Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ২২ কার্তিক ১৪৩১, ০৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

তামাক কোম্পানির লাগাম টানতে হবে

মো. আবু রায়হান | প্রকাশের সময় : ৩১ মে, ২০২১, ১২:০১ এএম

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবছর দিবসটির বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে Commit to Quit। যার বাংলা ভাবানুবাদ করা হয়েছে ‘আসুন আমরা প্রতিজ্ঞা করি, জীবন বাঁচাতে তামাক ছাড়ি।’ তামাকনিয়ন্ত্রণ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে মানুষকে সচেতন ও নীতিনির্ধারকদের জনবান্ধব নীতি গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে প্রতি বছর প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়। চলমান করোনা মহামারীতে ধূমপান বা তামাকজাত দ্রব্য পরিহার করার তাৎপর্য বা গুরুত্ব অনেক বেশি। বলা হচ্ছে, ধূমপায়ীদের করোনা সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি অধূমপায়ীদের তুলনায় অন্তত ১৪ গুণ বেশি!

২০১৯ সালের শেষ দিকে চীনের উহানে করোনা ভাইরাস নামক মহামারী ভাইরাসটির উৎপত্তির পর দ্রুত এটি সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যাপক প্রাণহানির পাশাপাশি করোনার কারণে সারা পৃথিবীতে যোগাযোগ ও উৎপাদন ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উন্নত দেশগুলোতে এ প্রভাব কম হলেও অনুন্নত, দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর অবস্থা শোচনীয়। বিভিন্ন দেশ এ অচলাবস্থা কাটিয়ে ওঠার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। করোনা ভাইরাসের আগ্রাসন দেড় বছর হতে চলেছে। বিজ্ঞানী, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের অক্লান্ত পরিশ্রমে ইতিহাসের স্বল্পতম সময়ের মধ্যে প্রতিষেধক টিকা আবিস্কার ও ব্যবহার শুরু হয়েছে, তবু করোনার সংক্রমণ এখনও নিয়ন্ত্রণে আসেনি। বরং, বিভিন্ন দেশে ভাইরাসটির জেনেটিক ধরণ পরিবর্তিত হয়ে তা আরো ভয়াবহ হয়ে উঠছে।

চিকিৎসা বিজ্ঞান বলছে, যাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি তাদের মধ্যে করোনা আক্রান্তের হার অল্প এবং আক্রান্ত হলেও মৃত্যুঝুঁকি তুলনামূলক কম। বিপরীত দিকে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যাদের কম কিংবা যারা অসুস্থ্য, ডায়বেটিস, সিওপিডি, হাঁপানি, এজমা, ফুসফুসের অন্যান্য রোগ, হৃদরোগ, স্ট্রোকে আক্রান্ত, তাদের করোনা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। একইসঙ্গে আক্রান্ত হওয়ার পর কোভিড-১৯ জনিত মৃত্যুঝুঁকিও বেশি।

প্রতিরোধযোগ্য রোগ, মৃত্যু ও এর কারণে অন্যান্য ক্ষয়-ক্ষতি কমিয়ে আনতে মানুষের জীবনযাত্রা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। করোনা মহামারীর এ সময়ে সারা বিশ্বের মানুষ বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরেছে।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ বছর বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসের থিম নির্ধারণ করেছে মানুষের মধ্যে তামাক ছাড়ার প্রবণতাকে উৎসাহিত করার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে, যা অত্যন্ত উৎসাহ ব্যঞ্জক।

তামাক একটি মারাত্মক ক্ষতিকর নেশাদ্রব্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা করোনা সংক্রমণের শুরু থেকেই তামাক পণ্য সেবনে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে আসছেন। গবেষণায় প্রমাণিত যে, ‘ধূমপান করোনায় আক্রান্তের ঝুঁকি ১৪ গুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে তোলে।’ ধূমপায়ীদের ফুসফুসের কার্যক্ষমতা কমে যায় ও ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদী রোগে আক্রান্ত করে- যা করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও বৃদ্ধি করে। একারণেই ধূমপায়ী ও তামাক সেবনকারীরা করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত এবং প্রাণহানির ঝুঁকিতে শীর্ষে অবস্থান করছে।

উন্নয়নশীল ও জনবহুল বিবেচনায় বাংলাদেশ বহুজাতিক তামাক কোম্পানিগুলোর কাছে বিশাল বাজার। বিপুল বিনিয়োগের মাধ্যমে এদেশে মৃত্যুশলাকা’র ব্যবসা বিস্তৃত করার লক্ষ্যে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। এর সর্বশেষ উদাহরণ জাপান টোব্যাকো (জেটিআই)। প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকায় আকিজ টোব্যাকো’র ব্যবসা কিনে এখন তারা দেশে বিএটিবি’র পরেই বড় বহুজাতিক তামাক কোম্পানি! বিনিয়োগেই শেষ নয়, বরং ভোক্তা তৈরীতেও এ সকল কোম্পানিগুলো রাষ্ট্রীয় আইন লঙ্ঘণ করে নানান কূটকৌশল প্রয়োগসহ সমস্ত অনৈতিক পন্থা অবলম্বন করে আসছে।

Global Adult Tobacco Survey 2017 এর তথ্যানুসারে, বাংলাদেশে ১৫ বছর ও তদুর্ধ্ব বয়সীদের ৩ কোটি ৭৮ লাখ (৩৫.৩%) মানুষ নানান উপায়ে তামাক ব্যবহার করে এবং প্রায় ৪ কোটি ১০ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ নিজ বাড়িতেই পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়। বছরে ১ লক্ষ ৬১ হাজারের অধিক মানুষ তামাকজনিত রোগে অকালে মৃত্যুবরণ করে (Tobacco Atlas-2018)। মানুষকে তামাক সেবনে নিরুৎসাহিত করার পাশাপাশি কোম্পানিগুলোকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ না করা হলে তামাকসেবীর সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে! সুতরাং, তামাক কোম্পানির লাগাম টানতে হবে।

সরকার জনস্বার্থে ‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫’ প্রণয়ন করেছে, ২০১৩ সালে আইনটি সংশোধন করেছে। পাশাপাশি আইনটি যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়ায় তামাক কোম্পানিগুলো এর সুবিধা নিচ্ছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ মানুষকে তামাক সেবন থেকে বিরত রাখতে আইন বা নীতি গ্রহণ, তামাকবিরোধী বেসরকারী সংস্থাগুলোকে সাথে নিয়ে সচেতনতামূলক কাজ করছে। অন্যদিকে, তামাক কোম্পানিগুলোও তাদের পণ্যের ব্যবসা সম্প্রসারণ ও ভোক্তা তৈরীতে অপতৎপরতা চালাচ্ছে। আইনে তামাক পণ্যের সব ধরনের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ হলেও এখনো কৌশলে বিজ্ঞাপন চালিয়ে যাচ্ছে। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে ‘ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্ট’ বাজারে আনছে যেমন: ই-সিগারেট। এসকল পণ্যের দীর্ঘমেয়াদী ভোক্তা তৈরীতে তামাক কোম্পানিগুলোর প্রধান টার্গেট আমাদের তরুণ প্রজন্ম!

Global Youth Tobacco Survey তে দেখা যায়, ২০১৮ সালে বিশ্বব্যাপী উঠতি বয়সী (১৩-১৫ বছর বয়সী) ছেলে-মেয়েদের মধ্যে অন্তত ৪.৩ কোটি (১.৪ কোটি মেয়ে এবং ২.৯ কোটি ছেলে) তামাক ব্যবহার করে। বাংলাদেশর চিত্রও আশঙ্কাজনক! বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরিচালিত গ্লোবাল স্কুল বেইজড স্টুডেন্ট হেলথ সার্ভে, ২০১৪ এর তথ্য মতে, বাংলাদেশে উঠতি বয়সী (১৩-১৫ বছর বয়সী) ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে তামাক ব্যবহার করে ৯ দশমিক ২ শতাংশ। উদ্বেগজনক এই পরিস্থিতির প্রধান কারণ- তামাক পণ্যের বিজ্ঞাপন, প্রচারণা, সহজলভ্য ও সহজপ্রাপ্যতা।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আশেপাশে ও জনবহুল এলাকায় ছোট ছোট বিক্রয়কেন্দ্রগুলোকে (Point of Sale) তাদের পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রদর্শন ও প্রচারণার প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে তামাক কোম্পানিগুলো। ক্রেতা-বিক্রেতাকে উপহার, উপঢৌকন প্রদানের মাধ্যমে তামাক পণ্য সেবনে উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি চলছে দেদারছে। এছাড়া নাটক, সিনেমায় জনপ্রিয় অভিনয় শিল্পীদের ব্যবহার করে পরোক্ষ প্রচারণা, তরুণদের সম্পৃক্ত করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন এবং তামাক বিপণন কাজে তরুণদের ব্যবহার তামাক কোম্পানিগুলোর অন্যতম বড় কৌশল।

তামাক একটি মারাত্মক নেশা। নিকোটিনের নেশার কারণে মানুষ সহজে তামাক বা ধূমপান ছাড়তে পারে না। আন্তর্জাতিক তামাক নিয়ন্ত্রণ চুক্তি ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) আর্টিকেল ১৪-এ তামাকের আসক্তি কমানোর বিভিন্ন পদক্ষেপ বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। বাংলাদেশ এ চুক্তিকে স্বাক্ষর ও অনুসমর্থন করলেও তামাক ত্যাগে সহায়তামূলক কোন কর্মসূচি চালু করতে পারেনি। তামাকের নেশায় আসক্তদের এ নেশা বর্জনে সহায়তার জন্য প্রধানত তিন ধরনের পদক্ষেপ কার্যকর। প্রথমত; কাউন্সেলিং, দ্বিতীয়ত; কুইট লাইন (তামাক বর্জনে সহায়তার জন্য সুনির্দিষ্ট টেলিফোন লাইন) তৃতীয়ত; তামাক বর্জনে সহায়তার জন্য প্রয়োজনীয় ঔষধপত্র সুলভ ও সহজলভ্য এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে বিনামূল্যে সরবরাহ করার ব্যবস্থা করা।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ধূমপান ত্যাগে সহায়তার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি রয়েছে। কোন কোন দেশে কুইট লাইন (সার্বক্ষনিক ফোন), মোবাইল অ্যাপস, অনলাইনে তামাক বর্জনে সহায়তা কর্মসূচি রয়েছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, মানসিক সহায়তার জন্য মনোচিকিৎসক ও সহায়ক কর্মী রয়েছে, যারা তামাক বর্জনের বিভিন্ন ধাপে আসক্ত ব্যক্তিকে সহায়তা করে থাকে। আমাদের দেশের চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত। এখানে তামাক আসক্তদের এ নেশা হতে বেরিয়ে আসতে সহায়ক কর্মসূচি নেই। এ বিষয়ে একটি জাতীয় ‘হেল্পলাইন/কুইটলাইন’ চালু করা দরকার।
লেখক: উন্নয়ন কর্মী, সাংবাদিক।



 

Show all comments
  • Dadhack ১ জুন, ২০২১, ১২:৫৩ পিএম says : 0
    Scientist around the world unanimously gave verdict that Tobacco is the mother of all drug i.e. Cigarette, Bidi, Gul, Zarda. When a smoker inhale one puff, it contains 7000 poisonous chemicals and when he puff out it pollute the environment. Second hand smoke cause serious damage peoples health. There was a report published in Bangladesh news paper that every year 30 thousands crores of taka spends on treatment of tobacco related diseases, not only that where tobacco cultivate nearby crops are damage due to tobacco plant.
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: তামাক


আরও
আরও পড়ুন