Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

প্ররোচিত হচ্ছে অপরাধীরা

আকাশ সংস্কৃতি : ভারতীয় সিরিয়ালের ভয়াবহ আগ্রাসন ভারতীয় নাটক, সিনেমা ও সিরিয়ালের বিষয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে মনিটরিং করা উচিত : মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন

সাখাওয়াত হোসেন | প্রকাশের সময় : ১১ এপ্রিল, ২০২১, ১২:০১ এএম

আঙুলের ছাপ ও চেহারা যাতে শনাক্ত করা না যায় সে কৌশল অবলম্বন করে ডাকাতির সময় হাতে ও মুখে গ্লাভস পরে নিত অপরাধী চক্রের সদস্যরা। ভারতীয় টিভি সিরিয়াল সিআইডি দেখে তারা এ কৌশল শিখেছিল। গত কয়েক বছর ধরে খুলনা ও রংপুরে ডাকাতি করার একপর্যায়ে অনেক মামলার আসামি হওয়ায় তারা ঢাকার আশপাশে ডাকাতি শুরু করে। অবশেষে পুলিশের তদন্ত সংস্থা সিআইডির হাতে তিনজন ধরা পড়ায় বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য।

অপরাধ জগৎ নিয়ে ভারতে তৈরি টিভি সিরিজ ও ক্রাইম-অ্যাকশন-অ্যাডভেঞ্চার ঘরানার কিছু কিছু নাটক-সিনেমা দিন দিন পরিণত হচ্ছে মগজ ধোলাইয়ের কারখানায়। এসব সিনেমা বা সিরিয়ালের প্রধান চরিত্রে থাকা জনপ্রিয় তারকা যদি অপরাধীর ভূমিকায় থাকে, তবে সেই অপরাধে আরও বেশি প্ররোচিত হচ্ছে একশ্রেণির অপরাধীরা। এক্ষেত্রে সিনেমার দৃশ্যগুলো বাস্তবতা বর্জিত হলেও প্রিয় তারকার কাছ থেকে ‘আইডিয়া’ নিতে বাছবিচার করছে না তারা।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ভারতীয় টিভি সিরিজ ‘ক্রাইম পেট্রোল’ দেখে দেশে গত দুই বছরে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে রয়েছে-গত বছরের অক্টোবরে সাতক্ষীরায় ছোট ভাইয়ের হাতে দুই সন্তান ও স্ত্রীসহ বড় ভাই হত্যাকান্ড, একই মাসে চট্টগ্রামের চান্দগাঁওয়ে আলোচিত জোড়া খুন (মা-ছেলে), ২০১৯ সালের জুনে পিরোজপুরের ইন্দুরকানিতে ১৩ বছরের এক কিশোরকে অপহরণ করে হত্যা, একই বছরের ফেব্রুয়ারিতে চট্টগ্রামের আকবর শাহ এলাকায় টাকা না পেয়ে ভাবিকে হত্যা।

এছাড়া ২০১৯ সালের মার্চে কেরানীগঞ্জে এবং এপ্রিলে সাভারের ভাকুর্তায় দুই রিকশাচালকের হত্যাকান্ড। এই ঘটনাগুলোয় জড়িতদের বেশিরভাগই কৈশোর বয়স অতিক্রম করেছে। কিন্তু স¤প্রতি বগুড়া ও রাজধানীর চাঞ্চল্যকর দুটি ঘটনায় জড়িত ছিল কিশোররা। অতীতে শুধু ‘ক্রাইম পেট্রোল’ দেখে অপরাধে জড়ানোর খবর এলেও এবার হয়েছে হিন্দি সিনেমা দেখে।

বগুড়ায় গত মাসে ১৬ বছর বয়সী এক কিশোর হিন্দি সিনেমা ‘ধুম-৩’ ১৫৪ বার দেখে ‘ফিল্মি স্টাইলে’ ব্যাংক ডাকাতির চেষ্টা করে। সে অভিনয়ের নানা কৌশল ও ‘অ্যাকশন’ বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করতে চায়। ডাকাতির চেষ্টাকালে ব্যবহার করে বিশেষ ‘রুফটপ গøাভস’। তালা কাঁটতে ব্যবহার করে বিশেষ কাটার। মুখোশ পরা এই কিশোরের ছোড়া দাহ্য পদার্থ ও ছুরিকাঘাতে দুই আনসার সদস্য আহত হন। ডাকাতির এসব ‘আইডিয়া’ সে সিনেমাটি দেখেই রপ্ত করেছে বলে জানায়।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, অবাধ আকাশ সাংস্কৃতির মাধ্যমে বাংলাদেশে ঢালাওভাবে ভারতীয় সাংস্কৃতি প্রবেশ করছে। ভারতীয় সিনেমা, নাটক ও কিছু সিরিয়াল আমাদের দেশের সাংস্কৃতির সাথে যায় না। মানুষ সাধারণ খারাপের দিকে আকৃষ্ট হয় বেশি। তাই ভারতীয় নাটক, সিনেমা ও সিরিয়ালের বিষয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে মনিটরিং করা উচিত। আমরা ভালটা গ্রহণ করবো এবং যেটা ভাল নয় সেটা নিয়ন্ত্রণ করবো। অন্যতায় এ ধরনের সিরিয়াল দেখে দেশের কিছু মানুষ বিপদগামী হবে। রাষ্ট্রকে এজন্য দ্রæত ভাবতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিবি) একেএম হাফিজ আক্তার বলেন, হিন্দি সিনেমা, সিরিয়াল, ইউটিউব দেখে নকল বোমা বানানো এবং সন্ত্রাসী পরিচয়ে হুমকি-ধমকি দেয়ার কৌশল শিখছে অপরাধীরা। স¤প্রতি রাজধানীতে বিভিন্ন শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামে চাঁদা দাবি করার মতো ঘটনা ঘটছে। যদিও দেশে শীর্ষ সন্ত্রাসী বলে আলাদা কোনও শ্রেণি নেই। কেউ যদি এমন ঘটনার শিকার হন তাদের উচিত দ্রুত পুলিশকে জানানো।
সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি ইমাম হোসেন বলেন, ডাকাত চক্রটি গত কয়েক বছর ধরে ঢাকার আশপাশের জেলাগুলোতে প্রবাসীদের বাসা-বাড়িতে অভিনব কৌশলে ডাকাতি করে আসছিল। এই চক্রের সদস্যরা একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য মোবাইল সিমেরপরিবর্তে বিভিন্ন আ্যপস ব্যবহার করত। এছাড়া তারা বাসা-বাড়ির গ্রীল ও জানালা কেটে মুখে মাস্ক ও হাতে গøাভস পরে ঘরে ঢুকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ভয়ভীতি দেখিয়ে ডাকাতি করত। ডাকাতির কোনো ছাপ যাতে না থাকে মূলত সেজন্যই তারা ভারতীয় সিরিয়াল সিআইডি দেখে মাস্ক ও গøাভস ব্যবহার করত।

তিনি বলেন, ঢাকার দোহার, কেরানীগঞ্জ ও নবাবগঞ্জের অনেকেই প্রবাসে থাকে। মূলত প্রবাসীদের বাড়ি টার্গেট করে ডাকাতি করত তারা। যাতে টাকা, স্বর্ণালংকার ও ডলার পাওয়া যায়। গ্রেফতার হওয়া রুবেল ফরাজী ওরফে রিফাত হাওলাদারের বিরুদ্ধে রংপুরের বিভিন্ন থানায় সাতটি মামলা রয়েছে। সোহাগ শেখ ওরফে রুবেল ঝালকাঠিতে অস্ত্র আইনে মামলায় ১০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত আসামি এবং সোহেলের বিরুদ্ধে খুলনা, যশোর ও মৌলভীবাজারের বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। এই চক্রের একজন মূলহোতা রয়েছে। সে অনেক চতুর। কবে, কোথায়, কোন বাসায় ডাকাতি করতে হবে তিনিই মূলত নেতৃত্ব দিতেন। যাকে এখনও আমরা গ্রেফতার করতে পারিনি। তবে তাকে গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

সিআইডির একজন কর্মকর্তা জানান, গত ৪ মার্চ রাত ৩টার দিকে সাত-আটজন ডাকাত কেরানীগঞ্জের রামেরকান্দা গ্রামে শাহবুদ্দিন ওরফে সাহার বাড়ির জানালার গ্রিল কেটে ভেতরে প্রবেশ করে। সেখানে ধারালো চাপাতি ও দায়ের ভয় দেখিয়ে ১১ লাখ টাকা, ৩০০ ইউএস ডলার ও ৩৩ ভরি স্বর্ণালংকার লুট করে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় মামলা হয়। ওই মামলার তদন্ত করতে গিয়ে গত ৩০ মার্চ ডাকাত চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। এ চক্রের মূলহোতাসহ বাকি সদস্যদেরকেও গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত বছর ১৫ ডিসেম্বর ব্যাংক ডাকাতির মামলায় পুলিশ গ্রেফতার করে অপরাধী চক্রের মূল পরিকল্পনাকারী সাফাতুজ্জামান রাসেলকে। সে সময় তিনি পুলিশের কাছে জানান, ভারতীয় সনি টিভির সিরিয়াল ক্রাইম পেট্রল দেখে এই চারজন ব্যাংক লুটে উদ্বুদ্ধ হন। সে অনুযায়ী তারা প্রশিক্ষণ নেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী অনলাইন মার্কেট প্লেস থেকে সংগ্রহ করে খেলনা পিস্তল। ডাকাতি শেষে দলনেতা রাসেল দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গা ঢাকা দেয়। পরে জীবননগর উপজেলার দেহাটি গ্রাম থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়।

মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, যেহেতু বাংলাদেশের শিক্ষিত-অশিক্ষিত অনেক মানুষ এখন মন্ত্রমুগ্ধের মতো টিভি সেটের সামনে রিমোট হাতে বসে ভারতীয় হিন্দী, বাংলা সিরিয়াল দেখতে থাকেন, তাই একই বিষয় বারবার দেখতে দেখতে তাদের মনোজগতে বিষয়গুলো এমনভাবে গেঁথে যায় যে, তারা নিজেদের অজান্তেই অর্থাৎ নারীদের অবচেতন মনেই বিষয়গুলো নিজ দায়িত্বে জায়গা করে নেয়। এবং তারা এগুলোকে যাপিত জীবনে ব্যবহার করে (যদিও খুব একটা সচেতন জায়গা থেকে নয়)।

তারা বলছেন, ভারতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এতই প্রকট আকার ধারণ করেছে যে, কোন প্রতিষেধকই এখন আর কাজ করছে না। অভিজাত শ্রেণী থেকে শুরু করে একেবারেই উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত পরিবার, বয়স্ক থেকে শিশু পর্যন্ত সবাই এই মহাব্যাধিতে নিমজ্জিত। আমাদের বাচ্চারা এখন মায়ের ভাষা বাংলা শিখার আগেই হিন্দিতে কথা বলা রপ্ত করে ফেলছে। আর এটি হচ্ছে ভারতীয় চ্যানেলগুলোর কারণে। এখনকার নারীদের আড্ডা কিংবা বৈঠকের অন্যতম বিষয় হয়ে উঠেছে অমুক চ্যানেলে অমুক সিরিয়ালের আলাপন। স্টার প্লাস, স্টার জলসা, জি বাংলাসহ একাধিক চ্যানেল রয়েছে, যেগুলোর মোহে মজেছে আমাদের দেশের নারী সমাজ।

ভারতীয় সিরিয়ালের বেশির ভাগ অংশ জুড়ে থাকে বৌ-শাশুড়ি, কিংবা ননদ-ভাবি অথবা জা-জায়ের মধ্যকার দ্ব›দ্ব, চুলোচুলি আর প্যাঁচ লাগিয়ে একে অপরের ঘর ভাঙ্গা কিংবা পারিবারিক অশান্তি সৃষ্টি। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যেটি, সেটি হল এসব সিরিয়ালে, দৃষ্টিকটু বেশ-ভূষা, পরকীয়া আর অবৈধ সম্পর্কগুলো থাকে অতি সাধারণ বিষয়। আর এসব দেখে তারাও ধাবিত হচ্ছে বাংলাদেশের সংস্কৃতির বিপরীত ধারায়। তাই যার যার অবস্থান থেকে দীঘর্মেয়াদী ক্ষতিকর মানসিকতার ভারতীয় নাটক পরিহার করে দেশীয় সংস্কৃতির লালন ও বিকাশে এগিয়ে আসা প্রয়োজন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভারত


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ