পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ ছিলেন উপমহাদেশের একজন স্বনামধন্য আইনবিদ, সেইসাথে তিনি ছিলেন একজন সংস্কৃতিবান ব্যক্তিত্ব। তিনি বিচারপতির আসনে থেকে সুযোগ সীমিত থাকা সত্তে¡ও নানা ধরনের রাজনৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব পালন করে সাধারণ মানুষের ভালোবাসা অর্জন করেছিলেন। মানবতাবাদী সমাজতিহৈষী, আইনের শাসন ও সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠার অন্যতম রূপকার এবং দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগতা ফোরাম ‘সার্ক’-এর অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোরশেদের আজ ৪২তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৭৯ সালের ৩ এপ্রিল তিনি ঢাকায় ইন্তেকাল করেন। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের ১১ জানুয়ারি কোলকাতার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে সৈয়দ মাহবুব মোরশেদের জন্ম।
এই উপমহাদেশে আইন পেশায় বাঙালি মুসলমানের প্রবেশ ঘটে অনেক বিলম্বে। অবিভক্ত বঙ্গে স্যার সৈয়দ আমীর আলী (৬ এপ্রিল ১৮৪৯Ñ৩ আগস্ট ১৯২৮) কোলকাতা হাইকোটের প্রথম মুসলমান বিচারপতি নিযুক্ত হন ১৮৯০ সালে। এরপর তাঁর পুত্র সৈয়দ তারিক আমীর আলীসহ আরও অনেক বাঙালি মুসলমান হাইকোর্টের বিচারপতি হন। সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ হাইকোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর। তৎকালীন হাইকোর্টে বিচারপতি হিসাবে তাঁর এই সম্মানজনক আসন গ্রহণের মধ্য দিয়ে তখনকার সমাজে বাঙালি মুসলমানদের জন্য উচ্চ আদালতসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের রুদ্ধ দ্বার উন্মোচিত হতে শুরু করে। এক্ষেত্রে বিচারপতি মোরশেদ ছিলেন সত্যিই এক অনন্য ব্যতিক্রম। তিনি ছিলেন তাঁর কর্মক্ষেত্রে যেমন, তেমনি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রের এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। সামাজিক দায়বদ্ধতার কারণে তাঁর কর্মক্ষেত্র ছিলো অনেক প্রসারিত। তাই তো, এক পর্যায়ে তিনি প্রধান বিচারপতির পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শামিল হতে দ্বিধাবোধ করেননি। বিচারপতি জীবনে তিনি অনেকগুলো জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ মামলার ঐতিহাসিক, সময়োপযোগী রায় দিয়ে স্বৈরশাসনের মধ্যেও আ্ইনের শাসন সমুন্নত রাখেন।
বাংলা-ইংরেজি ছাড়াও আরও কয়েকটি ভাষায় তাঁর দখল ও পান্ডিত্য ছিলো। আইন ছাড়াও তিনি সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনীতি বিষয়ে বহু প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন। অখন্ড পাকিস্তানে ও স্বাধীন বাংলাদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি আসামান্য ভূমিকা রেখে গেছেন। নির্ভেজাল গণতন্ত্রের পক্ষে তিনি ছিলেন একজন অবিচল প্রবক্তা। সর্বোপরি, তাঁর আবর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ও বৈদগ্ধ সকল প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা ও উজ্জ্বলতাকেও অতিক্রম করেছে।
জন্ম ও পরিবার : পািরবারিক সূত্রমতে, হযরত ইমাম হোসেনের বংশধরদের একজন, মুফতি সৈয়দ আলী রাশেদ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পনির আমলের প্রথম দিকে সদর দেওয়ানি আদালতের বিচারক ছিলেন। তিনি তাঁদের পূর্বপুরুষদের একজন। মাহবুব মোরশেদের পিতা সৈয়দ আবদুস সালেকও একজন সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে তিনি যোগ দেন বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর হিসাবে তিনি বগুড়া, দিনাজপুর প্রভৃতি জেলায় নিযুক্ত ছিলেন। একজন ধর্মপ্রাণ, সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তা হিসাবে তাঁর খ্যাতি ছিলো। মাহবুব মোরশেদের মা আফজালুন্নেসা বেগম ছিলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের বোন। মাতামহ কাজী ওয়াজেদ আলী ছিলেন উপমহাদেশের প্রথম মুসলমান আইন গ্রাজুয়েট প্রখ্যাত সমাজ-সংস্কারক নবাব আবদুল লতিফের জ্ঞাতি ভাই। ১৯৩৯ সালের ১ অক্টোবর কোলকাতার মেয়র একেএম জাকারিয়ার কন্যা লায়লা আরজুমান্দ বানুর সঙ্গে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন মাহবুব মোরশেদ। শিক্ষা : শিক্ষাজীবনে মাহবুব মোরশেদ একজন কৃতী ছাত্র ছিলেন। স্কুলের প্রতিটি শ্রেণিতে তিনি প্রথম হন। ১৯২৬ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় তিনি বগুড়া জিলা স্কুল থেকে সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়ে প্রথম হয়েছিলেন। প্রবেশিকা পাসের পর তিনি কোলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই ১৯৩১ সালে অর্থনীতিতে সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ এবং প্রথম শ্রেণিতে এলএলবি ডিগ্রি নেন যথাক্রমে ১৯৩২ ও ১৯৩৩ সালে। কলেজজীবনে তিনি সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায়ও সম্পৃৃক্ত হন। প্রেসিডেন্সি কলেজ-ম্যাগাজিনের তিনি সম্পাদকও ছিলেন একবার। একই সময়ে তিনি তুখোড় বক্তা হিসাবেও খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি কোলকাতা বিশ^বিদ্যালয়ের বিতর্ক দলের নেতৃত্বও দিয়েছেন। কলেজজীবনে তিনি ক্রীড়াক্ষেত্রেও সুনাম অর্জন করেন। ৩০-এর দশকে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সংগঠকের দায়িত্বও পালন করেন। সেকালে মুসলমান তরুণদের মধ্যে খেলাধুলায় অংশগ্রহণে এক ধরনের অনীহা ও অবহেলা ছিলো, তরুণ মাহবুব মোরশেদ সেই নেতিবাচক অবস্থা দূরীকরণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
আইন পেশায়: মাহবুব মোরশেদ কোলকাতা হাইকোর্টে অইনজীবী হিশাবে কাজ শুরু করেনে ১৯৩৪ সালে। তবে তিনি মামা ফজলুল হকের সহকারী না হয়ে সুভাষ চন্দ্রের অগ্রজ শরৎচন্দ্র বসু (১৮৮৯-১৯৫০) এবং খ্যাতনামা অবাঙালি আইনজীবী কে বি খাইতানের জুনিয়র হয়ে কাজ করার দুর্লভ সুযোগ লাভ করেন। এর অল্প কিছু দিনের মধ্যেই তিনি আইনে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের জন্য যুক্তরাজ্য যান। ১৯৩৮ সালে তিনি লন্ডনের বিখ্যাত লিংকন’স ইন থেকে বার অ্য্যট ল’ (ব্যারিস্টার) ডিগ্রি লাভ করেন। দেশে ফিরে তিনি আবার আইন পেশায় আত্মনিয়োগ করেন এবং ১৯৫১ সালে ঢাকা হাইকোর্ট বার-এ যোগ দেন। ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকা বারে প্র্যাকটিস করেন। ভাষা আন্দোলন, ৫৪’র নির্বাচন, যুক্তফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠা এবং শেরে বাংলার নেতৃত্বে গঠিত সেই সরকারের কেন্দ্র কর্তৃক বরখাস্ত হওয়া, রাজনৈতিক নেতাদের উপর নানামুখী নির্যাতন ইত্যাদি ঘটনায় সময়টা ছিলো উত্তাল। এসব ঘটনা নিয়ে তিনিও সচেতন ছিলেন এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলেনে নিজেকে ইতিবাচকভাবে সম্পৃক্ত রেখেছিলেন। ১৯৫৫ সালে, যখন মোহাম্মদ আলী (বগুড়া) পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আইনমন্ত্রী, তখন সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের বিচারক হিসাবে যোগ দেন। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংসদীয় গণতন্ত্রের বিধান সংবলিত শাসনতন্ত্র প্রণয়নে যাঁরা সোহরাওয়ার্দীকে সাহায্য করেন, মাহবুব মোরশেদ ছিলেন তাঁদেরই একজন।
বিচারপতিরূপে: মাহবুব মোরশেদ ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হন ১৯৫৫ সালের জানুয়ারি মাসে। দেশে তখন হক-ভাসানীর যুক্তফ্রন্ট সরকার। পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের নানামুখী ষড়যন্ত্র চলছে। এই সময়ে শেরে বাংলা একে ফজলুল হকও কিছুদিন পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের আইনমন্ত্রী ছিলেন। তিনি আইনের শাসনের অবিচল প্রবক্তা ছিলেন।
১৯৫৮-এর অক্টোবরে জেনারেল আইয়ুব খান রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। সংসদীয় গণতন্ত্রের শাসনব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে যায়। মানুষের সব মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়। তখন বিচারপতির আসনে থেকে সৈয়দ মাহবুব মোরশেদকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলা নিষ্পত্তি করতে হয়েছে। এর মধ্যে অনেক মামলা ছিলো তৎকালিন প্রতাপশালী সরকারের বিরুদ্ধে। মরহুম বিচারপতি আবদুর রহমান চৌধুরীর মতে, বিচারপতি মোরশেদের অনেকগুলো রায় ছিলো ইতিহাসের মাইলফলক, দেশের সাংবিধানিক আইনের ম্যাগনাকার্টা স্বরূপ। একবার (১৯৬৪) পশ্চিমবঙ্গের দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়লো পূর্ব পাকিস্তানে। বিচারপতি মোরশেদ হাই কোর্ট থেকে সুয়োমোটো (স্বাপ্রণোদিত রুল) জারি করলেন, যার ফলে এদেশের সংখ্যালঘুদের উপর কোনো আঘাত আসতে পারেনি। বিচারপতি মোরশেদ কিছুকাল পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টেরও (আপলি বিভাগ) এডহক বিচারক ছিলেন। সেখানেও তিনি তাঁর কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। এর আগে, ১৯৪৩ সালে বেঙ্গল ফেমিন এবং ’৪৬-এর দাঙ্গার সময়ে তিনি আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম প্রতিষ্ঠার সঙ্গে যুক্ত থেকে অনেক মানবিক ও সমাজসেবামূলক কাজেও অংশ নিয়েছেন। ৪৭-এর দেশভাগের পর নেহরু-লিয়াকত চুক্তিতেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেলেন।
বিচারপতি মোরশেদ প্রধান বিচারপতি থাকা অবস্থায়ই প্রচন্ড সাহসিকতা ও গভীর দেশপ্রেমের পরিচয় দিয়েছেন। ১৯৬৬ তে তিনি ঐতিহাসিক ৬ দফার খসড়া প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, যে ৬ দফার কারণে শেখ মুজিবুর রহমানকে কারাবরণ করতে হয়। শুধু অর্থিৈনক বৈষম্যের কারণেই বিচারপতি মোরশেদ ৬ দফা প্রণয়নে সম্পৃক্ত হননি, ৬৫-এর যুদ্ধের পরে তিনি উপলব্ধি করেন যে, পূর্ববাংলার প্রতিরক্ষা-ব্যবস্থাও যথেষ্ট মজবুত ছিল না। এই বিষয়টিও গবীরভাবে তাঁর চিন্তার মধ্যে ছিলো।
১৯৬৯-এ আইয়ূবের গোলটেবিল বৈঠকে বিচারপতি মোরশেদ ওয়ান ম্যান ওয়ান ভোট দাবি করেছিলেন। তাঁর যুক্তি ছিলো, ওয়ান ইউনিট পাকিস্তান ভেঙে দেয়ার পরে জনসংখ্যার ভিত্তিতে পূর্ববাংলা ছিল সংখ্য্যাগরিষ্ঠ এবং এই অঞ্চলের ভোটেই পাকিস্তান গঠিত হয়। যে কারণে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৬৯টি আসন র্প্বূ বাংলার প্রাপ্য। সেই হিশাবে, এই অঞ্চলে যে দল বেশি আসন পাবে, সেই দলই কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের দাবিদার।
জানা যায়, ১৯৭১-এর ৮ মার্চ সুপ্রিম কোর্টের একদল আইনজীবী পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিশাবে টিক্কা খানের শপথ গ্রহণের বিষয়ে বিচারপতি মোরেেশদের কাছে পরামর্শ চাইলে তিনি দৃঢ়তার সাথে তখন বলেছিলেন, এই মুহূর্তে দেশে একটা সাংবিধানিক ভ্যাকুয়াম চলছে, এই পরিস্থিতিতে টিক্কা খানের শপথ গ্রহণ সমীচীন নয়।
১৯৭৭ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমাানের সাথে এক সাক্ষাতে বিচারপতি মোরশেদ তাঁকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে নিয়ে একটি আঞ্চলিক ফোরাম গঠনের জন্য পরামর্শ দেন এবং দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার তাগিদ দেন। ১৯৯৮ সালে ঢাকায় বিচারপতি মোরশেদেও এক স্মরণ সভায় তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব তবারক হোসেন এই তথ্য উল্লেখ করেন।
লেখক: কবি, শিশুসাহিত্যিক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।