন। বস্তুত ব্যর্থতার দায়ভার কোন ব্যাক্তি, গোষ্ঠী বা দলের নয়। এই ব্যর্থতা গোটা জাতির। আর এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য জাতিকেই উদ্যোগী হতে হবে। বুদ্ধিজীবীদের এ ক্ষেত্রে বিশেষ নাগরিক ও বিদ্যায়তনিক দায় রয়েছে বলে বিশ্বাস করা হয়। রাজনৈতিক পথ ও পদ্ধতিতে পরিবর্তনের দায়িত্ব রয়েছে রাজনীতিকদের। বুদ্ধিবৃত্তিক পথ নির্দেশনার কর্তব্য বর্তায় বুদ্ধিজীবীদের ওপর। বিশেষত রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের বিশেষজ্ঞতার কারণে জাতীয় পর্যায়ে সংকট উত্তরণে জাতির প্রত্যাশা অবশ্যই যৌক্তিক।
১. ইসলাম (Islam): বাংলাদেশ জাতির প্রাণশক্তি হচ্ছে ইসলাম। ১২০৪ খ্রীস্টাব্দে দিল্লীতে কুতুবউদ্দিন আইবেক এবং বাংলায় ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজীর বিজয়ের মাধ্যমে পৃথিবীর এই অঞ্চলে যে নতুন জীবনাদর্শের বিকাশ ও প্রতিষ্ঠা ঘটে তা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে এই জাতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে অনিবার্য ভূমিকা রাখে। জাতীয়তাবাদ যদি হয় সেন্টিমেন্ট বা জনগণের স্বতস্ফুর্ত মনোভাবের বিকাশ, তাহলে অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ইতিহাসের দীর্ঘ পর্যায়ে এই জাতীয়তাবাদ অনেক বাঁক অতিক্রম করে। ১৯৪৭ সালে যে দ্বিজাতি তত্ত¡ উপমহাদেশকে বিভক্ত করে, তা এই বাংলাকেও বিভক্ত করে। ১৯৫২ সালে পাকিস্তানের শাসক এলিটদের মৌলিক ভুল সিদ্ধান্তের কারণে এখানে ভাষাভিত্তিক তথা আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটে। স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন অবশেষে স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। বাংলার জাতীয় নেতৃত্বের নিয়মাতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক পন্থায় স্বাধীনতা অর্জনের প্রয়াস সামরিকজান্তার নির্বুদ্ধিতা ও কূটিল রাজনৈতিক নেতৃত্বের ষড়যন্ত্রে রক্তাক্ত অধ্যায় সূচিত হয়। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ অর্জন করে তার স্বাধীনতা। জনগণের আদর্শ, বিশ্বাস, জীবনবোধ, রাজনীতি, অর্থনীতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ভৌগোলিক বাস্তবতা নিয়ে ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ এর নতুন দ্যোতনা পরিলক্ষিত হয়। এ সময় রাজনীতির বাহন হিসেবে ইসলাম ব্যবহারিত হলেও আত্নিক আদর্শ হিসেবে এটি উপেক্ষিত হয়। বৈশ্বিক প্রভাব ও প্রতিবেশীর প্রকৌশলে ইসলামকে একটি দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের বিষয়ে পরিণত করা হয়।
২. ধর্মনিরপেক্ষতা ((Secularism): আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার বিকাশের সাথে সাথে ধর্মনিরপেক্ষতার বিকাশ সাধিত হয়। ইউরোপকেন্দ্রীক খ্রিস্টধর্মে অযাচিত প্রভূত্ব ধর্মকেন্দ্রীক সংঘাতের সৃষ্টি করে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিকাশ এই বিভেদ ও দ্বন্দ্ব আরো বাড়িয়ে দেয়। একাদশ শতাব্দী থেকে ধর্মের প্রাধান্য লোপ পেয়ে শাসন কর্তৃত্বের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। অবশ্য একই সময়ে কথিত অন্ধকার যুগ ইসলামী বিশ্বে স্বর্ণউজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রথম মহাযুদ্ধে তুর্কী উসমানীয় সালতানাত এর পরাজয়ের পর প্রায় সমগ্র মুলিম বিশ্ব ইউরোপীয় ধর্ম নিরপেক্ষতা উপনিবেশবাদী শক্তির করতলগত হয়। সংগত কারণেই ধর্ম ও নিরপেক্ষতাবাদ ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতি শাসনব্যবস্থার নির্ধারক হয়ে দাঁড়ায়। এই উপমহাদেশে ১৯০ বছর বৃটিশ উপনিবেশিক শাসনের ফলে ইসলাম রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে পরিত্যক্ত হয়। সর্বত্র ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে উপনিবেশক শক্তি বিদায় নিলেও তাদের অনুসৃত ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদ শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর আদর্শ ও সংস্কৃতিতে পরিণত হয়। মেকলে নির্দেশিত শিক্ষা ব্যবস্থা যে প্রত্যাশিত বাদামী রঙ্গের ইংরেজ সৃষ্টি করতে চেয়েছিল তা সফল হয়। ইসলাম যেখানে পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান হিসেবে দাবি করে সেখানে ধর্ম ও রাজনীতি ভিন্ন ভিন্ন হিসেবে সমাজে বিভেদের বাহন হিসেবে আজও বর্তমান রয়েছে।
৩.
৩. জাতি পরিচিতির সঙ্কট: বাঙালি বনাম বাংলাদেশী (Identity Crisis: Bangali vs Bangladeshi) : পৃথিবীর জাতি রাষ্ট্রসমূহ সৃষ্টির একক উপাদান হিসেবে কাজ করেছে, এটা বললে অসত্য বলা হবে। জাতীয় ঐক্য যেসব কারনে সৃষ্টি হয় তারমধ্যে ভাষা একটি। বৃটিশ উপনিবেশিক যুগে ধর্ম জাতীয়তার প্রধান বাহন হিসেবে স্বীকৃত হয়। পরবর্তীকালে আঞ্চলিকতা ও ভাষার প্রশ্নে নানা ধরনের আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। ভাষা ভিত্তিক জাতীয়তাবাদের প্রবক্তারা ভাষাকেই একমাত্র উপাদান হিসেবে রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। অপরদিকে ধর্মকে মূল নিয়ামক মনে করে বিপরীত শক্তি। বাংলাদেশে এ ধরনের ভাবাদর্শের সংঘাত দৃশ্যত বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মীমাংসিত হলেও ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদীরা উগ্র ও চরম পথ বেছে নেয়।
৪. স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ (Debate on the Spirit of Liberation): ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে জাতীয়তাবাদের এই সংঘাত আবারো দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। যারা ধর্মভিত্তিক জাতীয়বাদে বিশ্বাস করেন তারা ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের আতঙ্কে অস্থির ছিলেন। অপরদিকে পাকিস্তানের শাসকরা ইসলামের নামে গণহত্যা শুরু করে। ফলে ভাবাদর্শকেন্দ্রীক স্বাধীনতার পক্ষ বিপক্ষের বিষয়টি রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো গণহত্যা নিরোধে ব্যর্থ হয়। বরং তারা সামরিক জান্তার সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে এই দুই’য়ের বিভেদ রাজনৈতিক পালাবাদলের গুরুত্বর্পূ হয়ে ওঠে। শাসক দলগুলো নানাভাবে এই বিভাজনকে ব্যবহার করে। ধর্ম নিরপেক্ষবাদী শক্তি, স্বাধীনতা বিরোধীদের মোকাবেলা করতে গিয়ে কোনকোন ক্ষেত্রে খোদ ইসলামের বিরোধী হয়ে দাঁড়ায়। এটি সমাজে সংঘাত ও বিভেদ তৈরি করে।
৫. জাতির প্রতিষ্ঠাতা পুরুষ বিতর্ক (Debate on the Founding Fathers) : প্রতিটি জাতির প্রতিষ্ঠালগ্নে দেখা যায় ব্যক্তি বা ব্যক্তিবগ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তারা সেই সব দেশে অসাধারন সম্মান ও মর্যাদায় ভূষিত হন। বাংলাদেশের দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা বৃটিশযুগে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তারা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকালে গুরুত্বহীন হয়ে পড়েন। আবার স্বায়ত্তশাসন ও ভাষাভিত্তিক আন্দোলনে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃত্বের গুরুত্বপূণ ভূমিকা থাকলেও স্বাধীনতায় নেতৃত্বদানকারীরা তাদের অবমূল্যায়ন করে। ফলে জাতির প্রতিষ্ঠাতা পুরুষদের নিয়ে বাংলাদেশে এখনও বিতর্ক বর্তমান রয়েছে।
৬. উন্নয়ন কৌশল বিতর্ক (Development Strategy) : যেকোন জাতির উন্নয়ন কৌশল নির্ধারিত হয় সেই জাতির নেতৃত্ব, আদর্শ ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষিত দ্বারা। বাংলাদেশে পাকিস্তানের শাসক এলিটরা পুঁজিবাদী অর্থনীতি অনুরসরণ করেছিলেন। অপরদিকে বাংলাদশের অভ্যুদ্বয়ের পরে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রয়াস নেয়া হয়। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য যে কাঠামোগত ও নেতৃত্বগত আদর্শিক পরিবর্তন প্রয়োজন, প্রাথমিক শাসক এলিটরা তা করতে ব্যর্থ হন। পরবর্তীকালে শাসন কর্তৃত্বের বদল হয়। তারা পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে ফিরে যান। বাংলাদেশের বিগত ৫০ বছরে একটি সুনির্দিষ্ট ও আদর্শভিত্তিক উন্নয়ন কৌশল প্রণীত হয়নি। ফলে এক এক শাসক গোষ্ঠী দেশের উন্নয়ন ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে। এখনো সরকার ও বিরোধী দল সমন্বয়ে একটি জাতীয় উন্নয়ন কৌশল সৃষ্টি হয়নি। ফলে জাতীয় উন্নয়নে ধারাবাহিকতা ব্যাহত হচ্ছে।
৭. নারী উন্নয়ন (Women Development): ইসলাম সকল নর ও নারীর জন্য জ্ঞান অর্জন ফরজ করেছে। এই উপমহাদেশে সামাজিক কুসংস্কার নারী শিক্ষাকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। আর এজন্য তথাকথিত প্রগতিশীলরা দায়ী করেছে ধর্মকে। ধর্ম সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকার কারণে কোন কোন ক্ষেত্রে ইসলাম সম্পর্কে অল্প জ্ঞানের অধিকারীরা সামাজিক কুসংস্কারের সাথে হাত মিলিয়েছে। প্রগতিশীলরা নারী শিক্ষাকে ধর্মের বিপরীতে স্থান দিয়েছে। এভাবে নারী শিক্ষা, নারী পেশা ও নারী উন্নয়ন নিয়ে বাংলাদেশ সমাজে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। যদিও ইসলামের যথার্থ ব্যাখ্যার কারণে এ সমস্যা অনেকটাই দূরীভূত হয়েছে। তবুও মতলববাজরা এ নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।
৮. জাতিগঠন বনাম মানব গঠন ((Nation Building VS Human Building): : রাষ্ট্রীয় সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে দেশের নাগরিক সাধারণকে সেই জাতির আশা-আকাক্সক্ষা ও জীবনবোধ অনুযায়ী তৈরি করা। এক্ষেত্রে ধর্ম, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও লোকাচার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় একজন নৈতিক মান সম্পন্ন নাগরিক তৈরির চেয়ে বস্তুগত বিষয়ে প্রাধান্য দেয়া হয়। বাংলাদেশের অপরাধের প্রাবাল্য লক্ষ করলে বোঝা যায় যে, আমরা নাগরিক সৃষ্টি করলেও মানুষ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছি। মানবিক গুণাবলী অর্জন করতে হলে গোটা জাতির শিক্ষা ব্যবস্থায়, গণমাধ্যমে ও রাষ্ট্রীয় প্রচার ক্ষেত্রে নৈতিকতাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। অথচ তথাকথিত বৈজ্ঞানিক ও গণমুখী শিক্ষার আদলে ভোগবাদী ও বস্তুবাদী শিক্ষার বিস্তার ঘটছে। নৈতিক শিক্ষা বনাম বৈজ্ঞানিক শিক্ষা অর্থহীনভাবে জাতীয় পর্যায়ে বিতর্ক সৃষ্টি করছে।
বঙ্গবন্ধু আমল: আরোপিত ধর্মনিরপেক্ষতা (১৯৭১-৭৫) : শাসক আওয়ামী লীগ মূলত ছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ। (প্রবীণ সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী এ নামে আওয়ামী লীগের প্রত্যাবর্তন লক্ষ করেছেন।) পাকিস্তান অর্জনকারী দল মুসলিম লীগের খাঁজা-গজারা যখন সাধারণ মানুষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তখন মুসলিমলীগের সাধারণ অংশ সাধারণ/ আওয়ামী স্বার্থ রক্ষায় উদ্দোগী হয়। তখনকার সাধারণ মানুষের নেতা মাওলানা ভাসানীর উদ্দ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় আওয়ামী মুসলিম লীগ। কমিউনিষ্ট পার্টি এবং এর ভাবধারা পুষ্ট লোকেরা কীভাবে উদ্দেশ্যমূলকভাবে মুসলিম শব্দটি বিতাড়ন করে ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদের তকমা ধারণ করে তা আজ প্রমাণ্য ইতিহাস। তারা তাদের স্মৃতিকথায়, রচিত ইতিহাসে গর্বের সাথে উল্লেখ করছেন এসব আলেখ্য। অবশ্য এটাও সত্য যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময় ছিল মার্ক্সবাদ তথা সোভিয়েত সমাজতন্ত্র প্রভাবিত বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্ব। পুজিঁবাদের শোষণ যাঁতাকলে নিষ্পেশিত বিশ্ব মুক্তির আশায় পঙ্গপালের মতো ধাবিত হয়েছিল সে আদর্শিক পরিমন্ডলে। আলো ভেবে আগুনে ঝাঁপ দিয়েছিল তারা। ১৯১৯ সালে পুঁজিবাদের হাতে তুর্কী ওসমানীয় সালতানাতের চরম পরাজয়ের পর আদর্শের হিসাবে ইসলামের অস্তিত্ব¡ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। কারন রাজনৈতিক শক্তির সাথে আদর্শিক শক্তির উত্থান পতন অনিবার্য। যদিও জামালউদ্দীন আফগানী বা আল্লামা ইকবাল সহ প্রতিবাদী দর্শন ও দার্শনিকের উপস্থিতি ছিল গোটা মুসলিম বিশ্বজুড়ে। যা হোক, প্রগতিশীল আদর্শ হিসেবে দেশ বিভাগের পর ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে মার্ক্সবাদ বা বামধারর বুদ্ধিবৃত্তিক প্রাধান্য ছিল নিরঙ্কুশ। বঙ্গবন্ধু নিজে মার্ক্সবাদী না হলেও বামধারার প্রতি ছিলেন শ্রদ্ধাশীল। তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী এবং বিভিন্ন স্মৃতি কথায় এটি স্পষ্ট হয়েছে। তবে তিনি কমিওনিষ্টদের মতো ধর্মবিদ্বেষী বা বিরোধী ছিলেন না। তার ইসালামে বিশ্বাস ছিল গতানুগতিক, সাধারণ ও স্বাভাবিক। বৃটিশ উপনিবিশিক ধারায় যেভাবে রূপায়িত হয়েছিল ইসলাম তিনি ছিলেন তারই প্রকৃষ্ট সন্তান। ইসলাম ও মুসলিম আইডেনটিটি বা পরিচয়ের প্রতি তার ছিল প্রচ্ছন্ন সমর্থন। ১০ জানুয়ারী ১৯৭১ তিনি যখন ফিরে এলেন বিজয়ীর বেশে তখন রেসকোর্সে বাংলাদেশকে অভিহিত করেছিলেন দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে। পরবর্তীকালে খোন্দকার নাসির উদ্দীন আয়োজিত মাদরাসা শিক্ষক সমিতি সম্মেলনে তার উপস্থিতি, ইসলামী ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা ও সর্বোপরি ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান তার ইসলামী আইডেনটিটির প্রমাণ। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ এ বিজয় দিবসের পর রেডিও টেলিভিশনে কোরআন তেলাওয়াত বন্ধ হয়ে যায়। ১০ জানুয়ারি ফিরে আসার পর টিভির মহাপরিচালককে ডেকে তিনি বলেছিলেন, মুসলমানের ঘরে ঘরে ভোরে ভোরে কি শ্রীকীর্ত্তন হয় নাকি কুরআন তেলাওয়াত হয়- এমন কথা। একটি স্মৃতি কথায় এর উল্লেখ রয়েছে। অতঃপর যথারীতি রেডিও-টেলিভিশনে কুরআন তেলাওয়াত শুরু হয়। পরবর্তীকালে সংবিধান, সমাজ ও রাজনীতিতে যেভাবে ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদ প্রতিষ্ঠা করা হয় তাতে ছিল তার সতর্ক সম্মতি। উপনিবিশিক ধারায় ইউরোপীয় শিক্ষা যেভাবে ধর্মকে একান্তই ব্যক্তিগত বিষয় বলে পরিগণিত করা হয় সেভাবেই তার বিশ্বাস গড়ে ওঠে। তবে তিনি বারবার জনগণকে এই বলে আশ্বস্ত করতেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়’।
জিয়াউর রহমান আমল (১৯৭৫-৮১) : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসন কালে প্রতিভাত ভাবদর্শের বিপরীত হচ্ছে শহীদ জিয়াউর রহমান অনুসৃত আদর্শ। সেনা নায়কেরা সাধারণত বিশেষ কোন আদর্শের প্রতিভূ হন না। সে ক্ষেত্রে সেনা নেতৃত্ব হয়ে ওঠে সেনা স্বার্থের ধারক। আর সে স্বার্থকে প্রতিষ্ঠিত করতে বেছে নেন পরিপূরক আদর্শ। ১৯৭৫ সালের মধ্য আগষ্টের মর্মান্তিক ঘটনাবলী অভ্যান্তরীণ ও বৈদেশিক উভয় ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের দিক পরিবতর্ন সূচক। বাংলাদেশ ‘দিল্লী-মস্কো-ঢাকা’ এর পক্ষপুট থেকে বেরিয়ে আসে। ওয়াশিংটন হয়ে দাঁড়ায় পরিবর্তনের পরিপূরক। সেভাবেই অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে সোভিয়েত ধারার বাকশালের পরিবর্তে বহুদলীয় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন করেন জিয়াউর রহমান। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তথাকথিক অধনতান্ত্রিক অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে আসে বাংলাদেশ। পাশ্চাত্য তথা মার্কিন মদদপুষ্ট পুঁিজবাদী অর্থনৈতিক উন্নয়ন কৌশল গৃহীত হয়। শীর্ষ দুই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. এমাজদ্দীন আহমেদ এবং ড. সিরাজুল ইসলামের উন্নয়ন কৌশল (Development Strategy) বিষয়ক গবেষণায় জাতিরাষ্ট্রের দিক পরিবর্তনের পরিপূর্ণ বিশ্লেষণ রয়েছে। জিয়াউর রহমানের কাছে রাজনৈতিক দল হচ্ছে পরিকল্পিত বেসামরিকীরণ (Civilianization) এবং আদর্শের বাহন। গবেষণায় দেখা যায়, রাজনীতিতে প্রবেশের প্রাক্কালে জিয়া প্রচুর হোমওয়ার্ক করেন দেশের শীর্ষ ব্যক্তিত্ব- ডান অথবা বাম সকলের সাথে কথা বলেন। সেনাবাহিনীর প্রযন্তে রীতিমতো গবেষণা সম্পন্ন হয়। অবশেষে তিনি বাংলাদেশের মানুষ অনুসৃত মধ্যম পন্থা বেছে নেন। তিনি জনগণের নাড়ীর টান বুঝতে পারেন। তাদের আশা-আকাঙ্খার প্রতিধ্বনি করে: ক. সংবিধানে বিসমিল্লাহ সংযোজন করেন। খ. ধর্মনিরপেক্ষতা বর্জিত হয়। গ. আল্লাহর প্রতি গভীর আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপিত হয়। ঘ. সামাজতন্ত্রের সংঙ্গা পুনঃনির্ধারিত হয়। ঙ. মুসলিম বিশ্বের সাথে বিশেষ সম্পর্ক সাংবিধানিক অঙ্গীকারে পরিণত হয়। ১৯৭৬ সালে গৃহীত গণভোটে এসব পরিবর্তন অনুমোদিত হয়। সে সময়ে জিয়া ডান ও বাম সব ধারার অকুণ্ঠ সমর্থন লাভ করেন। ইতিপূর্বে অনুসৃত বিভেদ- বিভাজনের রাজনীতি পরিবর্তে সূচিত হয় জাতীয় ঐক্যের আবেদন। জিয়াউর রহমান সর্ততার সাথে চরম বাম ও চরম ডান এর মাঝামাঝি অবস্থান করেন। ইসলামী মূল্যবোধ এর সংযমী ভাবধারা গ্রহণ করে তিনি সকলকে আত্মস্থ করেন।
এরশাদ শাসন আমল (১৯৮১-৯০) : জিয়াউর রহমানের দলকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করলেও প্রেসিডেন্ট এরশাদ মোটামোটিভাবে জিয়াউর রহমানের ভাবাদর্শকেই গ্রহণ করেন। তিনি সংবিধানে জিয়া সংযোজিত পরিবর্তনসমূহ রক্ষা করেন। ইসলামী রাজনীতি যখন পাশ্চাত্যের গবেষণা অনুযায়ী বাংলাদেশে ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করার সক্ষমতা অর্জন করে তখন এই উত্থানকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করার জন্য সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম সংযোজন করেন। কতিপয় আরব রাষ্ট্রের অনুসরণে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করায় তিন ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। প্রথম, গতানুগতিক ইসলামী ভাবধারার অনুসারীরা এতে সমর্থন জানায়। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক ইসলামে বিশ্বাসীরা এটিকে আরোপিত এবং উদ্দেশ্যমূলক মনে করে। তৃতীয়ত, গোটা বামপন্থী গোষ্ঠী তীব্র প্রতিবাদ জানায়। এরশাদের আমলে জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের ব্যানারে বড় বড় সমাবেশে তার প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করা হয়। এ সময়ে মাদরাসা শিক্ষকদের বেতন ভাতায় বড় ধরনের উন্নয়ন ঘটে। মসজিদের বিদ্যুৎ বিল মাফ করা হয়। রাজনৈতিক ইসলামের প্রতি কঠোরতা প্রদর্শন করলেও এরশাদ প্রাতিষ্ঠানিক ইসলাম এবং ইসলামী ভাবধারর প্রতি ব্যাপক আনুকূল্য প্রদান করেন। একই সাথে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা, স্বীকৃতি ও সম্মান প্রদান করেন। বিটিভিতে খবরের আগে স্মৃতিসৌধ প্রদর্শন ও মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক গানের সূচনা করেন। এতো কিছু করেও তিনি তথাকথিত স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তির সমর্থন লাভে ব্যর্থ হন। কারণ তিনি ব্যক্তিগতভাবে ইসলামের প্রতি বিশ্বস্ত ছিলেন। তিনিও জিয়াউর রহমানের মতো বিভেদের পরিবর্তে জাতীয় সমজোতার রাজনীতি অনুসরণ করেন। তার সময়ে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষের তীব্রতা অনুভূত হয়নি। জাতির প্রতিষ্ঠাতা পুরুষদের বিতর্ক এক রকম উহ্য ছিল। তবে তিনি জিয়াউর রহমানের চেয়েও আরও শক্ত পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে প্রতিষ্ঠানিকতাদান করেন। জিয়ার আমলে মিশ্র অর্থনীতি ও রাষ্ট্রীকরণের অবশেষ পরিলক্ষিত হলেও এরশাদের আমলে সর্বাত্মক পুঁজিবাদী অর্থনীতি অনুসরণ করা হয়।
বিএনপি আমল (১৯৯১-৯৬, ২০০১-০৬) : এরশাদের পদত্যাগের মধ্যদিয়ে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার সূচনা ঘটে। ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদী গোষ্ঠী ক্ষমতায় আসার ব্যপারে অনেকটাই নিঃসংশয় ছিল। রাজনৈতিক ভবিষ্যদ্বক্তাদের বিস্মিত করে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। পরে জামায়াতের সমর্থনে সরকার গঠন করে। ক্ষমতাসীন হওয়ার পর বিএনপি জিয়াউর রহমানের ভাবধারায় ইসলামী আদর্শ ও মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখে। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিএনপি পরাজিত হয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ এপরাজয়ের কারণ হিসেবে জোটের অভ্যান্তরীণ দ্ব›দ্ব-বিদ্বেষকে দায়ী করেন। ২০০১ সালে তাদের ক্ষমতায় পুনঃপ্রত্যাবর্তনও একই ধারায় ব্যাখ্যা করা হয়। ২০০৭ সালের তথাকথিত ১/১১ সরকারের আগ পর্যন্ত ইসলামী ভাবধারর লালন-পালন ও প্রতিষ্ঠাকীকরণ অব্যাহত থাকে। জিয়া, এরশাদ ও বেগম খালেদা জিয়ার ধারাবাহিকতায় ইসলামী মূল্যবোধের ব্যতিক্রম ঘটেনি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হলে ২১ বছর পর ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী শক্তির পুনঃপ্রতিষ্ঠা ঘটে। শাসন ব্যবস্থায় ক্রমশ তাদের সুর ও ব্যাঞ্জনা অনুভূত হয়।
আওয়ামীলীগ আমল (১৯৯৬-২০০১, ২০০৯-২০২১) : ১৯৯৬- ২০০১ শাসন আমলে আওয়ামী লীগ সতর্কতার সাথে রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনা করে। নির্বাচনে তার জয়ের জন্য ইসলামী ভাবাদর্শের ব্যবহার করে। আগেই বলা হয়েছে, ইসলামী রাজনীতির বিভাজন তাদের ক্ষমতায় আসার পথ করে দেয়। তারা ছলে-বলে-কলে-কৌশলে ইসলামী শক্তিকে মিত্রতার অভিনয়ে মুগ্ধ করে। ওই সময়ে যদি তার ক্ষামতাসীন না হতো, তা হলে ভবিষ্যতে তাদের ক্ষমতায় আসার পথ সুদূর পরাহতই থাকত।
সামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার (২০০৭-২০০৯): ক. ৯/১১ এর ঘটাবলী, খ. আফগানিস্তান আক্রমণ, গ. জেনারেল পারভেজ মোশারফের ইসলামী শক্তিবিরোধী অবস্থান, ঘ. ইসলামী শক্তি নিধনে ভারতের সক্রিয় অবস্থান, ঙ. আন্তর্জাতিক বৈরী আবহাওয়া ও চ. মার্কির যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক দক্ষিন এশিয়ার ভৌগোলিক কর্তৃত্বে ভারতের একচ্ছত্র আধিপত্য স্বীকার বাংলাদেশে বৈরী পরিবেশ তৈরি করে। এসব অনুকূল অবস্থানকে কুশলতার সাথে কাজে লাগায় আওয়ামী লীগ এবং তার বৈদেশিক মিত্ররা। যেহেতু সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ কার্যত বিএনপির প্রতি বৈরিতা সৃষ্টি করে, শেষ ফলাফল চিন্তা করে ১/১১ এর নায়কেরা আওয়ামী লীগের আশ্রয় গ্রহণ নিরাপদ মনে করে। আওয়ামী লীগও তাদের অভয় দিয়ে ক্ষমতার যাওয়ার পথ প্রশস্থ করে।
ভাবাদর্শের তীব্র সংঘাত সময়: ২০১৩ সাল সম্ভবত ভাবাদর্শের সংঘাত নির্ণয়ে চরম সময়কাল। ১. এ সময় নাস্তিক বøগারদের তৎপরতা সকল সীমা অতিক্রম করে। ২. ইসলামী শক্তির উপর নিপীড়ন নির্যাতন চরম আকার ধারণ করে। দেশে সর্বত্র রক্তপাত ঘটে। ৩. শিক্ষা ক্ষেত্রে সচেতনভাবে ইসলাম ও মুসলমানদের পরিচয় মুছে দেয়া হয়। ৪. উচ্চ-আদালতে ফতোয়া নিষিদ্ধ করা হয়। গ্রাম-গঞ্জে, আলেম-ওলামারা বেইজ্জত হতে থাকে। ৫. এমনকি যত্রতত্র দাড়ি ও টুপিধারী মানুষেরা হেস্ত-নেস্ত হয়। ৬. ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদের সমর্থনে শাহাবাগে ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ স্থাপিত হয়। এসবের সামগ্রিক প্রতিবাদ হিসেবে শতস্ফূর্তভাবে গতানুগতিক আলেম-ওলামাদের সমন্বয়ে অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হেফাযতে ইসলামের উত্থান ঘটে।
বর্তমান প্রেক্ষিত: আওয়ামী লীগ সরকারের একযুগ পূর্তি হতে চলেছে। বিগত ১২ বছরের হিসাব নিলে দেখা যাবে তারা ক্রমশই কঠোর থেকে কঠোরতর হয়েছে। ভাবাদর্শের সংঘাত বেড়েই চলেছে। যাচিত বা অযাচিতভাবে ইসলামী ভাবাদর্শের প্রতি বিরূপ আচরণ লক্ষ করা গেছে। যে হেফাযতের প্রতি তারা নির্দয় নির্মম আচরণ করেছে পরে তাদেরকেই আনুকূল্য দিয়েছে। এখন যখন তাদেরকে ক্ষমতার প্রতি চ্যালেঞ্জ মনে হয়েছে, তাদের চোখ উল্টোতে দেরী হয়নি। নরেন্দ্র মোদীর আগমনের সময় থেকে শতশত আলেমকে গ্রেফতার করা হয়েছে। রমজান বা ঈদ নিগ্রহের বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি।
এ নিবন্ধের শুরুতেই বলা হয়েছে, বাংলাদেশ একটি সমগোত্রীয় বা সমমনোভাবাপন্ন জাতীয় রাষ্ট্র। এখানে ভাষা, ধর্ম বা গোষ্ঠীগত বিরোধ নেই। এটি একটি সমতল ভূমির দেশ। একই জীবন-জীবিকা, খাদ্যাভাস ও স্বভাব চরিত্রে একই রকম। পারিবারিক বন্ধন, সামাজিকতা ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারেও নেই কোন বিভেদ। ‘আমগাছ, জামগাছ, বাঁশঝাড় যেন মিলেমিশে আছে ওরা আত্মীয় হেন’। বিবিধ ধর্মের বিভিন্ন মানুষ বাস করছে একই সাথে। সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষ ইসলাম ধর্মের একান্ত অনুসারী । তারা ধার্মিক। তবে ধর্মান্ধ নয়। সমাজের গহীন গভীরে সাম্প্রদায়িকতা অস্তিত্ব নেই। প্রতিবেশীর তুলনায় হিংসা বিদ্বেষ ও দাঙ্গা-হাঙ্গামার ইতিহাস এক রকম শূন্য। উদ্দ্যেশ্যমূলকভাবে উস্কেদেয়া ব্যতীত সামাজিক সম্প্রীতি ষোল আনাই বিদ্যমান। এর মাঝে এই ভাবাদর্শের বিভেদ সংঘাত নিতান্তই কৃত্রিম ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
এই কৃত্রিম, আরোপিত ও উদ্দেশ্যমূলক বিরোধসংঘাত নিরসনে রাজনৈতিক নেতৃত্বকেই এগিয়ে আসতে হবে। জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা ও অনিষ্টতা উপলদ্ধি করতে হবে। মনে রাখতে হবে। জাতীয় ঐক্যই পারে জাতীয় বিকাশ ও প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক : প্রফেসর, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সাভার, ঢাকা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।