পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
রহমত, বরকত আর মাগফেরাতের বার্তা নিয়ে রমজান মানবজাতির কাছে হাজির হয়। রমজান মাসে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে বান্দাহ আল্লাহর কাছে পাপ মার্জনার সুযোগ লাভ করে। রমজান মাসে মানবজাতি তাকওয়া অর্জন করে। এ মাসের ইবাদতের মূল্য আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বেশি। রোজা পালন এবং রোজাদারকে ইফতার করানোর মাঝে আল্লাহ বান্দার জন্য বিশেষ পুণ্যের বরাদ্দ রেখেছেন। রোজা হচ্ছে মানবজাতির ট্রেনিং এবং আত্মগঠনের মাস। যাবতীয় মন্দ কাজকে চিরতরে পরিহার করে উত্তম চরিত্র গঠনের মাস। রমজান মাসে আল্লাহ, তার প্রিয় রাসুল হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর ওপর কোরান নাযিল করেছেন। এই কারণে রমজান মাস অনন্য বৈশিষ্ট্যের দাবিদার। আর কোরান হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত সবর্শেষ এবং সবশ্রেষ্ঠ আসমানী কিতাব, যা মানবজাতির জন্য পথপদর্শক। এই মাসেই রয়েছে হাজার রাত্রির শ্রেষ্ঠ রাত্রি পবিত্র লাইলাতুল কদর। যে রাত্রির ইবাদাত আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়। সুতরাং, রমজান মাস আসার সাথে সাথে মুসলিম সমাজে বিরাট এক পরিবর্তন আসে। মুসলমানদের চিন্তা চেতনা এবং কর্মে পরিবর্তন আসে। দৈনন্দিন কাজ কর্মের রুটিনে ও পরিবর্তন আসে। মুসলিম সমাজের সর্বত্রই একটি পবিত্র ও ভাবগম্ভীর পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
প্রতি বছর রমজান আসে, আবার প্রকৃতির নিয়মেই মাস শেষে রমজান চলে যায়। আর মুসলমানরা বছরের পর বছর ধরে রমজান পালন করছে। কিয়ামত পর্যন্ত এই ধারা চলবে। রমজান আমাদেরকে সংযম শিক্ষা দেয়, নৈতিকতা শিক্ষা দেয়, সততা শিক্ষা দেয় এবং সর্বোপরি মানব কল্যাণ শিক্ষা দেয়। রমজান সব সময় ধৈর্য্য ধারণের কথা বলেছে, মিথ্যাকে পরিহারের কথা বলেছে, সকল ধরনের পাপকে বর্জনের কথা বলেছে, অশ্লীলতাকে বর্জনের কথা বলেছে এবং অপরের ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকার কথা বলেছে। রমজান মানুষকে ভালবাসার কথা বলেছে। লোভ, লালসা, হিংসা, বিদ্বেষ পরিহারের কথা বলেছে। বিপদে আপদে অপরের পাশে থাকার কথা বলেছে। অপরের দুঃখে নিজেকে উৎসর্গ করার কথা বলেছে। কিন্তু মুসলিম জাতির বড়ই দুর্ভাগ্য যে, রমজানের প্রকৃত শিক্ষায় তারা এখনো শিক্ষিত হতে পারেনি। তাই সংযমের মাস রমজানে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম আরো বেড়ে যায়। এক শ্রেণির ব্যবসায়ী কীভাবে অত্যাধিক মুনাফা করবে, তার জন্য প্রতিযোগিতায় নামে। অথচ, এটা ইসলামের শিক্ষা নয়, রমজানেরও শিক্ষা নয়। অপরদিকে সামর্থ্যবান মানুষেরা প্রায়ই পুরো রমজান এবং ইফতারির জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য একসাথে কেনেন। ফলে বাজারে এসব পণ্যের সংকট সৃষ্টি হয়, যা পুরোটাই কৃত্রিম। আর এই সুযোগে বেশি চাহিদাকে ইস্যু বানিয়ে ব্যবসায়ীরা এসব পণ্যসামগ্রীর দাম বাড়িয়ে দেয়। আবার ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফার আশায় পণ্য মজুদ করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে এবং পণ্যের দাম ইচ্ছামত বাড়িয়ে দেয়। ফলে যারা গরিব মানুষ এবং যারা দিনে আনে দিনে খায়, তারা সেহেরী এবং ইফতারীর জন্য ভালো এবং পুষ্টিকর খাবার কিনতে পারে না। ধনী লোকেরা যেখানে উদর পূর্তি করে সেহেরী এবং ইফতারী খায়, সেখানে মুসলিম সমাজেরই অনেক মানুষ কোনো রকমে ডাল-ভাত খেয়ে সেহেরী আর পানি পান করে ইফতার করে। এই বাস্তবতায় পরিবর্তন আনতে হবে। মনে রাখতে হবে, অতিরিক্ত মুনাফার জন্য মজুদদারিতা এবং অতিরিক্ত বিলাসিতার জন্য লাগামহীন অর্থ ব্যয় কোনটাই ইসলামের শিক্ষা নয়।
সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের উচিত একসাথে পুরো মাসের বাজার না করে কয়েক দিনের বাজার করা এবং গরিব লোকেরা যাতে ভালো কিছু খেয়ে সেহেরী এবং ইফতার করতে পারে সেই ব্যবস্থা করা। রমজান আসলেই ইফতার পার্টির হিড়িক পড়ে। বড় বড় হোটেলে, জাকজকম পূর্ণ আয়োজনে, নানা ধরনের সুস্বাদু খাদ্য দিয়ে ইফতার পার্টির আয়োজন চলে। সমাজের অর্থশালী, বিত্তশালী এবং সামর্থ্যবান লোকেরাই এতে অংশগ্রহণ করে। এখন যেহেতু করোনামহামারি চলছে, তাই এবার রমজান মাসে ইফতার মাহফিলের সুযোগ নেই। সুতরাং ইফতার মাহফিলের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ গরিব মানুষের মাঝে বণ্টন করে দিন। মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার শেষে মহান আল্লাহ তাঁর সিয়াম সাধনাকারী মুসলমানদের জন্য খুশির উৎসব হিসাবে ঈদুল ফিতরের ব্যবস্থা করেছেন। এদিন মন খুলে কোলাকুলি করার দিন। এদিন ধনী-গরিব সকল মানুষের ঘরে আনন্দ এবং খুশির উৎসব চলাটাই স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সবার ঘরে এবং সবার মাঝে ঈদের আনন্দ থাকে না। কারণ, সেদিন অভাবের কারণে অনেক পরিবারের লোকজন নিজেরাও নতুন জামা কিনতে পারে না, ছোট ছোট ছেলেমেয়েদেরও নতুন জামা কিনে দিতে পারে না। আবার অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য সেমাই, পোলাও রান্না করতে পারে না। অথচ, রমজানের শিক্ষা হলো সমতার উদজ্জীবন ও আনন্দ সমভাবে উদ্যাপন। ইসলাম সব সময় মানব কল্যাণের জন্য মানব জাতিকে নির্দেশ দিয়েছে। কারণ, পৃথিবীতে একটি সুন্দর, কল্যাণময় এবং সম্প্রীতির সমাজ গঠনের জন্যই ইসলামের আভির্ভাব।
তাই ইসলাম সবসময় সত্য ও সুন্দরের কথা বলেছে, মানবপ্রেমের কথা বলেছে, মানবতার কথা বলেছে, ন্যায় বিচারের কথা বলেছে। একই সাথে হিংসা, বিদ্বেষ, লোভ, লালসাসহ যাবতীয় মিথ্যা এবং অন্যায়কে বর্জন করতে ইসলাম মানবজাতিকে নির্দেশ দিয়েছে। আসুন, আমরা ইসলামের এই শিক্ষাকে গ্রহণ করি। আমরা যেন সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, জুলুম এবং অবিচার চিরতরে বন্ধ করি। আসুন, আমরা মাদক ও যৌতুককে চিরতরে বর্জন করি। আসুন, হিংসা, বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা, গীবত এবং পরনিন্দাকে আমরা চিরতরে পরিহার করি। আসুন, আমরা সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করি। আমরা অপেক্ষাকৃত অপ্রয়োজনীয় কাজে এবং বিনোদনের জন্য অনেক সময়, অনেক টাকা ব্যয় করি। আসুন, আমরা অপ্রয়োজনীয় কাজে অর্থব্যয় বন্ধ করি এবং সেই টাকাটা এ সমাজের গরিব-দুঃখী, অসহায় ও বিপন্ন মানুষের দুঃখ দুর্দশা লাঘবের জন্য ব্যয় করি। আসুন, আমরা জাকাতটা ঠিকভাবে আদায় করি এবং জাকাতের অর্থ ইসলাম নির্দেশিত খাতসমূহে ব্যয় করি। ঈদুল ফিতরের আগেই ফিতরার টাকা পরিশোধ করি। অন্য কাজে আমাদের সময় এবং অর্থব্যয়টা যেমন স্বতঃস্ফুর্ত, ঠিক ইসলামের বিধান পালন করা এবং ইসলামের নির্দেশিত পথে অর্থব্যয়ের ক্ষেত্রেও আমাদেরকে তেমনি স্বতঃস্ফুর্ত হতে হবে। আল্লাহকে ভালবাসতে হবে সবার আগে। আল্লাহর নির্দেশিত বিধিবিধান পালন করতে হবে। আল্লাহ প্রদত্ত এবং রাসুল (সা.) প্রদর্শিত জীবন অনুসরণ করতে হবে। না হলে আমরা নিশ্চিতভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হব, যে ক্ষতি পুষিয়ে আনা কোনো দিনও সম্ভব নয়। এ রমজানই কিন্তু আমার-আপনার জীবনের শেষ রমজান হতে পারে। একজন ব্যক্তি যে আরো একটি বছর বাঁচবেন, সুস্থ থাকবেন এবং রোজা পালন করতে পারবেন, তার কিন্তু কোনো নিশ্চয়তা নেই। জীবন কিন্তু একটাই। সুতরাং এই রমজানকে কাজে লাগান, জীবনকে পরিশুদ্ধ করুন এবং স্রষ্টার নির্দেশিত পথে জীবনকে পরিচালিত করুন।
লেখক: প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক
[email protected].
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।