পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
গত ৯ জিলহজ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ১৫ লাখেরও বেশী মানুষ হজ সম্পন্ন করেছেন। ওই দিন ঐতিহাসিক আরাফাতের ময়দানে তারা সমবেত হন। সেখানে তারা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অবস্থান করেন। তাদের কণ্ঠে মুহুর্মুহু ধ্বনিত হতে থাকে : ‘আমি হাজির, হে আল্লাহ আমি হাজির। তোমার কোনো শরীক নেই, আমি হাজির। নিশ্চয়ই সব প্রশংসা ও নিয়ামত তোমারই এবং সব সাম্রাজ্য তোমারই।’ ওই ময়দানে অবস্থিত মসজিদে নামেরায় সমবেত জনমÐলীর উদ্দেশে খুতবা দেন মসজিদুল হারামের প্রধান ইমাম ও খতিব শায়খ আব্দুর রহমান আস সুদাইস। দীর্ঘ ৩৫ বছর পর এই প্রথম নতুন খতিব খুতবা প্রদান করেন। সউদী আরবের গ্র্যান্ড মুফতি শায়খ আবদুল আজিজ বিন আবদুল্লাহ আশ শায়েখ স্বাস্থ্যগত কারণে খুতবা দেয়া থেকে অবসর নিলে শায়খ আবদুর রহমান আস সুদাইসকে নতুন খতিব নির্বাচন করা হয়। নতুন খতিব এবার যে খুতবা দিয়েছেন বিদ্যমান প্রেক্ষাপটসহ নানা দিক দিয়ে তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সংহতি কামনা করে কিছু দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন যার মর্ম ও গুরুত্ব অপরিসীম। তিনি ধর্ম প্রচারে বল প্রয়োগ ও উগ্রপন্থা পরিহারের আহŸান জানিয়ে বলেছেন : আমরা নবী মুহম্মদ (স.) এর উম্মত। আমাদের দায়িত্ব অনেক বেশী, ভুলে গেলে চলবে না। মানুষকে দ্বীনের পথে আনতে হবে সুন্দর হৃদয় দিয়ে। বল প্রয়োগ করে ধর্ম প্রচার করা যাবে না। উগ্রতা পরিহার করতে হবে। ইসলাম প্রচারে যুবকদের ভূমিকা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন : ইসলামের প্রচার ঘটেছে যুবকদের হাত ধরে। যুবকদের দায়িত্ব অনেক বেশী। যৌবনে তাদের গা ভাসিয়ে দিলে চলবে না।
এটা ঐতিহাসিকভাবে সত্য, ইসলাম জোর-জবরদস্তি, বল প্রয়োগ, উগ্রতা প্রদর্শন কিংবা যুদ্ধের মাধ্যমে প্রচারিত হয়নি। ইসলাম প্রসারিত হয়ে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে সাম্য, মৈত্রী, ভ্রাতৃত্ববোধ, সহমর্মিতা, সহানুভূতি, কল্যাণচিন্তা ও মানবিকতাবোধের আদর্শের কারণে। যারা ইসলাম প্রচার করেছেন, তাদের আল্লাহর ওপর অবিচল আস্থা, বিশ্বাস, সততা, ন্যায়বিচার, সমদর্শিতা ও সদাচার মানুষকে মুগ্ধ ও অনুপ্রাণিত করেছে। তাদের দেখে মানুষ ইসলামকে দেখেছে এবং দলে দলে এই শান্তির ধর্মে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। এই উপমহাদেশে ইসলামের আবির্ভাব হয়েছে প্রচারক আউলিয়া-দরবেশদের মাধ্যমে, যাদের সঙ্গী-সাথীদের অনেকেই ছিলেন বয়সের দিক দিয়ে যুবক। ইসলামকে তারা শান্তি, নিরাপত্তা, সমতা, ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের আদর্শ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। তাদের জীবন ও কর্মের মাধ্যমে তারা প্রচারিত আদর্শের প্রতিফলন লোক সম্মুখে উপস্থাপন করেছেন। বিভেদ, বৈষম্য, অন্যায়, অবিচার, শোষণ-বঞ্চনায় অতীষ্ঠ মানুষ ইসলামকে তাদের মুক্তির উপায় হিসেবে দেখেছে এবং ইসলাম গ্রহণ করে মানবজীবনের সার্থকতা খুঁজে পেয়েছে। শুধু এই উপমহাদেশ কেন, এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপÑ সর্বত্র ইসলামের প্রচার-প্রসার ঘটেছে এভাবে। ইসলামের ব্যাপক প্রচার-প্রসারের এক পর্যায়ে এসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ও অঞ্চলে মুসলমানদের রাজনৈতিক বিজয় অর্জিত হয়েছে। বিশ্বের এমন কোনো দেশ বা অঞ্চল নেই যেখানে মুসলমানদের উপস্থিতি ও বসবাস নেই। এত দ্রæত এত প্রসার আর কোনো ধর্মে ঘটেনি। দেখা গেছে, এই উপমহাদেশে মুসলমান শাসকরা শত শত বছর শাসন পরিচালনা করেছেন অথচ এমন কোনো শাসক খুঁজে পাওয়া যাবে না যিনি জবরদস্তি করে বা ভয়ভীতি প্রদর্শন করে অন্য ধর্মাবলম্বীদের ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করেছেন। বলা হয়ে থাকে, মুসলমান শাসকরা যদি ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করার নীতি অবলম্বন করতেন তবে এই উপমহাদেশে এখন অন্য কোনো ধর্মের মানুষ খুঁজে পাওয়া যেতো না। মুসলমান শাসকরা সব সময় ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের অধিকার সংরক্ষণ করেছেন। এ প্রসঙ্গে স্পেনের কথাও উল্লেখ করা যায়। মুসলমান শাসকরা কয়েকশ’ বছর একটানা স্পেন শাসন করেছেন। কিন্তু ইসলাম গ্রহণে কাউকে বাধ্য করেন নি। আগের মতো এখনো ইসলাম সবচেয়ে প্রসারমান ধর্ম। প্রতিদিনই অসংখ্য মানুষ স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করছেন। মিথ্যা প্রচারণা, প্রতারণা কিংবা বল প্রয়োগে তারা ইসলাম গ্রহণ করছেন না। ইসলামের গুণেই ইসলাম প্রসারিত হচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে মুসলমানদের মধ্য থেকে কিছু উগ্রবাদীর উদ্ভব হয়েছে যারা ইসলামের নামে নানা রকম সন্ত্রাসী কাজ করে যাচ্ছে। এদের উদ্ভব ও আবির্ভাবের পেছনে নানাবিধ কারণ ও বাস্তবতা থাকলেও বিশ্বের মুসলমানরা তাদের সন্ত্রাসী কাজ, হামলা ও হত্যাকাÐ সমর্থন করে না। লক্ষণীয়, এই উগ্রবাদী সন্ত্রাসীদের একটি বড় অংশই নবীন। তারা অপ-প্রচারণায় বিভ্রান্ত হয়ে ইসলামের নীতি-আদর্শের বিরুদ্ধেই অবস্থান নিয়েছে। উগ্রবাদীদের কার্যকলাপ ও আচরণের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মুসলিম উম্মাহ। ইহুদী-খ্রিস্টান সাম্রাজ্যবাদীদের অপ-প্রচারণা একদিকে, অন্যদিকে উগ্রবাদীদের হামলা ও হত্যাকাÐের কারণে গোটা বিশ্বেই মুসলমানেরা চরম নিগ্রহের শিকারে পরিণত হয়েছে। উগ্রবাদীরা মুসলমানদের ওপরই সবচেয়ে বেশী জুলুম করেছে, বেপরোয়াভাবে তাদেরই হত্যা করছে। আবার অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের যে হত্যা করছে তার দায়ও মুসলমানদের বহন করতে হচ্ছে। এ পটভূমিতে হজের খুতবায় যে দিক-নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, তার অনুসরণের বিকল্প নেই। আশার কথা, উগ্রবাদীদের ব্যাপারে সউদী আরবসহ মুসলিম দেশগুলোর দৃষ্টিভঙ্গী অত্যন্ত ইতিবাচক। বিশেষ করে সউদী আরবে নতুন বাদশাহ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর এব্যাপারে সউদী নীতি অত্যন্ত স্পষ্ট হয়েছে। উগ্রবাদীদের অর্থায়নের কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখের দাবি রাখে। এই অর্থায়ন বন্ধের ব্যাপারে মুসলিম দেশগুলোকে একাট্টা হতে হবে। উগ্রবাদীদের অপ-প্রচারণার জবাবে ইসলামের আদর্শ ও শিক্ষার ব্যাপক প্রচার ঘটাতে হবে। এ ক্ষেত্রে সউদী আরবসহ ধনী মুসলিম দেশগুলোকে কার্যকর উদ্যোগ-পদক্ষেপ নিতে হবে। পরিশেষে খুতবার এই অংশটি উদ্ধৃত করতে চাই, যার মধ্যে রয়েছে করণীয় দিক-নির্দেশ : ‘মুসলমানরা ভাই ভাই। আমাদের সেভাবে চলতে হবে। ইসলাম মানবতার ধর্ম, সহানুভূতির ধর্ম, ইসলাম গ্রন্থিত হয়েছে ন্যায়বিচার দ্বারা, সততা দ্বারা, ভালো ব্যবহার দ্বারা। এটা আমাদের মানতে হবে।’
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।