পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশ ন্যায্য আচরণ খুব কমই পায়। বাংলাদেশের জনগণের বেশির ভাগেরই ধারণা ভারত বাংলাদেশের সাথে যথাযথ আচরণ করতে কুণ্ঠাবোধ করে। সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিক হত্যা বন্ধ এবং বিভিন্ন নদ-নদীর পানির ন্যায্য হিস্যার প্রশ্নে দীর্ঘদিন ধরেই ভারতের আন্তরিকতার অভাব পরিলক্ষিত হয়ে আসছে। পারস্পরিক আলোচনায় ভারত বরাবর এসব সমস্যা সমাধানে আশ্বাস দিলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখা যায় না। বরং বাংলাদেশের জনগণ প্রত্যক্ষ করেছে, সীমান্ত হত্যা বন্ধে বৈঠক করা বা আশ্বাসের পরপরই সীমান্ত ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিএসএফ গুলি করে বাংলাদেশী হত্যা বা নির্যাতন করে। নদ-নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়া নিয়ে বারবার আলোচনা হলেও তা কোনো সুফল দিচ্ছে না। ২০১১ সালে তিস্তাচুক্তির সবকিছু চূড়ান্ত করার পর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির আপত্তিতে তা স্থগিত হয়ে যায়। সেই থেকে চুক্তিটি ঝুলে আছে। এ মাসের শুরুর দিকে এক নির্বাচনী প্রচারণায় মমতা ব্যানার্জি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গের পানি চাহিদা মিটিয়ে যদি তিস্তার পানি দেয়া যায়, তবে দেয়া হবে। তার এ কথা থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, তিস্তাচুক্তি নিকট ভবিষ্যতে হওয়ার সম্ভাবনা নেই। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের সময় এ নিয়ে কোনো আলোচনা হবে কিনা সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, এ নিয়ে শুধু নয়, ভারত-বাংলাদেশের অমিমাংসিত কোনো ইস্যু নিয়েই আলোচনা হবে না। নরেন্দ্র মোদি শুধু স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করতে আসবেন। তার এ কথা থেকেই প্রমাণিত হয়, তিস্তাচুক্তির বিষয়টি অনিশ্চিত। অন্যদিকে তিস্তার পানি ধরে রেখে বাংলাদেশের নেয়া মহাপরিকল্পনা কিংবা গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণের উদ্যোগে ভারত আপত্তি জানাচ্ছে। ভারতের আচরণ এমন যে, পানি দেবও না, বিকল্প ব্যবস্থাও করতে দেব না। অথচ ভারত মুখে মুখে নানা বিশেষণে বন্ধুত্বের কথা বললেও কার্যক্ষেত্রে তার কোনো প্রতিফলন নেই। বন্ধুত্বের উছিলায় তার সব দাবী-দাওয়া আদায় করে নিলেও বাংলাদেশের একটি চাওয়াও পূরণ করেনি। ব্যবসা-বাণিজ্য, কানেক্টিভিটির নামে যেসব চুক্তি-সমঝোতা হয়েছে এবং হচ্ছে, তাতে তার স্বার্থ ও প্রাপ্তি বেশি। বাংলাদেশের এত সেক্রিফাইস এবং সুবিধা দেয়ার বিনিময়ে ভারত তিস্তার পানি চুক্তি পর্যন্ত করতে পারছে না। এ চুক্তির অর্থ এই নয় যে, তাতে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পানির অভাব হবে। বরং চুক্তি হলে ভারতই বেশি পানি পাবে। চুক্তি অনুযায়ী, ৪২.৫ শতাংশ ভারত আর ৩৭.৫ শতাংশ পাবে বাংলাদেশ। চুক্তির এই হিসাবটিও মানতে চাচ্ছেন না মমতা। ভারত সরকারও যে চুক্তির ব্যাপারে উদ্যোগী বা আগ্রহী, তা তার আচরণ থেকে বোঝা যাচ্ছে না। বরং তার আন্তরিকতার অভাব রয়েছে। ভারত যদি প্রকৃতই বন্ধুসুলভ আচরণ ও আন্তরিক হতো, এতদিনে ‘পানি সমস্যা’র সমাধান হয়ে যেত। বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা মরুকরণ প্রক্রিয়ার মধ্যে পড়ত না। পাশাপাশি সীমান্তে বাংলাদেশের নাগরিক হত্যার ক্ষেত্রে তাদের ‘জিরো টলারেন্স’-এর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হতো।
দুই.
গ্রীষ্মে বাংলাদেশের নদ-নদীতে পানির চরম সঙ্কট দেখা দেয়া নতুন কিছু নয়। এ সময় দেশের উত্তরাঞ্চলে মরুভূমির পরিবেশ বিরাজ করে। জমি ফেটে চৌচির হয়। পানির জন্য কৃষককে হাহাকার করতে দেখা যায়। প্রতি বছরই বাংলাদেশকে এ সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। পানি বিশেষজ্ঞদের মতে, এর জন্য প্রকৃতি প্রধানত দায়ী ভারতের বৈরী পানিনীতি। পানি নিয়ে দেশটি রাজনীতি করছে, যে কারণে বাংলাদেশ পানি পাচ্ছে না। অসংখ্য নদী মরা গাঙে পরিণত হয়েছে এবং হচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। ভয়াবহ ক্ষতির মধ্যে পড়ছে দেশের কৃষিনির্ভর অর্থনীতি। কয়েক বছর আগে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও এশীয় প্রশান্ত পানি ফোরামের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে পানি সঙ্কট ভয়াবহ। পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রতিবেদনে যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে বাস্তবে তার চেয়েও করুণ অবস্থা বাংলাদেশের। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, তিস্তা, সুরমা, কুশিয়ারা, ধলেশ্বরী, গড়াইসহ দেশের সকল নদ-নদীতে স্বাভাবিক পানি প্রবাহ নেই। স্রোত হারিয়ে ধুধু বালু চরে পরিণত হচ্ছে। উজানে ভারতের একের পর এক বাঁধ নির্মাণ এবং একতরফা পানি প্রত্যাহারই এর কারণ। এক্ষেত্রে ভারত আন্তর্জাতিক রীতিনীতি উপেক্ষা এবং বাংলাদেশের সাথে আলাপ-আলোচনা ও চুক্তির তোয়াক্কা করছে না। গঙ্গা নদীতে ফারাক্কা, তিস্তায় গজলডোবা, মনু নদীতে নলকাথা, খোয়াই নদীতে চাকমা ঘাট, মহুরি নদীর কলসী বাঁধসহ অন্যান্য নদীতে বাঁধ নির্মাণ করে বাংলাদেশকে ন্যায্য পানি পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে অনেক প্রতিবাদ করলেও ভারত তাতে কর্ণপাত করেনি। পানি বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ভারত ২০০২ সালে গৃহীত তার জাতীয় পনিনীতি অনুসরণ করছে। এই পানিনীতিতে বলা হয়েছে, ‘কোন আন্তঃরাষ্ট্রীয় নদী ভারত ভূমির মধ্য দিয়ে গেলেই সে নদীর সম্পদ পুরোপুরি ভারতের।’ অথচ জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে, ১৮০৫ সাল থেকেই আর্ন্তজাতিক পানিসম্পর্কিত চুক্তি চালু রয়েছে। এ পর্যন্ত এ ধরনের ৩৬০০ চুক্তি বহাল রয়েছে যা দুই, তিন বা ততোধিক রাষ্ট্রের মধ্যে পানি ভাগাভাগির ব্যাপারে সম্পাদিত হয়েছে। এক্ষেত্রে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ব্যতিক্রম ঘটছে। উজানে বাঁধ নির্মাণ ও পানি প্রত্যাহারের ফলে ক্রমেই বাংলাদেশের জলবায়ুর পরিবর্তন এবং বিভিন্ন এলাকা মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার দিকে ধাবিত হচ্ছে। দেশের উত্তরাঞ্চলের বিস্তীর্ন এলাকা ইতোমধ্যে এ প্রক্রিয়ার মধ্যে পড়েছে। স্বাভাবিক প্রবাহ বাঁধাগ্রস্থ হওয়ায় দেশের প্রধান নদ-নদীতে বর্ষা মৌসুমেও পর্যাপ্ত পানি থাকে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, দেশে এক সময় এক হাজারের বেশি নদ-নদী ছিল। বর্তমানে ছোট-বড় শাখা নদী, উপনদী মিলিয়ে নদীর সংখ্যা ৩১০টিতে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের নদ-নদী মরে যাওয়া, বিলুপ্ত হওয়ার ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা রাখছে উজানে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহার। বিশেষজ্ঞদের মতে, ত্রিশ বছরের গঙ্গা চুক্তির শর্তসমূহ ভারত যথাযথভাবে মানছে না। তাদের এই না মানার কারণে শুধু ফারাক্কার মাধ্যমে পানি নিয়ন্ত্রণ করায় বাংলাদেশের ৩৬টি নদী মৃতপ্রায় অবস্থায় রয়েছে। পদ্মা এবং এর শাখা নদীগুলো পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। অথচ গঙ্গা চুক্তি অনুযায়ী শুষ্ক মৌসুমে (১ জানুয়ারী থেকে ৩১ মে) উভয় দেশ ১০ দিন ভিত্তিতে গঙ্গার পানি ভাগাভাগি করে নেয়ার কথা। ভারত এই চুক্তি মেনে চলেছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না। সে তার মতো করেই পানি প্রত্যাহার করছে। ফলে বাংলাদেশ বরাবরের মতোই এবারের শুষ্ক মৌসুমে পানিশূন্যতার মধ্যে পড়েছে। প্রমত্তা পদ্মা নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ভারত বাংলাদেশকে পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করার কারণেই পদ্মার এই বিবর্ণ দশা। এই পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে হলে বাংলাদেশকে অবশ্যই ফারাক্কার বিকল্প গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। বাংলাদেশের অস্তিত্বের প্রশ্নেই এটা করা উচিত বলে তারা মনে করেন। দুঃখের বিষয়, প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নিয়ে গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হলেও ভারতের আপত্তিতে তা স্থগিত হয়ে রয়েছে। ভারতের দাবী, এ ব্যারেজ নির্মিত হলে তার অংশের পদ্মায় চর জাগবে, জমিজমা প্লাবিত হবে। বিশেষ করে ভারতের এ দাবি যথার্থ বলে মনে করেন না।
তিন.
একাত্তর সালে যেখানে বাংলাদেশের নদীপথের দৈর্ঘ্য ছিল ২৪ হাজার কিলোমিটার, এখন তা ৫ হাজার কিলোমিটারে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের সাথে ভারতের পানি সমস্যা স্বাধীনতার পূর্বে হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে এর সূত্রপাত হয় চুয়াত্তর সালে। ভারত পরীক্ষামূলকভাবে ফারাক্কা বাঁধ চালুর কথা বলে গঙ্গার পানি প্রত্যাহার শুরু করে। এটি তখন আর পরীক্ষার মধ্যে থাকেনি, স্থায়ীরূপ লাভ করে। বাংলাদেশের জন্য অভিশাপ হয়ে দেখা দেয়। নদ-নদী পানিশূন্য হতে শুরু করে। মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের প্রতিবাদ করে তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে চিঠি দিয়েছিলেন। বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণে ফারাক্কা অভিমুখে লংমার্চ করেছিলেন। তাতে কিছুই হয়নি। উপরন্তু ভারত এসবের তোয়াক্কা না করে উজানে একের পর এক বাঁধ নির্মাণ করে বাংলাদেশকে পানিশূন্য করার সব প্রক্রিয়া করেছে এবং এখনও করছে। ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর ভারতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী দেবগৌড়া ও বাংলাদেশের তৎকালীন এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে গঙ্গার পানি ভাগাভাগি নিয়ে ৩০ বছর মেয়াদি চুক্তি হলেও চুক্তির মর্যাদা ভারত রাখছে না। শুধু ফারাক্কাই নয়, ভারত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করা ৫৭টি আন্তর্জাতিক নদীর মধ্যে ৫৪টির পানি একতরফাভাবে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। অনেক নদীতে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের পাশাপাশি ১৫টি নদীতে অস্থায়ী কাঁচা বাঁধ নির্মাণ করে পানি প্রত্যাহার করছে। বর্ষা মৌসুমে এসব স্থায়ী ও অস্থায়ী বাঁধ খুলে দেয়া হয় এবং শুষ্ক মৌসুমে কাঁচা বাঁধ পুনরায় নির্মাণ করে পানি প্রত্যাহার করা হয়। ভারত পানি প্রত্যাহারের সব ধরনের প্রক্রিয়াই অব্যাহত রেখেছে। বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে ছাড় দেয়ার মানসিকতা ভারত পোষণ করছে না। তার এই পানি আগ্রাসন নীতির বিরূপ প্রভাব নিয়ে যমুনা বিধৌত এলাকায় গবেষণা করতে গিয়ে পানি বিশেষজ্ঞদের পরীক্ষায় দেখা গেছে, নয়-দশ বছর ধরে যমুনা নদীর পানির স্তর ভূগর্ভস্থ পানির স্তরেরও অনেক নিচে নেমে গেছে। আগে শুষ্ক মৌসুমে ভূখন্ড থেকে ৩০ ফুট গভীরে পানির স্তর পাওয়া গেলেও বর্তমানে তা ৬০/৬৫ ফুট নিচে নেমে গেছে। এর সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে যমুনার শাখা নদী ও নালাগুলোতে। আবহমানকাল ধরে চলে আসা বাংলাদেশের নদী কেন্দ্রিক যে জীবনÑজীবিকা, কৃষি, সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, ভারতের পানিনীতির কারণে তা বিপন্ন হতে চলেছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে। দিন দিন নদীর তলদেশ ভরাট হওয়া এবং পলি জমার কারণে লবনাক্ততার সৃষ্টি হচ্ছে। উজানে বাঁধের কারণে পানি প্রবাহ হ্রাস পেয়ে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত লবনাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ না থাকায় সমুদ্রের লবনাক্ত পানি ভূখন্ডে প্রবেশ করে এ অবস্থার সৃষ্টি করছে। অন্যদিকে, কৃষিখাত সচল রাখার জন্য মানুষ ভূগর্ভস্থ পানি বেশি ব্যবহার করছে। এতে ভূগর্ভস্থ পানি ক্রমেই নিচে নেমে যাচ্ছে। বাড়ছে আর্সেনিক দূষণ। জীবন বাঁচাতে নদী অববাহিকার মানুষ বদলে ফেলছে তাদের পুরনো পেশা। এর ফলে একদিকে বেকারত্ব বাড়ছে, অন্যদিকে অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এই বাস্তবতা সত্তে¡ও ভারতের সাথে পানি সমস্যার সমাধানে সরকারের কার্যকর কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। কথাবার্তা, আলাপ-আলোচনা, বৈঠক সবই হয়েছে এবং হচ্ছে। সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। কাগজে-কলমে পানি ব্যবস্থাপনা এবং এ সংক্রান্ত কাজে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। পানি বিশেষজ্ঞরা ভবিষ্যত বাণী করেছেন, তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধ যদি শুরু হয়, তবে তা পানি নিয়েই হবে। অভিন্ন নদ-নদীর পানি নিয়ে টানাপড়েনের ফলে সৃষ্ট অস্থিরতায় এই যুদ্ধ শুরু হতে পারে। খরা, বন্যা ও সুপেয় পানির অভাব এবং জলবায়ুর বিরূপ পরিবর্তন, উন্নয়নশীল দেশগুলো জনগণের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে আগ্রাসী হয়ে ওঠার কারণে এমনটা হতে পারে। এর সূত্রপাত হতে পারে দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা থেকে। কয়েক বছর আগে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর রিপোর্টে আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলা হয়, যুদ্ধের কৌশল হিসেবে উজানের দেশ ভাটির দেশে প্রবাহিত নদ-নদীর পানি বন্ধ করে দেবে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্র তার নাগরিকদের পানি সরবরাহে ব্যর্থ হওয়ার কারণে সেদেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বে। পানি সঙ্কট, পানির নিম্নমান ও বন্যার কারণে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে সুপেয় পানির সরবরাহ ৪০ শতাংশ কমবে এবং এরপর থেকেই পানি নিয়ে সংঘাতের আশঙ্কা বেড়ে যাবে। এমনকি সন্ত্রাসীরা হাতিয়ার হিসেবে বাঁধগুলোকে বেছে নিতে পারে। বলার অপেক্ষা রাখে না, পানির সঙ্কটে পড়ে বহু বছর ধরেই বাংলাদেশ খরা, বন্যা ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দিন যতই যাচ্ছে, অবস্থার অবনতি হচ্ছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের পানি ব্যবস্থাপনাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া ছাড়া বিকল্প নেই। নদ-নদীর নাব্যতা বজায় রাখতে নিয়মিত ড্রেজিং কার্যক্রম বজায় রাখা অপরিহার্য। প্রতি বছর এ খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ হলেও আশানুরূপ কোন ফল পাওয়া যাচ্ছে না। ড্রেজিংয়ে বরাদ্ধকৃত অর্থের অপচয় এবং দুর্নীতির কারণেই এমনটি হচ্ছে। ড্রেজিংয়ের নামে কোটি কোটি টাকা লোপাট হয়ে যাওয়ার খবর বহুবার পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এ ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার খবর পাওয়া যায় না। পানি পাওয়ার বিষয়টি যেহেতু ঘুরপাক খাচ্ছে, কাজেই নদ-নদীর ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে পানি ধরে রাখার বিষয়টি সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। বর্ষার পানি ধরে রাখার জন্য ড্রেজিংয়ের পাশাপাশি জলাধার ও লেক সৃষ্টিসহ নদীর সাথে সংযুক্ত খাল ও নালাগুলো সংস্কারের কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, যুক্তরাষ্ট্র তাদের পানি সমস্যা সমাধানে শহরের ভেতরে ও বাইরে অসংখ্য লেক, ভেলী ও খাল সৃষ্টি করেছে। নদীর পাশাপাশি এসব লেক, ভেলী ও খালই তাদের পানির প্রধান উৎস। বাংলাদেশ প্রাকৃতিকভাবেই নদীমাতৃক এবং খাল, বিল হওরের দেশ। এসব নদী, খাল, বিল, পুকুর ও হাওর যথাযথভাবে সংস্কার করলে পানি সমস্যার সমাধান সহজেই করা সম্ভব।
চার.
পানির সঙ্কট ও হাহাকার মোকাবেলায় অবিলম্বে সরকারকে এ ব্যাপারে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পনা ও উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আশার কথা, চীনের সহায়তায় তিস্তাকে কেন্দ্র করে মহাপরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে সরকার তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের ডিজাইনের কাজ সম্পন্ন করেছে। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্য ধরা হয়েছে। ডিজাইন অনুযায়ী, প্রকল্পটি হবে আধুনিক, দৃষ্টিনন্দন ও যুগোপযোগী। তিস্তিার ডান ও বাম তীর মিলে ২২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে উঁচু গাইড বাঁধ, দুই পাশে থাকবে সমুদ্র সৈকতের মতো রিভার ড্রাইভ, হোটেল, মোটেল, রেস্টুরেন্ট, পার্ক, বিনোদন স্পট, ১৫০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র, আধুনিক কৃষি খামার, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, দুই পাড়ে আধুনিক শহর, ভারি ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান, ইপিজেড, ইকোনোমিক জোন, পর্যটন কেন্দ্রসহ অন্যান্য দৃষ্টি নন্দন প্রাকৃতিক পরিবেশ। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে অর্থ দেয়ার জন্য ইতোমধ্যে চীনকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ। তবে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আগে থেকেই আপত্তি জানিয়ে রেখেছে ভারত। ফলে গঙ্গা ব্যারেজের মতো এটিও ঝুলে যায় কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এ কথা স্পষ্ট, ভারত বাংলাদেশকে ন্যায্য পানির হিস্যা দেবে না। নদ-নদীর পানি পুঁজি করে সে তার সব স্বার্থ হাসিল করে নেবে। ইতোমধ্যে নিয়েছেও। এ বাস্তবতায়, বাংলাদেশকে তার নিজস্ব ব্যবস্থাপনায়ই পানির ব্যবস্থা করতে হবে। নদ-নদীর নাব্য বৃদ্ধি এবং খাল, বিল, ঝিল, পুকুর খনন করে বর্ষা ও বৃষ্টির পানি ধরে রেখে শুষ্ক মৌসুমের চাহিদা মিটাতে হবে। উত্তরবঙ্গের মরুকরণ প্রক্রিয়া ঠেকাতে সেখানে নদ-নদীতে পানির আধার সৃষ্টি করতে হবে। পাশাপাশি পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে ভারতের সাথে কূটনৈতিক তৎপরতা, দ্বিপাক্ষিক আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীর অববাহিকায় অবস্থিত দেশগুলোর সাথে পানি সমস্যা সমাধানে সম্মিলিত উদ্যোগ ও আলোচনা করতে হবে। দেশেগুলো যাতে সম্মিলিত উদ্যোগে একমত হয় এ ব্যাপারে কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।