পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান উপলব্ধি করেছিলেন, গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে হলে অবশ্যই মত ও পথের শত ফুল ফুটতে দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে সাংবাদিকতার স্বাধীনতা অবিচ্ছেদ্য ও অপরিহার্য। তাই গণমাধ্যমের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট জিয়ার সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত নিবিড়। ব্যক্তিগত আগ্রহ ও নিজস্ব অনুপ্রেরণা থেকেই তিনি এ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। সংবাদমাধ্যমের শক্তি, ক্ষমতা ও গুরুত্ব তিনি গভীরভাবে অনুভব করেছিলেন। তিনি মনে করতেন, দেশের সার্বিক স্থিতিশীলতা ও টেকসই উন্নয়নে গণমাধ্যম ব্যাপক অবদান রাখতে পারে। ১৯৭৫ সালে জিয়াউর রহমান উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক থাকাকালে প্রথম বারের মতো তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। তখনই তিনি গণমাধ্যমের সমস্যা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে সাম্যক ধারণা নেন। রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্রসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের সুদূরপ্রসারি উন্নয়নের চিন্তা তার মাথায় আসে। তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকার কারণে সংবাদকর্মীদের সঙ্গে গড়ে ওঠে নিবিড় সম্পর্ক।
দেশের উন্নয়নে সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা অনুধাবন করেছিলেন বলেই প্রেসিডেন্ট জিয়া সে সময়ের জনপ্রিয় সাপ্তাহিক বিচিত্রার সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘জাতীয় ঐক্যের লক্ষ্যে আপনারা জনমত গড়ে তুলুন, যা অবশ্যই সংগঠিত ও ব্যবহৃত হবে জাতীয় উন্নয়ন ও পুনর্গঠনের জন্য। সবাইকে এ কথা মনে রাখতে হবে, কেবল অনৈক্যের কারণে এ দেশ সুদীর্ঘ দু’শ বছর বিদেশি শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক শোষিত হয়েছে। কাজেই জাতীয় ঐক্যই কেবল আমাদের জীবনে আনতে পারে শক্তি, অগ্রগতি ও সুখ-শান্তি। ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য এ আমাদের এক অবশ্য কর্তব্য। আমাদের বর্তমান উৎসর্গিত হোক ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য’ (বিচিত্রা, ২৪ মার্চ ১৯৭৮ সংখ্যা)।
প্রেসিডেন্ট জিয়া গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন, গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত হচ্ছে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা। সংবাদমাধ্যম স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ পেলে তাতে দেশ, জাতি ও সরকার সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, প্রশাসনযন্ত্রকে দুর্নীতিমুক্ত ও গণমুখী করতে হলে সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। ১৯৭৮ সালের ৩০ নভেম্বর রেডিও-টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে জিয়াউর রহমান সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সম্পর্কে আমি দু’একটি কথা বলা দরকার মনে করছি। যারা বাংলাদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন তাদেরকে অনুরোধ করবো, তারা যেন দেশের অসংখ্য পত্র-পত্রিকার পৃষ্ঠাগুলোতে একবার চোখ বুলান। স্বাধীনতাকে প্রায় দায়িত্বহীনতার পর্যায়ে নিয়ে গেছেন কয়েকজন। তবু তারা পত্র-পত্রিকা প্রকাশ করে যাচ্ছেন বিনা বাধায়। শুধু তাই নয়, এদের অনেকেই পরোক্ষভাবে নানা রকম সরকারি সহায়তা দাবি করছেন এবং পাচ্ছেনও। আমরা সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় সম্পূর্ণ বিশ^াসী এবং সাংবাদিকদের দায়িত্ববোধ, কর্তব্যনিষ্ঠা ও দেশপ্রেম সম্পর্কে সম্পূর্ণ আস্থাশীল। সাংবাদিকদের অবস্থার উন্নয়নের জন্য এবং সাংবাদিকতার যথার্থ বিকাশ ও উন্নতির জন্য আমরা ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি।’ (দৈনিক বাংলা, ১ ডিসেম্বর ১৯৭৮)।
জিয়াউর রহমান দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথমে সংবাদপত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক সব কালাকানুন শিথিল করে দেশের সর্বত্র থেকে সংবাদপত্র প্রকাশে উৎসাহ প্রদান করেন। শুধু তাই নয়, প্রকাশিত সংবাদপত্র টিকিয়ে রাখা সরকারের দায়িত্ব বলেই তিনি মনে করতেন। তিনি আগের সরকারের ডিক্লারেশন বাতিল করা সংবাদপত্রগুলো একে একে প্রকাশের অনুমতি দেন। সেই সাথে নতুন পত্রিকা প্রকাশের পথ অবারিত করেন। তিনি মফস্বল শহর রাজশাহী থেকে ‘দৈনিক বার্তা’ নামে একটি প্রথম শ্রেণির পত্রিকা প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। এ পত্রিকা ঘিরে সমগ্র উত্তরাঞ্চলে তথ্য প্রবাহের ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটে যায়। পত্রিকা অফিস থেকে শুরু করে থানা পর্যায় পর্যন্ত বিপুল সংখ্যক সাংবাদিকের কর্মসংস্থান হয়। উত্তরের মানুষের সুখ, দুঃখ, হাসি-কান্নার প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠে দৈনিক বার্তায়।
কোমলমতি শিশু-কিশোরদের নিয়ে গভীর ভাবনা ছিল জিয়ার। দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিকদের সমাজ সচেতন করে গড়ে তুলতে ‘কিশোর বাংলা’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশে উদ্যোগী হন তিনি। পরবর্তীতে এ পত্রিকাটি শিশু-কিশোরদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ১৯৭৯ সালের গোড়ায় তিনি ‘গণতন্ত্র’ নামে একটি রাজনৈতিক সাপ্তাহিক প্রকাশে পৃষ্ঠপোষকতা দেন। পাশাপাশি দৈনিক জনপদও প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু জনপদ প্রকাশনায় আর্থিক অস্বচ্ছতা দেখা দিলে একই বছরের মধ্যভাগে রাষ্ট্রপতি জিয়ার প্রচেষ্টায় প্রকাশিত হয় জাতীয় পত্রিকা ‘দৈনিক দেশ’। পত্রিকাটির নামকরণ করেন খোদ জিয়াউর রহমান। তিনি ইচ্ছা করলে নিজ মালিকানায় পত্রিকাটি প্রকাশ করতে পারতেন। কিন্তু তা তিনি করেননি। পত্রিকাটি প্রকাশের ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের পূর্ণ স্বাধীনতা দেন তিনি। সরকারের বিভিন্ন বিভাগের অনিয়ম, দুর্নীতি, ত্রুটি তুলে ধরার নির্দেশনা দিয়েছিলেন সাংবাদিকদের। আবার পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের পর ত্বরিৎ ব্যবস্থাও নিতেন তিনি।
জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ডিক্লারেশনের শর্ত শিথিল করার কারণে ঢাকা থেকে শুরু করে বিভাগ, জেলা এমনকি থানা পর্যায় থেকে দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিক পত্রিকা প্রকাশ হতে থাকে। এসব পত্রিকা টিকিয়ে রাখতে জিয়াউর রহমান সরকারি বিজ্ঞাপন বণ্টন নীতিও শিথিল করেন। বিভিন্ন সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন বণ্টন ব্যবস্থা কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণমুক্ত করেন তিনি। একই সঙ্গে সরকারি বিজ্ঞাপনের ৬০ ভাগ ঢাকা থেকে প্রকাশিত পত্রিকায় এবং বাকি ৪০ ভাগ মফস্বল থেকে প্রকাশিত পত্রিকায় বণ্টনের ব্যবস্থা করেন তিনি। এর ফলে সারা দেশে সংবাদপত্র প্রকাশনায় নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়।
প্রেসিডেন্ট জিয়া সংবাদকর্মীদের চাকরি ও আর্থিক নিরাপত্তার বিষয়টি গভীরভাবে ভেবেছিলেন। সেই ভাবনা থেকেই তিনি সংবাদপত্রসেবীদের বেতনভাতা নির্ধারণে ওয়েজবোর্ড গঠন করেন। ১৯৭৬ সালে তিনি বেতন বোর্ড পুনরুজ্জীবিত করেন এবং ১৯৭৭ সালের পয়লা মে তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টায় সংবাদপত্রসেবীদের জন্য ওয়েজবোর্ড রোয়েদাদ ঘোষণা করা হয়। একই সঙ্গে ঘোষিত বেতন স্কেল বাস্তবায়নের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ইমপ্লিমেন্টেশন সেলও গঠন করে দেন। তিনি সাংবাদিক, মালিক, সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠন করেন প্রেস কনসালটেটিভ কমিটি। এ কমিটির কাজ ছিল স্বাধীন সাংবাদিকতার অন্তরায়গুলো দূর করা।
১০ জানুয়ারি ১৯৭৮ বঙ্গভবনে মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রেসিডেন্ট জিয়া। সংবাপত্রের স্বাধীনতা রক্ষা, সংবাদপত্র ও সংবাদ সংস্থার মানোন্নয়ন এবং পেশাগত উৎকর্ষ সাধনের বিষয়ে আলোচনা হচ্ছিল। এ সময় তিনি প্রেস কাউন্সিল গঠনের ঘোষণা দেন। তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়কে এ ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বলেন। সাংবাদিকদের আরেকটি দাবী ছিল প্রেস কমিশন গঠন। জিয়াউর রহমান প্রেস কমিশন গঠনেরও উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং এ ব্যাপারে পদ্ধতিগত কার্যক্রম চলতে থাকে। বিভিন্ন জটিলতায় কমিশন গঠনের কাজ ধীরগতিতে চলছিল। সে কারণে জীবিত অবস্থায় প্রেস কমিশনের আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা তিনি দেখে যেতে পারেননি। তার ধারাবাহিকতায় ১৯৮২ সালে একটি প্রেস কমিশন গঠিত হয়। কমিশনের পক্ষ থেকে একটি রিপোর্ট পেশ করার কথা ছিল। কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন আতাউর রহমান খান। সেই প্রেস কমিশনের রিপোর্ট আজও প্রকাশিত হয়নি।
প্রেসিডেন্ট জিয়া বুঝেছিলেন, মানসন্মত নির্মোহ সাংবাদিকতার জন্য সুশিক্ষিত সাংবাদিক প্রয়োজন। সাংবাদিকদের পেশাগত মান উন্নয়ন ও তাদের সুষ্ঠুভাবে প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য তিনি বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (পিআইবি) প্রতিষ্ঠা করেন নিজে উদ্যোগী হয়ে। পেশায় বিজ্ঞ ও বিদগ্ধ ব্যক্তিদের মাধ্যমে এমনকি বিদেশ থেকে প্রশিক্ষক এনে তিনি সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। ১৯৭৬ সালের ১৮ আগস্ট বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গেজেটে প্রকাশিত হয়।
নগরজীবনে আবাসন সংকটে সাংবাদিকরা ভীষণভাবে কষ্ট পাচ্ছিলেন। স্বল্প আয়ের সাংবাদিকদের আবাসন সমস্যা ও দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে তিনি মিরপুরে ২২ বিঘা জমি সাংবাদিক সমবায় সমিতির নামে বরাদ্দ করেছিলেন। দেড় শতাধিক সাংবাদিকের সেখানে আবাসনের ব্যবস্থা হয়েছিল। এখন সেখানে বহুতল ভবন করে সাংবাদিকরা শুধু বসবাসই করছেন না, ভাড়া দিয়ে নেজেদের আর্থিক স্বচ্ছলতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন।
সাংবাদিকদের মান মর্যাদার বিষয়ে জিয়া ছিলেন খুবই সচেতন। ১৯৭৬ সালে তোপখানা রোডে পুরনো লাল বিল্ডিংয়ে প্রেসক্লাব ভেঙ্গে নতুন ভবন নির্মাণের তোড়জোর চলছিল। আন্তার্জাতিকভাবে খ্যাত ব্যবসায়ী প্রিন্স করিম আগা খান প্রেসক্লাব ভবন নির্মাণের ব্যয় বহনের ঘোষণা দেন। ক্লাব ভবনের ভিত্তি স্থাপন করতে এসে জিয়াউর রহমান বিষয়টি জানতে পারেন। তিনি বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেননি। সাংবাদিক নেতাদের ডেকে তিনি বলেন, প্রেসক্লাব হচ্ছে একটি জাতীয় ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। এর উন্নয়ন মানে গণতন্ত্রের উন্নয়ন, সাংবাদিকতার প্রসার। অতএব, বিদেশি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর অর্থানুকূল্যে এ প্রতিষ্ঠানের ভবন নির্মিত হওয়া উচিৎ নয়। তা হলে সাংবাদিকদের মর্যাদা ও নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এটা নির্মিত হবে আমাদের নিজস্ব টাকা দিয়ে। তিনি জানালেন, প্রেসক্লাব ভবন নির্মাণের সব ব্যয়ভার বহন করবে খোদ সরকার। তিনি আরও বলেন, এ প্রেসক্লাব হবে গণতন্ত্রের প্রতীক, স্বাধীনতার প্রতীক। অচিরেই সরকারের খরচে নির্মিত হয় বর্তমান প্রেসক্লাব ভবন।
উপসংহারে আমরা বলতে পারি, সাংবাদিকতা ও সাংবাদিকদের উন্নয়নে প্রেসিডেন্ট জিয়ার ভূমিকা ও অবদান অবিস্মরণীয়। ইতিহাসে তা উজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে আছে।
লেখক: সাংবাদিক, কলাম লেখক ও সভাপতি, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।