পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আজ ২৬ মার্চ, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্ণ হলো। সরকার ৫০ বছর বা সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে এবং পালন করছে। একটি দেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্ণ করা কম কথা নয়। স্বাধীনতা লাভ করে অন্যান্য আগ্রাসী শক্তি থেকে মুক্ত থেকে আত্মমর্যাদামীল জাতি হিসেবে পথ চলা সহজ নয়। বিশ্বে নজির রয়েছে, বিভিন্ন দেশ স্বাধীনভাবে চলতে চলতে আগ্রাসী শক্তির কবলে পড়ে পথ হারিয়ে বিলীন হয়ে গেছে অথবা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ জীবন দিয়ে লড়াই করে যে স্বাধীনতা লাভ করেছে, তা পথ হারায়নি। ধরে রাখতে পেরেছে। এ কৃতিত্ব জনগণ ও বিভিন্ন সময়ে যারা দেশ পরিচালনা করেছে, তাদের। নানা দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও দেশ স্বাধীনতা ধরে রেখে এগিয়ে যাচ্ছে। আভ্যন্তরীণ রাজনীতির নানা ঘাত-প্রতিঘাত, অভিঘাত এবং বিরূপ প্রাকৃতিক ঝড়-ঝঞ্ঝা মোকাবেলা করে পঞ্চাশ বছরের পথ অতিক্রম করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, পঞ্চাশ বছরে স্বাধীনতার মূলমন্ত্র গণতন্ত্র, সমতা, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে আমরা কতটুকু অগ্রসর হতে পেরেছি বা পারছি? রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতিতে দেশ কতটুকু এগিয়েছে? অস্বীকার করার উপায় নেই, পঞ্চাশ বছরের পথ পরিক্রমায় বিশ্বে বাংলাদেশের একটি সুদৃঢ় ও উজ্জ্বল অবস্থান সৃষ্টি হয়েছে। স্বাধীনতা পূর্ব, মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং স্বাধীনতা লাভের পরপরের বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশ এক নয়। সামগ্রিক অর্থনীতি অনেক দূর এগিয়েছে। জিডিপি, মাথাপিছু আয়, প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবেলায় সক্ষমতা অর্জন, কৃষি বিপ্লব, শিল্প-কারখানার প্রসার, স্বাস্থ্য-শিক্ষা, তথ্য ও প্রযুক্তি খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। ইতোমধ্যে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়া এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে স্বাধীনতার অন্যতম আকাক্সক্ষা গণতন্ত্র, সুরাজনীতি, সমতাভিত্তিক উন্নয়ন, সুশাসন, মানবাধিকার, ন্যায়বিচারের বিষয়গুলো নিয়ে তর্ক-বিতর্ক এবং প্রশ্ন রয়েছে।
দুই.
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে দাঁড়িয়ে আমরা যদি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতির চিত্রটির দিকে দৃষ্টি দেই তাহলে দেখব, আমাদের অনেক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। ১৯৭২ সালের ৩০ জুন যখন প্রথম বাজেট দেয়া হয়, তখন এর আকার ছিল মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকা। জিডিপি ছিল মাইনাসে (-১৪.০ শতাংশ)। বর্তমানে বাংলাদেশের বাজেট ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা (২০২০-২১)। জিডিপি গড় ৬.৮ শতাংশ (করোনায় বিধ্বস্ত হওয়া অর্থনীতির মধ্যে)। দেখা যাচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বিধ্বস্ত অর্থনৈতিক চিত্র থেকে বাংলাদেশ বের হয়ে একটি শক্ত অর্থনৈতিক অবস্থানে দাঁড়িয়েছে। অথচ সে সময় বিশ্বের কোনো দেশই আশা করেনি, বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে এতটা শক্তিশালী অবস্থানে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার এক কথায় বাংলাদেশকে উড়িয়েই দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘বটমলেস বাস্কেট’। তার ধারণা ছিল, দেশটি কখনোই অর্থনৈতিকভাবে শক্ত অবস্থানে দাঁড়াতে পারবে না। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, বন্যা, ঝড়-ঝঞ্ঝার এ দেশ প্রান্তিক পর্যায়েই থেকে যাবে। সে সময়ের সামগ্রিক অর্থনৈতিক বাস্তবতায় তার এ ধারণা অমূলক ছিল না। তবে এদেশের মানুষ শত প্রতিকূলতার মধ্যেও যে টিকে থাকতে পারে এবং এগিয়ে যেতে পারে, এ দিকটি হয়তো কিসিঞ্জারের জানা ছিল না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে ফিরে নিপীড়িত-নির্যাতিত, ক্ষুধা-দারিদ্র্যে জর্জড়িত মানুষের খাদ্যসংস্থান এবং অর্থনীতি বিনির্মাণে সীমিত সামর্থ্যরে মধ্যেই নিরন্তর প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন। তিনি সাড়ে সাত কোটি মানুষের ভাগ্য ফেরাতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেন। জাতির পিতা হিসেবে জাতির ভাগ্য অন্বেষণে এমন কোনো পথ নেই যা তিনি অবলম্বন করেননি। দুঃখের বিষয়, যে আশা-আকাক্সক্ষা নিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছিল, তাতেও একটি বিরোধী শ্রেণী সক্রিয় ছিল। বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক কর্মকাÐ বাধাগ্রস্থ ও প্রশ্নবিদ্ধ করতে উঠেপড়ে লেগেছিল। এ নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে ক্ষোভ ও দুঃখ নিয়ে বলতে হয়েছে, ‘বিদেশ থেকে আমি ভিক্ষা করে আনি, আর চাটার দল তা খেয়ে ফেলে।’ ‘সবাই পায় সোনার খনি, আমি পেয়েছি চোরের খনি।’ ‘সাড়ে সাত কোটি কম্বলের মধ্যে আমার কম্বল কোথায়?’ এই ‘চাটার দল’ এবং ‘চোরের খনি’র কারণে সে সময় দেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। ফলাফল হিসেবে ’৭৪ সালে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। দেশের এই দুর্দশার মধ্যেই দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের কবলে পড়ে বিপথগামী সেনাসদস্যদের দ্বারা তিনি স্বপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার শিকার হন। দেশ হারায় স্বাধীনতার রূপকার ও হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী এক মহানায়ককে। দেশ এক টালমাটাল এবং ঝঞ্ঝা-বিক্ষুদ্ধ অবস্থার মধ্যে পড়লেও দিশা হারায়নি। অস্বীকার করার উপায় নেই, সাবেক প্রেসিডেন্ট ও সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমানের ক্ষমতায় আসা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক থাকলেও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে তার ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি লাভে তিনি নিরলস কাজ করেন। দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী করতে ১৯ দফা কর্মসূচি, সবুজ বিপ্লব, খাল কাটা কর্মসূচিসহ কৃষি উন্নয়নে তার বিভিন্ন উদ্যোগ এবং শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠা ও জনশক্তি রফতানির মতো স্থায়ী অর্থনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। আজ বাংলাদেশের প্রধান রফতানি খাত গার্মেন্ট শিল্পের যে ভিত্তি, তা তার শাসনামলেই শুরু হয়েছিল। বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম প্রধান জনশক্তি রফতানি তার আমলেই প্রথম শুরু হয়েছিল। দেশকে এগিয়ে নেয়ার তার এই কর্মযজ্ঞের মধ্যেই তিনি এক সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নিহত হন। ক্ষমতার পট পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ নয় বছর স্বৈরশাসন চললেও দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড থেমে থাকেনি। যেভাবেই হোক, তা এগিয়েছে। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরশাসনের অবসান এবং গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি বেগবান হতে থাকে। এ কথা স্বীকার করতে হবে, স্বাধীনতার পর যে সরকারই ক্ষমতায় এসেছে, তার শাসন প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হলেও অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রচেষ্টা থেমে থাকেনি। কম হোক, বেশি হোক উন্নয়নের পথে এগিয়ে গেছে। দেশের অর্থনীতির আজকের যে অবস্থান তা স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে যত সরকার এসেছে, তাদের প্রত্যেকেরই কম-বেশি ভূমিকা রয়েছে। তবে বিগত প্রায় একযুগ ধরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় অর্থনীতি গতি পেয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রশংসা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ করছে। উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবেও আখ্যায়িত করা হচ্ছে। জিডিপি, মাথাপিছু আয়, গড় আয়ু বৃদ্ধি, কৃষিতে অভাবনীয় সাফল্য, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার মতো উচ্ছ্বাসমূলক ঘটনা এই একযুগে ঘটেছে। এছাড়া মাছ ও শাক-সবজি উৎপাদনে বিশ্বে প্রথম সারিতে রয়েছে। পশুপালনেও ব্যাপক সাফল্য এসেছে। পদ্মাসেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলি টানেল, রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা বন্দর এবং একশ’ অর্থনৈতিক অঞ্চল বাস্তবায়নের মতো বড় প্রকল্পের কাজ চলছে। এসব উন্নয়ন নিয়ে নানা সমালোচনা হলেও সামগ্রিক উন্নয়নচিত্রটি যে ইতিবাচক তা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে এই উন্নয়ন স্বাধীনতা পরবর্তী শূন্য বা মাইনাস থেকে শুরু হয়নি। এ সরকারের পূর্বের সরকারগুলোর কম-বেশি গড়ে দেয়া অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েই হয়েছে। এ কথাও বলা প্রয়োজন, উন্নয়ন করতে গিয়ে ব্যাপক দুর্নীতির ঘটনাও ঘটছে। ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট, শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে লাখ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে এবং হচ্ছে। ওয়াশিংটন ভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছর প্রায় পাঁচ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। বলা যায়, দেশের এক বছরের বাজেটের সমান অর্থ পাচার হয়ে গেছে। পাচারকারিরা মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম এবং কানাডায় বেগম পাড়া গড়ে তুলেছে। সিঙ্গাপুর, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, হংকং, থাইল্যান্ড, আরব আমিরাতের মতো দেশে বাড়ি-ঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। দেখা যাচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর সময়ের লুটেরা চক্র এ সময়ে আরও সক্রিয় এবং প্রতাপশালী হয়ে উঠেছে। অর্থনীতি যত শক্তিশালী হচ্ছে, লুটেরা চক্রও বিপুল অর্থ লুটপাট করছে। এই অর্থ যদি দেশে বিনিয়োগ হতো, তাহলে দেশের অর্থনীতি আরও বেগবান হতো। বলা যায়, উন্নয়ন যত গতি পেয়েছে দুর্নীতিও এগিয়েছে তার সমান তালে। এর ফলে আয় বৈষম্য বেড়েছে, ধনী আরও ধনী হচ্ছে, গরিব আরও গরিব হচ্ছে। সুশাসন এবং দুর্নীতি রোধে কার্যকর পদক্ষেপ না থাকায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সাধারণত অর্থনীতিকে টেকসই ও সুদৃঢ় করতে পিরামিড পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। নিচ থেকে উপরের দিকে উন্নতির ভিত্তি ধরা হয়। অর্থাৎ, তৃণমূল বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন থেকে তা উপরের দিকে ধাবিত হবে। এখন যে উন্নয়ন হচ্ছে, তা উল্টো পিরামিড আকৃতির হয়ে গেছে। উপরের শ্রেণী ক্রমাগত ধনী হচ্ছে, নিচের শ্রেণী গরিব হয়ে যাচ্ছে। এতে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে। দেশের আশি ভাগ সম্পদ ধনীদের হাতে। এছাড়া অপ্রদর্শিত ও কালো টাকার মালিক ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। দেশের দারিদ্র্যসীমা ও বেকারত্বের হার আকাশচুম্বি হয়ে পড়েছে। করোনার ধাক্কায় জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক দরিদ্র হয়ে গেছে। দেশের অর্থনীতির ভিত্তি নড়বড়ে করে দিয়েছে। সংবিধানে উল্লেখিত মানুষের মৌলিক চাহিদা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের কথা যদি বিবেচনা করা হয়, বিগত পঞ্চাশ বছরে এই মৌলিক চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয়েছে ঠিকই তবে তার মানদন্ড নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। শিক্ষা খাতে শতভাগ পাশের নজির সৃষ্টি হলেও তার গুণগত মান প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে রয়েছে। কর্মমুখী শিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। ফলে দিন দিন উচ্চ শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। স্বাস্থ্যখাতে যথেষ্ট উন্নতি সাধিত হলেও উন্নত চিকিৎসা প্রাপ্তিতে সংকট রয়েছে। সরকারি হাসপাতালগুলোতে উন্নত চিকিৎসা পাওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্য রয়েছে। বেসরকারি হাসপাতালগুলো চিকিৎসা নিয়ে বাণিজ্য করছে। মানুষ এখন অনাহরে না থাকলেও অসংখ্য মানুষ তিন বেলা খাওয়া থেকে দূরে আছে। গার্মেন্টশিল্পের ব্যাপক বিকাশের কারণে বস্ত্রসংকট কেটেছে। সরকার সব মানুষের বাসস্থানের উদ্যোগ নিলেও অসংখ্য মানুষ গৃহহীন অবস্থায় রয়েছে। শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রটি ব্যাপক প্রসার লাভ করেছে। ড. ইউনুসের নোবেল পুরস্কার লাভ দেশের ভাবমর্যাদা বৃদ্ধি করেছে। গবেষণা ক্ষেত্রে পাটের জেনম আবিষ্কারসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে দেশের বিজ্ঞানীরা সাফল্য দেখিয়েছেন। আবার পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাবে অনেক বিজ্ঞানী বিদেশে চলে গেছেন। নানা সমস্যা, সংকট ও অনিয়মের মধ্যেও যে পঞ্চাশ বছরে দেশের অর্থনীতি উন্নয়ন ঘটেছে, তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই।
তিন.
স্বাধীনতার অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল গণতন্ত্র। পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর একনায়কতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশে স্বাধীনমত প্রকাশ করবে, এ আকাক্সক্ষা দেশের মানুষের মধ্যে তীব্র ছিল। দেখা গেছে, গণতন্ত্রের মৌলিক যে চেতনা, বিগত পঞ্চাশ বছরে তা কোনো না কোনোভাবে ব্যহত হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে সেনাশাসনের মাধ্যমে হোঁচট খেয়েছে। আবার জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও তার যথাযথ বাস্তবায়ন করতে পারেনি। শাসক শ্রেণীর মধ্যে জনগণের ক্ষমতা মূল্যায়নের চেয়ে নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা এবং ক্ষমতায় যাওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, আমাদের মতো উন্নয়নকামী দেশে গণতন্ত্র বরাবরই ভঙ্গুর অবস্থায় বিরাজমান। পূর্ণ গণতন্ত্রের বিষয়টি এখানে অলিক বিষয়। আপেক্ষিকতার ঘেরাটোপে বন্দি। গণতন্ত্রের অন্যতম যে স্পিরিট, ‘গভর্নমেন্ট অফ দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল’ বিষয়টি দেখা যায় না। শাসক শ্রেণী গণতন্ত্রকে তাদের মতো করেই ব্যবহার করেছে। আমরা যদি বিগত একযুগে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অবস্থা বিবেচনা করি তাহলে দেখব, তা অনেকটা আতুর ঘরেই পড়ে আছে। গণতন্ত্রের মূল শক্তি জনগণের মতামত ও রায়কে উপেক্ষা করা হয়েছে। মানুষের মতামতের ভিত্তিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মূল ভিত্তি জাতীয় নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে রয়েছে। সব ধরনের নির্বাচনে বিনাভোট ও রাতের আঁধারে নির্বাচন হওয়ার নজির সৃষ্টি হয়েছে। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনী ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে দেশে-বিদেশে বিস্তর সমালোচনা হলেও সরকার তার তোয়াক্কা করছে না। বরং গণতন্ত্রের অন্যতম শক্তি বিরোধী রাজনীতি কোনঠাসা করে এক ধরনের বিরাজনীতিকরণের প্রবণতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে, সরকার অনুগত বিরোধীদলকে একইসঙ্গে সরকারের অংশ এবং সংসদে বিরোধীদলের আসনে বসার মতো প্রক্রিয়াও দেখা গেছে। গণতন্ত্রে প্রকৃত বিরোধীদল থাকার বিষয়টি উপেক্ষা করা হয়েছে। গণতন্ত্রে সরকার ও বিরোধীদলের মধ্যে ‘চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স’ থাকার বিষয়টি নেই বললেই চলে। ফলে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে ‘হাইব্রিড’ বলা হচ্ছে। গণতন্ত্রের এই সংকটের মধ্যে খুন, গুম, নিপীড়ন-নির্যাতন, ধর্ষণ ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিরোধীদলের অনেক নেতা-কর্মী গুম-খুনের শিকার হয়েছে। প্রায় সময়ই নিখোঁজ নেতা-কর্মীদের পরিবারকে সন্তান ও বাবার খোঁজ চেয়ে সংবাদ সম্মেলন করতে দেখা যায়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিরোধীমত দমনে সরকার অত্যন্ত কঠোর অবস্থান নিয়ে দেশ পরিচালনা করছে। স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষের বিতর্ক তুলে দিয়ে ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতির মাধ্যমে রাজনৈতিক নিশ্চিহ্নকরণ প্রক্রিয়া অবলম্বন করছে। গণতন্ত্রের চেয়ে উন্নয়নকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। সরকার মধ্যে এ প্রবণতা প্রকট যে, বিরোধী দল থাকলে উন্নয়ন করা সম্ভব নয়। ফলে বিরোধী রাজনীতি নিশ্চিহ্ন বা নিস্ক্রিয় করে দিতে হবে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের কাজ উন্নয়ন করা। তবে উন্নয়নের সঙ্গে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত না করলে উন্নয়ন টেকসই হয় না। এতে দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা থাকে না। অনিয়ম ও দুর্নীতি বৃদ্ধি পায়। বাস্তবে তাই দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে অনিয়ম, সময়ক্ষেপণ, ত্রুটিপূর্ণ ও দুর্বল নির্মাণ কাঠামোর খবর পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। এতে জনগণের অর্থের ব্যাপক অপচয় হচ্ছে। গণতান্ত্রিক কাঠামোতে উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালিত হলে এ ধরনের অপচয় ও অনিয়মের সুযোগ কম থাকে। অথচ গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে এর প্রধানতম উপাদান জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করতে সববিরোধী দলের ঐক্যমতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধানে সংযোজিত করা হয়েছিল। এ সরকারের অধীনে যে কয়টি নির্বাচন হয়েছিল তার সবকটি দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। ভাবা হয়েছিল, এতে বাংলাদেশের গণতন্ত্র মজবুত ভিত্তি পাবে। এভাবেই এগিয়ে যাচ্ছিল। তবে বর্তমান সরকার আদালতের এক রায়ের কারণে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাদ দেয় এ কথা বলে যে, এ পদ্ধতি গণতন্ত্রের জন্য সাংঘর্ষিক। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনই গণতন্ত্রের মূল স্পিরিট। দেখা গেল, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করার পর দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনসহ যে কয়টি নির্বাচন হয়েছে, সবগুলোই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। দেশে-বিদেশে এসব নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। ফলে দেশের সুষ্ঠু নির্বাচনী ব্যবস্থা নেই বলে যেমন অভিযোগ উঠেছে, তেমনি গণতন্ত্রও দুর্বল হয়ে গেছে। গণতন্ত্র এতটাই দুর্বল হয়েছে যে, বাকস্বাধীনতা বা মত প্রকাশের স্বাধীনতাও অত্যন্ত সংকুচিত হয়ে পড়েছে। বিরোধী রাজনীতি সীমিত হয়ে পড়াসহ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে গঠনমূলক মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রুদ্ধ করা হয়েছে। বাকস্বাধীনতা বলে কিছু নেই। এ আইনের ধারায় সংবাদপত্র থেকে শুরু করে অতি সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা হচ্ছে। এ নিয়ে সাংবাদিক ও বিভিন্ন পেশাজীবী প্রতিবাদ করলেও সরকার তা আমলে নিচ্ছে না। সরকারের শাসন ব্যবস্থায় বিরোধীমত কঠোরহস্তে দমন করে উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড এগিয়ে নেয়ার নীতি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এতে গণতন্ত্র, সুশাসন, ন্যায়বিচার প্রাপ্তির ভবিষ্যত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
চার.
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে দেশের অর্থনীতির অভাবনীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতি হয়েছে। একই সঙ্গে আমরা যদি দেশের অর্থনীতিকে এক পাল্লায় রাখি, আরেক পাল্লায় গণতন্ত্র, সুশাসন, সামাজিক সমতার বিষয়গুলো রাখি, তাতে দেখা যাবে, অর্থনীতির পাল্লা ভারি হয়ে উঠেছে। গণতন্ত্র, সুশাসন, সাম্য হাল্কা হয়ে গেছে। অথচ অর্থনীতি এগিয়ে যাওয়ার কথা গণতন্ত্র, সুশাসন, সাম্য, মানবাধিকার এবং সামাজিক ন্যায়বিচারকে সঙ্গী করে। এসব মৌলিক উপাদান গৌণ করে অর্থনৈতিক উন্নয়ন মানবিক রূপ লাভ করে না। যদি তা হতো, তবে স্বাধীনতার মূলমন্ত্রে এসব উপাদান ঠাঁই পেত না। দুঃখের বিষয়, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে এসেও আমাদেরকে গণতন্ত্র ও মানবিক মূল্যবোধের সংকটে ভুগতে হচ্ছে। প্রতিবেশী দেশ থেকে একদিকে বন্ধুত্বের সোনালী অধ্যয়ের কথা শুনতে হচ্ছে, অন্যদিকে স্বাধীনতা নিয়ে কটাক্ষ করাও দেখতে হচ্ছে। আমরা আশা করব, স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার যে মূল চেতনা তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করবে। বিভাজন দূর করে রাজনীতিকে জাতীয় ও গণতন্ত্রের স্বার্থে একই ছাতার নিচে আনার উদ্যোগ নেবে। বিরোধীরাজনীতির ক্ষেত্র সম্প্রসারিত করবে। স্বাধীনতার মূলমন্ত্র গণতন্ত্র, সমতা, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী হবে। এসব মূল্যবোধ ধারণ করে উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করবে। বিরোধীদলের রাজনীতিও জনগণ ও জাতীয়স্বার্থ প্রাধান্য দিয়ে করতে হবে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে এসে প্রত্যেক রাজনৈতিক দলকেই ক্ষমতামুখী উন্নয়ন নয়, জনকল্যানমুখী রাজনীতি ধারণ করতে হবে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।