পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
অর্থনৈতিক দিক দিয়ে মৎস্য সেক্টর সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ও গুরুত্বপূর্ণ। মৎস্য সেক্টর দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা, প্রাণীজ আমিষ সরবরাহ, দারিদ্র্য দূরীকরণ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। প্রতিবছরই দৃশ্যমান হচ্ছে এ সেক্টরের ক্রমবর্ধমান সাফল্য। দেশের মোট জিডিপির ৩.৫০ শতাংশ এবং কৃষিজ জিডিপির ২৫.৭২ শতাংশ মৎস্য সেক্টরের অবদান। মোট জনসংখ্যার ১২ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মৎস্য সেক্টরের উপর নির্ভরশীল। মৎস্য সেক্টরের গুরুত্ব বৃদ্ধির কারণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ে ফিশারিজ অনুষদ বা বিভাগ খোলা হচ্ছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে দেশের কৃষি তথা মৎস্যখাতকে আরও সমৃদ্ধ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে ২০১৯ সালে ৫ম কৃষি বিশ^বিদ্যালয় হিসেবে খুলনা কৃষি বিশ^বিদ্যালয় যাত্রা শুরু করে। দক্ষিণবঙ্গের মৎস্য সেক্টরকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দ্বিতীয় বছর ফিশারিজ এন্ড ওশান সায়েন্সেস অনুষদ খোলা হয়। এ অনুষদে মোট ৬টি বিভাগ রয়েছে, যথা: ফিশারি বায়োলজি এন্ড জেনেটিক্স; একোয়াকালচার; ফিশারি রিসোর্সেস কনজারভেশন এন্ড ম্যানেজমেন্ট; ফিশারিজ টেকনোলজি এন্ড কোয়ালিটি কন্ট্রোল; ওশানোগ্রাফি এবং ফিশ হেলথ ম্যানেজমেন্ট।
প্রাচীনকাল থেকেই প্রাকৃতিকভাবে খুলনা অঞ্চল মৎস্য সম্পদে ভরপুর ছিল। মৎস্য বিভাগের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে ফিশারিজ ও একোয়াকালচার থেকে মাছ উৎপাদনে খুলনা বিভাগ শীর্ষে রয়েছে। এ অঞ্চলে মৎস্যসম্পদ আধিক্যের কারণ হল ফিশারিজের বিভিন্ন রিসোর্সসমূহ, যেমন: বঙ্গোপসাগর, সুন্দরবন, বিভিন্ন নদ-নদী ও মোহনা, বিল, বাওর এবং চিংড়ি ও মাছের ঘের। একোয়াকালচারের বিভিন্ন পদ্ধতিতে যশোর, খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা অঞ্চলে চিংড়ির পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে সাদামাছ, কাঁকড়া, কুচিয়া, প্রভৃতি প্রজাতির চাষ ও ফ্যাটেনিং হচ্ছে। এ অঞ্চলে গড়ে উঠেছে চিংড়ি ও সাদামাছের হ্যাচারি, ফিশ প্রসেসিং প্লান্ট ও মাছের খাদ্য কারখানা। বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানিকারক মৎস্যপণ্য হিমায়িত চিংড়ি, যার সিংহভাগ উৎপাদিত হয় বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলে। অতএব, এ অঞ্চলে খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় মৎস্য সেক্টরে গবেষণার নতুন ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশের একমাত্র মেরিন প্রোটেকটেড এরিয়া ‘সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড’ খুলনা অঞ্চলের সুন্দরবনের দক্ষিণ পাশের্^ অবস্থিত। মোট ১৭৩৮ বর্গ কিলোমিটার ও ৯০০ মিটার গড় গভীরতা সম্পন্ন এ অঞ্চলটি ডলফিন, তিমি, হাঙর ও সামুদ্রিক কচ্ছপসহ বেশ কিছু প্রজাতির ফিডিং ও ব্রিডিং গ্রাউন্ড হিসেবে পরিচিত। সুষ্ঠু পরিকল্পনা, গবেষণা ও ব্যবস্থাপনার অভাবে ফিশারিজ রিসোর্সে ভরপুর এ অঞ্চলটি ক্রমেই তার জৌলুস হারিয়ে ফেলছে। সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ বৃদ্ধি ও ভালনারেবল প্রজাতি টিকিয়ে রাখার জন্য এখানে ব্যাপক পরিসরে গবেষণা দরকার। বাংলাদেশ ২০১২ ও ২০১৪ সালে যথাক্রমে মায়ানমার ও ভারতের কাছ থেকে বঙ্গোপসাগরে ১,১৮,৮১৩ বর্গ কিলোমিটার সমুদ্র বিজয় করে, যার বড় একটি অংশ খুলনা বিভাগে অবস্থিত। সমুদ্র বিজয়ের পর ‘ব্লূ-ইকোনমি’ বা সমুদ্রের সুনীল অর্থনীতি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয় ও বিস্তার লাভ করে। বাংলাদেশের পরিকল্পনা কমিশন সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ব্যাপক গুরুত্বের সাথে ‘ব্লু-ইকোনমি’কে অন্তর্ভুক্ত করে। যেহেতু ‘ভ।ব্লু-ইকোনমি’র অন্যতম প্রধান কমপোনেন্ট হচ্ছে মেরিন ফিশারিজ ও একোয়াকালচার, সুতরাং সঠিক গবেষণার মাধ্যমে টেকসই পন্থায় মৎস্য আহরণ ও উৎপাদনের ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। ‘ব্লু-ইকোনোমি’ সংশ্লিষ্ট গবেষণায় খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওশানোগ্রাফি, ও ফিশারি রিসোর্সেস কনজারভেশন এন্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগের গবেষণা কাজে নেতৃত্ব দেয়ার সুযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশে একোয়াকালচারের বিভিন্ন শাখায় গবেষণা হলেও মেরিকালচার নিয়ে বিশদ কোন গবেষণা পরিচালিত হয়নি। ফলে, বঙ্গোপসাগরের বিশাল জলরাশি সামুদ্রিক মৎস্য আহরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে, যেখানে মেরিকালচারের বিশাল ফিল্ড অব্যবহৃত রয়ে গেছে। অথচ এখানে মেরিকালচারের মাধ্যমে বাণিজ্যিক চাহিদাসম্পন্ন মৎস্য প্রজাতি যেমন: কোরাল, পারশে, রূপচান্দা, ইত্যাদি মাছচাষ করে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ করে বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব। এছাড়া অপ্রচলিত বিভিন্ন প্রজাতি, যেমন: সি-উইড, সামুদ্রিক শামুক, ঝিনুক, অক্টোপাস, প্রভৃতি একোয়াটিক ফ্লোরা ও ফনা চাষ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে গবেষণা ও জ্ঞান সৃষ্টিতে বিশ^বিদ্যালয়ের একোয়াকালচার বিভাগ অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে।
বর্তমানে বাংলাদেশের খুলনা অঞ্চলের চিংড়ি ইউরোপ-আমেরিকাসহ উন্নত সকল দেশে রপ্তানি হচ্ছে। চিংড়ি ঘের, হ্যাচারি, খাদ্য মিল, প্রসেসিং ফ্যাক্টরি, প্রভৃতি সরকারিভাবে নিবন্ধন করা হয়েছে। ঘেরে ট্রেসেবিলিটি এবং প্রসেসিং ফ্যাক্টরিগুলোতে হ্যাচাপ সিস্টেমের উপর ব্যাপক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কিন্তু চিংড়ির পাশাপাশি খুলনাসহ বাংলাদেশে বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণ সাদামাছ উৎপাদিত হয়, যেমন: পাঙ্গাস, তেলাপিয়া ও বিভিন্ন কার্পজাতীয় মাছ। এসব মাছ বিশেষ করে পাঙ্গাস ও তেলাপিয়া হচ্ছে উচ্চমানের রপ্তানিযোগ্য মাছ, কিন্তু বাংলাদেশ এখনও এসব মাছ বাণিজ্যিক স্কেলে রপ্তানি করতে পারছে না। তবে এশিয়ার কয়েকটি দেশ, যেমন: ভিয়েতনাম, চীন ও ইন্দোনেশিয়া এসব মাছ আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে। বাংলাদেশ এসব মাছ রপ্তানি করতে না পারার অন্যতম কারণ হচ্ছে বিশ^াসযোগ্য সার্টিফিকেশন স্কিম, ট্রেসেবিলিটি ও খামারগুলো সরকারিভাবে নিবন্ধিত না থাকার কারণে। যেহেতু এ অঞ্চলের মৎস্যচাষিসহ অন্যান্য স্টেকহোল্ডররা সার্টিফিকেশন স্কিম, ট্রেসেবিলিটি, হ্যাচাপ, খামার নিবন্ধন, প্রভৃতি বিষয়গুলোর সাথে পরিচিত, সুতরাং তাদেরকে সঠিকভাবে পরিচালনা ও পৃষ্ঠপোষকতা করতে পারলে আগামী দিনে বাংলাদেশ চিংড়ির পাশাপাশি পাঙ্গাস ও তেলাপিয়া রপ্তানি করতে পারবে। এ বিষয়টি নিয়ে সীমিত পরিসরে কিছু গবেষণা হলেও বৃহৎ পরিসরে গবেষণার ব্যাপক সুযোগ রয়েছে, এখানেও বিশ^বিদ্যালয়ের একোয়াকালচার বিভাগের ব্যাপক গবেষণার সুযোগ রয়েছে।
বর্তমানে একোয়াকালচার তথা মাছচাষের অন্যতম প্রধান অন্তরায় হচ্ছে চিংড়ি ও মাছের রোগ। এক্ষেত্রে চিংড়ির প্রচলিত রোগগুলো হচ্ছে হোয়াইট স্পট সিন্ড্রম ভাইরাস, চিংড়ির কালো ফুলকা রোগ, চিংড়ির মস্তক হলুদ রোগ, প্রভৃতি। চিংড়ির এসব রোগে মোড়কের ফলে চাষিরা ব্যাপকভাাবে আর্থিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শুধু হোয়াইট স্পট সিন্ড্রম ভাইরাসের কারণে বাংলাদেশে চিংড়ি চাষিদের হেক্টর প্রতি ক্ষতির পরিমাণ দাড়ায় ৭০০০০-৩৩০০০০ টাকা। রোগ-বালাই ও মোড়কের কারণে রপ্তানি নির্ভর এ পণ্যটির চাষ ও উৎপাদন ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। সাদা মাছেও রোগ-বালাই এর সমস্যা ক্রমান্বয়ে প্রকট হচ্ছে। চাষযোগ্য মাছ, বিশেষকরে শিং, মাগুর, গুলশা, পাবদা, কৈ, পাঙ্গাস, তেলাপিয়া, কার্পজাতীয় মাছসহ প্রায় সকল প্রজাতি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। এছাড়া মাছ রোগাক্রান্ত হওয়ায় চিকিৎসাবাবদ উৎপাদন খরচও বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার পরিমাণ এখন প্রায় হেক্টর প্রতি বাৎসরিক ৬৫০০-৩২০০০ টাকা। এজন্য মাছের রোগ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা, প্রভৃতি বিষয়গুলো নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশ হেলথ ম্যানেজমেন্ট বিভাগ সময়োপযোগী গবেষণাগার স্থাপনের মাধ্যমে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারে।
বাংলাদেশের ইউনিক ম্যানগ্রোভ বনভ‚মি সুন্দরবন মূলত খুলনা অঞ্চলে বিদ্যমান। এ বনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে অসংখ্য নদ-নদী ও কিছু খাল, পাশাপশি বেশ কয়েকটি নদীর মোহনা এখানে বিদ্যমান। প্রাকৃতিকভাবেই সুন্দরবন মাছসহ বিভিন্ন জলজ প্রজাতির আবাসস্থল। এখনও বেশ কয়েকটি মাছ ও কিছু জলজ প্রজাতি শুধুমাত্র সন্দরবনেই পাওয়া যায়। সুষ্ঠু ম্যানেজমেন্ট ও কনজারভেশনের অভাবে এসব প্রজাতি আজ হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। বাংলাদেশের বড়-বড় কিছু বিল (ডাকাতিয়া বিল) ও বাওড় (ভবদহ, বুকভরা, ঝাপা, পুরাখালি) খুলনা-যশোর অঞ্চলে বিদ্যমান। সুষ্ঠু ম্যানেজমেন্ট, পরিকল্পনা, গবেষণা ও ব্যবহারের অভাবে হেক্টর প্রতি এসব বিল/বাওরে মাছের উৎপাদন খুবই কম। খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারি রিসোর্সেস কনজারভেশন এন্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগ বিভিন্ন গবেষণা পরিচালনা করে এসব জলাভ‚মিতে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিতে ব্যাপক সাড়া ফেলতে পারেবে।
ময়মনসিংহ অঞ্চলে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সে অঞ্চলে কৃষির ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। মৎস্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী জেলা-ভিত্তিক একোয়াকালচার থেকে মাছ উৎপাদনে ময়মনসিংহ আজ এক নম্বর স্থান অর্জন করেছে। ভবিষ্যতে খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ এন্ড ওশান সায়েন্সেস অনুষদ দক্ষ গ্রাজুয়েট তৈরিসহ শিক্ষা ও গবেষণায় অবদানের মাধ্যমে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে মাছ উৎপাদনসহ কৃষিক্ষেত্রে বিপ্লব সাধন করার অপার সম্ভাবনা রয়েছে।
লেখক: লেকচারার ও বিভাগীয় প্রধান, ফিশারি রিসোর্সেস কনজারভেশন অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ফিশারিজ এন্ড ওশান সায়েন্সেস অনুষদ, খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।