পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
মুসলিমদের শত্রুরা ঐক্যবদ্ধ। তারা ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে সুযোগ পেলেই ঝাপিয়ে পড়ে। শুরু থেকেই এ ধরনের ঘটনা ঘটে এসেছে। বিশ্বব্যাপী মহামারিরূপে বিস্তৃত করোনাভাইরাসের সাথে কোন পর্যায়েই মুসলিমদের নাম আসেনি। তবে উপমহাদেশে করোনার বিস্তারের সাথে মুসলিমদের নাম জড়িয়ে যায়। আর একে পুঁজি করে মুসলিমবিরোধী কত যে অপপ্রচার চালানো হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।
গত বছর ভারতের রাজধানী দিল্লিতে তাবলীগ জামাতের কেন্দ্রীয় মারকাযে এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যাতে যোগ দেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আগত মুসলিমরা। সম্মেলন শেষে কিছু মুসল্লির মাঝে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দেয়ায় ভারতীয় প্রোপাগান্ডাকারী মিডিয়া তাবলীগ জামাতের সাথে সংশ্লিষ্ট মুসলিমদের ‘করোনা বোমা’ আখ্যায়িত করে। নানা ধরনের প্রতিবেদন তৈরি করে ভারতে করোনা বিস্তারের জন্য মুসলিমদের দায়ী করা হয়। একই সময়ে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বহু সমাবেশ অনুষ্ঠিত হলেও সেগুলোকে উপেক্ষা করে গেছে ভারতীয় মিডিয়া। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে দিল্লি মারকাযের সম্মেলনে যোগদানকারীদের বিরুদ্ধে মামলা হয় এবং দীর্ঘদিন কারাগারে থাকার পর আদালত তাদের নির্দোষ ঘোষণা ও ভারত ত্যাগের অনুমতি দেয়।
ভারতে এখন চলছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এবং একই সাথে ব্ল্যাক, ইয়েলো ফাঙ্গাসের মহামারি। গত মাসেই ভারতে কুম্ভ মেলায় কয়েক কোটি হিন্দুর সমাবেশ ঘটে এবং তারা গঙ্গা স্নানে অংশ নেয়। বিভিন্ন মিডিয়াতে এ সমাবেশের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা হলেও তা গ্রাহ্য করেনি ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার। এর ফলে তাদের ভোগ করতে হচ্ছে করুণ পরিণতি। প্রতিদিন মারা যাচ্ছে ৩-৪ হাজার করে মানুষ। এটি সরকারি হিসাব। কিন্তু বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা অনেক বেশি।
করোনা মহামারি মানব জাতিকে এক করুণ বাস্তবতার মুখোমুখী দাঁড় করিয়েছে। দ্বিতীয় বছরে পরিস্থিতি সামান্য বদলালেও অনেক এলাকায় সেই প্রথম বছরের ন্যায়ই রয়ে গেছে। আর তা হল রোগীর সাথে অমানবিক আচরণ। কুরআন মাজিদে কিয়ামত দিবসের পরিস্থিতি বর্ণনা করে বলা হয়েছে, ‘যেদিন মানুষ পলায়ন করবে তার ভাই থেকে, তার মাতা তার পিতা থেকে, তার স্ত্রী ও তার সন্তান-সন্ততি থেকে- সেদিন তাদের প্রত্যেকের এক (গুরুতর) অবস্থা হবে, যা তাকে (সবকিছু থেকে) বে-খেয়াল করে দেবে (সূরা আবাসা : ৩৪-৩৭)। কেয়ামতের আগেই এর বাস্তব চিত্র আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে করোনাভাইরাস। অনেক বিলিয়নিয়ার এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর পরিবারের সদস্যদের স্নেহমাখা কোমল পরশটুকুও পায়নি। এমনকি চিরতরে চোখ বন্ধ করার আগে দূর থেকে স্বজনের মুখটি শেষ বারের মতো দেখারও সুযোগ মেলেনি। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে স্বজনরাও যায়নি মৃত্যু পথযাত্রীকে হাসপাতালে দেখতে। এহেন পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাপী মুসলিমরা তাদের মানবিকতা প্রদর্শন করে চলেছে। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় গুরুত্ব পাওয়া খবরে প্রকাশ, যখন আত্মীয়-পরিজন ভাইরাসের ভয়ে লাশ ফেলে পালিয়ে যাচ্ছে কিংবা শত শত লাশ সামাল দেয়ার মতো উপযুক্ত জনবল পাওয়া যাচ্ছে না, তখন ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের পরিস্থিতিতে তাবলীগ জামাত ‘সৌহার্দ্যপূর্ণ মানবিকতার’ উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। করোনায় জর্জরিত ভারতে এমন উদাহরণ দেশটির উগ্র সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষতা ও পরমতসহিষ্ণুতার আদর্শকে উচ্চকিত করেছে।
অথচ, গত বছর করোনা পরিস্থিতির শুরুতে তাবলীগ জামাত ইসলাম প্রচারের নিয়মিত সংঘবদ্ধ কাজের জন্য সরকারি-বেসরকারি বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছিল। এমনকি, উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ‘অপরাধী’ বা ‘করোনা বোমা’ তকমা সেঁটে দেয়া হয়েছিল তাবলীগের গায়ে। দেশদ্রোহ এবং খুনের মামলা পর্যন্ত দায়ের হয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে। অথচ, সেই অপরাধ ও নির্যাতন পেছনে রেখে করোনায় মৃতদের সৎকারে ঝাঁপিয়ে পড়ে সুন্নী ইসলামি সংগঠন তাবলীগ জামাত। এক চিতায় ১০ জনের লাশ তোলার পরিবর্তে ধর্মীয় আচার মেনে যাতে প্রত্যেক কোভিড রোগীর সৎকার করা যায়, সেই কাজে ধর্মীয় রীতি ও মৃতদেহের সম্মান বজায় রেখে হাত লাগান মুুুুসলিমগণ। গত এপ্রিল মাসে সেখানে দৈনিক প্রায় ১৫টি করে লাশ দাহ করেছেন তাদের স্বেচ্ছাসেবকরা। আর মহামারির একেবারে সূচনা পর্ব থেকে সবমিলিয়ে ৫৬৩টি লাশ দাহ করে তাবলীগ জামাত। শুধু এই কাজের জন্যই তিরুপতি ইউনাইটেড মুসলিম অ্যাসোসিয়েশনের অধীনে কোভিড-১৯ জয়েন্ট অ্যাকশন কমিটি (জেএসি) গঠন করে তারা।
পশ্চিমে গুজরাটে ভাদোধরা শহরে একটি মাদরাসায় কোভিড রোগীদের জন্য বেড, ভেন্টিলেটর ও অক্সিজেনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে রোগীরা আইসোলেশনেও থাকতে পারেন। সেখানকার প্রিন্সিপাল মুফতি আরিফ আব্বাস বলেন, পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হচ্ছে। আমরা কোভিড রোগীদের জন্য মাদরাসা উন্মুক্ত করেছি। আমরা মানুষের সেবা করতে চাই। তিনি বলেন, মাদরাসায় করোনা রোগীদের সেবা দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া ভাদোধরার মসজিদের একটি অংশেও কোভিড রোগীদের জন্য চিকিৎসাসেবার পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। শুধু গুজরাট নয়, দিল্লিতেও একটি মসজিদকে কোয়ারেন্টিন সেন্টার বানানো হয়েছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের বরাতে জানা যায়, দিল্লির ওই মসজিদটির নাম গ্রিন পার্ক মসজিদ। সেখানে বিশেষভাবে কোয়ারেন্টিন সেন্টার বানানো হয়েছে, যাতে রয়েছে মেডিকেল সাপোর্টসহ ১০টি বেড। এছাড়া রোগীদের মাস্ক, স্যানিটাইজার ও ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে। এছাড়া সেখানকার মুসলমানরা করোনা রোগীদের জন্য হেল্পলাইন (মোবাইল কল), ওষুধ, ত্রাণ ও সুরক্ষাসামগ্রী নিয়েও কাজ করছে। মহারাষ্ট্রে মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে ৮০০টি কোভিড মৃতদেহ দাহ করেছে আব্দুল জাব্বার, শেখ, আলীম ও আরিফ নামের চারজন মুসলিম যুবক। রাজ্যের যবতমাল জেলায় কোভিডে মৃত লাশের শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছে এদের হাতেই। পরনে পিপিই কিট, মুখে মাস্ক পরে হিন্দুদের সব রীতি পালন করে এই মুসলিমরাই কোভিড দেহগুলোর অন্তিম কাজ সম্পন্ন করছেন।
পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম মেদিনীপুরের দাসপুরের মামুদপুর গ্রামে হিন্দু প্রতিবেশীর লাশ সৎকার করে মানবিকতা দেখিয়েছেন স্থানীয় মুসলিম যুবকরা। বাড়িতেই মৃত্যু হয় মামুদপুরের বাসিন্দা করোনা আক্রান্ত বলাই রানার। মৃতের পরিবারের অভিযোগ, সংক্রমণের আশঙ্কায় ধারেকাছে ঘেঁষেননি প্রতিবেশীরা। দেহ সৎকারে ঘিরে সমস্যা তৈরি হয়। খবর পেয়ে এগিয়ে আসে মুসলিম প্রতিবেশীরা। তাদের সহায়তায় দেহ সৎকার করে মৃতের পরিবার। খোদ ঈদের দিন আনন্দ-উল্লাসে বিরতি দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের হুগলিতে হিন্দু পড়শির দেহ সৎকার করেছে মুসলিমরা। ধর্মপ্রাণ তারা। শুধু ভুলে যায়নি মানবিকতা। তাই প্রতিবেশী হিন্দু পরিবারে মৃত্যুর খবর এল যখন, তারা ঈদের উৎসব থামিয়ে বেরিয়ে পড়ল। করোনার ভয়ে নিজ ধর্মের কেউ সৎকারের কাজে হাত লাগাতে রাজি হননি। তাই মুসলিম প্রতিবেশীরা এগিয়ে এল ধর্মের সংকীর্ণতা সরিয়ে।
আশিক মোল্লা, গোলাম সুবানী, গোলাম সাব্বার, শেখ সানি-রা হুগলির পোলবা-দাদপুর ব্লকের বাবনান গ্রামের বাসিন্দা। শুক্রবার খুশির ঈদের নামাজ পড়ে তারা নিজেদের মতোই পালন করছিলেন উৎসব। এরই মধ্যে হঠাৎ খবর এল, পাশের গ্রামের ৭২ বছরের হরেন্দ্রনাথ সাধু বৃহস্পতিবার গভীর রাতে মারা গেছেন। গত তিন দিন ধরে জ্বরে ভুগছিলেন তিনি। করোনা পরীক্ষা করার আগেই তার মৃত্যু হয়েছে। তারা শুনতে পেলেন, করোনা সংক্রমণের ভয়ে কেউ মৃতের বাড়ির চৌকাঠে পা দেয়নি। একমাত্র ছেলে দিশেহারা হয়ে সাহায্য চেয়েছে, কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি সৎকারের কাজে সাহায্য করতে। মৃতের ছেলে চন্দনের এ অসহায়ত্বের কথা শুনেই উৎসব শিকেয় তুলে পাশে দাঁড়াতে বেরিয়ে পড়ে মুসলিম প্রতিবেশীরা। করোনার ভয় উপেক্ষা করে হাজির হয় মৃতের বাড়িতে। নিজেরা খাট বেঁধে, ফুল মালায় সাজিয়ে তোলে দেহ। চার ভিন্নধর্মী মানুষের কাঁধেই শেষ যাত্রায় যান হরেন্দ্রনাথ সাধু। শ্মশানেও কাঠ জোগাড় করা থেকে শুরু করে দাহ করার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত পিতৃহারা সন্তানের পাশে ছিল আশিস, গোলাম, সানি-রা।
ভারত খাতা-কলমে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হলেও হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় জনতা পার্টি তথা বিজেপি রয়েছে দেশটির রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। দেশটির সিংহভাগ জনসংখ্যাই হিন্দু ধর্মাবলম্বী। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে যখন দেশটি জেরবার, অক্সিজেনের অভাবে বিভিন্ন হাসপাতালে চলছে গণমৃত্যুর মিছিল তখন সউদী আরব দেশটির জনগণের পাশে দাঁড়ায়। রিয়াদে ভারতীয় দূতাবাসের বরাত দিয়ে সউদী গেজেট জানায়, কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের সঙ্কট মোকাবেলায় সহায়তা করতে ভারতে ৮০ মেট্রিক টন তরল অক্সিজেন পাঠিয়েছে সউদী আরব। রিয়াদে ভারতীয় দূতাবাস তাদের টুইটারে লিখেছে, ভারতে অতিপ্রয়োজনীয় ৮০ মেট্রিক টন তরল অক্সিজেন পাঠাতে আদানি গ্রুপ ও মেসার্স লিনডের সঙ্গে অংশীদার হতে পেরে ভারতীয় দূতাবাস গর্বিত। সউদী আরবের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে তাদের সাহায্য, সমর্থন ও সহযোগিতার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানায় দূতাবাস। ৬টি ক্রায়োজেনিক অক্সিজেন কন্টেইনার পাঠিয়েছে আরব আমিরাত, সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে কুয়েতও। এছাড়াও প্রয়োজনীয় ওষুধসামগ্রীসহ নানা সরঞ্জাম পাঠিয়েছে তুরস্ক। বন্ধুপ্রতীম বাংলাদেশও ভারতের কোভিড-১৯ আক্রান্তদের জন্য ওষুধসহ বিভিন্ন সামগ্রী পাঠিয়েছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।