পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
দুই বছরের মাথায় আবারও ভয়াবহ অগ্নিকান্ড ঘটেছে পুরান ঢাকায়। সম্প্রতি আরমানিটোলায় কেমিক্যাল গুদামে লাগা আগুনে চারজন নিহত হয়েছেন। দগ্ধ হয়েছেন অন্তত ২২ জন। আরমানিটোলার ভয়াবহ ওই আগুনে শুধু আরমানিয়ান স্ট্রিটে মুসা ম্যানশন নামে ভবনটিই পোড়েনি, পুড়ে গেছে সাজানো একটি পরিবার। ইডেন মহিলা কলেজের ইংরেজি তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সুমাইয়া পরিবারের সঙ্গে ভবনটির চতুর্থ তলায় থাকতেন। কেমিক্যালের আগুনে দম বন্ধ হয়ে মারা যান তিনি। তার বাবা ইব্রাহিম, মা সুফিয়া, নবদম্পতি বোন মুনা ও দুলাভাই আশিক এবং ছোট ভাই জুনায়েদের অবস্থাও সংকটাপন্ন। তারা শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভুগছেন মৃত্যু যন্ত্রণায়।
সুমাইয়া ছাড়াও ওই আগুনের ঘটনায় আরও তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। তারা হলেন- ভবনের কেয়ারটেকার রাসেল মিয়া, সিকিউরিটি গার্ড ওলিউল্লাহ ব্যাপারী ও তার আত্মীয় কবির।
পুরান ঢাকা থেকে অগ্নিকান্ডের ঝুঁকি আর গেল না। ২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীতে ভয়াবহ আগুনে মারা যায় ১২৫ জন। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চুড়িহাট্টার ওয়াহিদ ম্যানশনে রাসায়নিকের গুদামে বিস্ফোরণে লাগা আগুনে পুড়ে মারা যায় ৭১ জন। ওই বিস্ফোরণের কারণ ছিল রাসায়নিকদ্রব্য। একইভাবে নিমতলীর আগুনের কারণও ছিল রাসায়নিকদ্রব্য, যা জুতার আঠা তৈরির জন্য ব্যবহার করা হয়। নিমতলীর মর্মান্তিক ঘটনার পর রাসায়নিকের গুদাম ও দাহ্য পদার্থ ব্যবহার করে তৈরি পণ্যের কারখানা পুরান ঢাকা থেকে কেরানীগঞ্জে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। সেখানে রাসায়নিকপল্লী করার কাজও শুরু হয়। কিন্তু কাজ শেষও হয়নি। ৯ বছর পর চুড়িহাট্টার ঘটনার পরে গাজীপুরের টঙ্গী ও রাজধানীর শ্যামপুরে অস্থায়ীভাবে রাসায়নিকের ব্যবসা সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ মাঝপথে থমকে যায়। সরেনি রাসায়নিকের গুদাম ও কারখানা। অবৈধ কেমিক্যাল ব্যবসায়ীরা তাঁদের ব্যবসা বাড়িয়েই চলেছেন। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় প্রভাবের সঙ্গে যোগ হয়েছে রাজনৈতিক প্রভাব।
একটি পরিবেশ সংগঠনের হিসাব বলছে, পুরান ঢাকায় রয়েছে ২৫ হাজার কেমিক্যাল গোডাউন বা রাসায়নিক দাহ্য বস্তুর গুদাম। এসবের মধ্যে ১৫ হাজার আছে বাসাবাড়িতেই। মাত্র আড়াই হাজার গুদামকে ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছে সিটি করপোরেশন। বাকি ২২ হাজারের বেশি গুদামই অবৈধ। আড়াই শতাধিক ক্ষতিকর ও ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিকের ব্যবসা রয়েছে এলাকায়।
২০১০ সালে পুরান ঢাকার নিমতলীতে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে ১২৫ জনের প্রাণহানির পর দুর্ঘটনা রোধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি রাসায়নিক কারখানা অপসারণসহ ১৭ দফা নির্দেশনা দেয়। উচ্চ পর্যায়ের সেই কমিটির দেওয়া সুপারিশমালা বাস্তবায়ন না করায় পরে রুলও জারি করেন হাইকোর্ট। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে চুড়িহাট্টার ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনার তদন্ত শেষে অগ্নিদুর্ঘটনার ঝুঁকিতে থাকা পুরান ঢাকায় অগ্নিকান্ড প্রতিরোধে আবার ২৫টি সুপারিশ করে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের গঠিত কমিটি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটিও পাঁচটি স্বল্পমেয়াদি ও ২৬টি দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশ করে।
তদন্ত কমিটিগুলোর সুপারিশ বাস্তবায়ন করা গেলে হয়তো অনেক সমস্যার সমাধান হতো। পুরান ঢাকার ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার পরিবর্তন ঘটত। কিন্তু সব সুপারিশ শুধু কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। সরানো হয়নি রাসায়নিকের গুদাম। অগ্নিকান্ডের ঝুঁকি নিয়েই বসবাস করতে হচ্ছে পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের। পুরান ঢাকা থেকে অবিলম্বে সব রাসায়নিকের কারখানা, দোকান ও গুদাম সরাতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
নিমতলী ট্র্যাজেডির পর আমাদের টনক নড়ে গিয়েছিল বলে প্রতীয়মান হয়েছিল এবং অতিশয় ঘনবসতিপূর্ণ পুরান ঢাকায় অগ্নিকান্ডের ঝুঁকি কমানোর জন্য কিছু করণীয় আছে বলে আমরা স্থির করেছিলাম। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল, সেই কমিটি তদন্ত শেষে ১৭টি সুপারিশসহ একটি তদন্ত প্রতিবেদন সরকারের কাছে পেশ করেছিল। সেই সব সুপারিশ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা হলে চকবাজারে নিমতলী অগ্নিকান্ড ও সাম্প্রতিক আরমানিটোলার অগ্নিকান্ডের পুনরাবৃত্তি হয়তো-বা এড়ানো যেত। আর আগুন লাগলেও এত দ্রুত তা হয়তো ছড়িয়ে পড়তে পারত না, দ্রুত আগুন নেভানো সম্ভব হতো, এত বেশিসংখ্যক প্রাণহানি এড়ানো যেত।
প্রথমত, লক্ষ করা প্রয়োজন, পুরান ঢাকার অধিকাংশ মহল্লা অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ। ঘনবদ্ধ ঘরবাড়ি, দোকানপাট, কুটিরশিল্পের আদলে অজ¯্র ছোট ছোট কারখানা ও বিপুল জনগোষ্ঠী-অধ্যুষিত এলাকা এমনিতেই অগ্নিকান্ডের উচ্চ ঝুঁকির মুখে থাকে। উপরন্তু পুরান ঢাকার নিমতলী ও চকবাজারে অত্যন্ত দাহ্য নানা রকমের রাসায়নিক পদার্থের মজুত, ব্যবহার, কেনাবেচা ও পরিবহন চলে। উভয় স্থানের অগ্নিকান্ডের ব্যাপকতার পেছনের প্রধান কারণ রাসায়নিক পদার্থগুলোর গুদাম ও কারখানা। তাই নিমতলী অগ্নিকান্ডের পর গঠিত তদন্ত কমিটির বিশেষজ্ঞরা যে ১৭টি সুপারিশ পেশ করেছিলেন, সেগুলোর প্রথমেই ছিল বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের গুদাম ও কারখানাগুলো সরিয়ে নেওয়া।
সুপারিশে বলা হয়েছিল, এগুলো সরিয়ে নিতে হবে জরুরি ভিত্তিতে, অর্থাৎ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। কিন্তু তারপর দীর্ঘ ১০ বছর চলে গেছে, এই সুপারিশ বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। এর জন্য দায়ী কে? তাই তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নে ব্যর্থতার জন্য যাঁরা দায়ী, তাঁদের শাস্তির পদক্ষেপ অবশ্যই নেওয়া প্রয়োজন। শুধু রাসায়নিক পদার্থের গুদাম ও কারখানাগুলো সরিয়ে নেওয়া নয়, আরও ১৬টি সুপারিশ পেশ করা হয়। সেই সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি। হলে এই ঘটনা ঘটতো না।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, উপদেষ্টা, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, সদস্য এফবিসিসিআই এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে ২ ও ৩ নং সেক্টরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।