Inqilab Logo

সোমবার, ০৮ জুলাই ২০২৪, ২৪ আষাঢ় ১৪৩১, ০১ মুহাররম ১৪৪৬ হিজরী

শিক্ষকদের দলীয় লেজুড়বৃত্তি কাম্য নয়

আর কে চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ১৫ মার্চ, ২০২১, ১২:০২ এএম

বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের পেশা নির্বাচনে ঔপনিবেশিক আমল থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পেয়ে আসছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতাকে মেধাবীদের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত পেশা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মেধাবীরা যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় আকৃষ্ট হন এবং নির্বিঘ্নে তাঁদের শিক্ষকতা ও গবেষণায় নিয়োজিত থাকতে পারেন, সে জন্য অগ্রসর দেশগুলোতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকারের হস্তক্ষেপ ও রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি থেকে মুক্ত রাখা হয়। অতিমাত্রায় দলীয় আনুগত্য প্রদর্শন করতে গিয়ে শিক্ষকরা যে লেজুড়বৃত্তির ভূমিকা পালন করছেন তা প্রত্যাশিত নয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ এর মতে, শিক্ষকতা ছাড়া রাজনৈতিক দল কিংবা অন্য কোনো পদের প্রতি মোহ থাকা শিক্ষকদের জন্য উচিত নয়। তবে সচেতন নাগরিক হিসেবে প্রত্যেকেরই ব্যক্তি স্বাধীনতা থাকতেই পারে। কিন্তু শিক্ষক হিসেবে যখন আপনি থাকবেন, তখন এটাকেই বড় করে দেখতে হবে।

সবারই একটি রাজনৈতিক দর্শন থাকতে পারে। কিন্তু শিক্ষকতা করার ক্ষেত্রে এর কোনো প্রভাব পড়বে না। আপনার রাজনৈতিক আদর্শের কোনো কিছুই এতে প্রভাব ফেলবে না। শিক্ষকদের নিরপেক্ষতার জায়গা থেকে ছাত্রদের পাঠদান করাতে হবে। প্রশাসন চালাতে হবে। বিশেষ করে দায়িত্বশীল কোনো জায়গা থেকে শিক্ষকদের কোনোভাবেই লেজুড়ভিত্তি করা ঠিক হবে না।

দেশে এমন অনেক শিক্ষক আছেন, কোনো রাজনীতির সঙ্গেই যুক্ত নন। আবার অনেকেই আছেন রাজনীতি করছেন। এটা ব্যক্তি স্বাধীনতার ওপর নির্ভর করে। একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে তার চিন্তা-চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটতেই পারে। এটাকে আটকে ফেলা কঠিন কাজ। তবে একজন শিক্ষককে অবশ্যই সচেতন ও সতর্ক থাকতে হবে। নিরপেক্ষতার জায়গা থেকে ছাত্রদের পাঠদান করতে হবে। ছাত্রদের পড়াশোনা করানো বা প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে নিজের রাজনীতি যেন চাপিয়ে দেওয়া না হয়।একজন আদর্শ শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষকতা ছাড়া কোনো লবিং, গ্রুপিং যায় না। যখন কোনো একটি পদের জন্য একজন শিক্ষক লবিং করবেন তখন এটা তার অযোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হবে। তিনি কোনো পদের জন্য যোগ্য নন।

আমাদের দেশে শিক্ষাঙ্গনের বড় সমস্যা শিক্ষকদের রাজনীতিতে অতিরিক্ত জড়িয়ে পড়া। বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক এখন সরাসরি রাজনৈতিক দলের সদস্য। অনেকে রয়েছেন জেলা ও উপজেলা কমিটিতেও। তারা শিক্ষকতার চেয়ে বেশি সময় দেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে। আবার কেউ কেউ আওয়ামী লীগ-বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের চেয়েও বেশি দলীয় অবস্থান প্রদর্শনে ব্যস্ত। শিক্ষকরা রাজনীতিসচেতন হবেন। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করতে পারেন। কিন্তু দলীয় লেজুড়বৃত্তি শিক্ষকদের মানায় না। শিক্ষকদের প্রধান কাজ পাঠদান, গবেষণা। মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে দেশের শিক্ষকসমাজ। তাদের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা অতীতেও শিক্ষকদের ছিল। কিন্তু এখনকার মতো ভয়াবহ অবস্থা অতীতে কখনো হয়নি। তাই এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে এখনই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। দেশ ও মানুষের প্রশ্নে শিক্ষক রাজনীতি অবশ্যই থাকবে কিন্তু দলবাজিতে বেশি যুক্ত হলে সমস্যা হয়।

মনে হচ্ছে, দলের প্রতি আনুগত্যের একটি প্রতিযোগিতা চলছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে। এতে ক্ষতি হচ্ছে ব্যক্তি, দেশ ও দলের। এসব থেকে শিক্ষকদের বিরত থাকা উচিত। কোনো দেশেই শিক্ষকরা রাজনীতির ঊর্ধ্বে নন। আদর্শের দিক থেকে তারা নীতিনির্ধারণী ভূমিকা রাখবেন এটি প্রত্যাশা করে সবাই। তবে সেটিকে অতিক্ষুদ্র দৃষ্টিতে দেখলে দলের প্রতি আনুগত্য বেশি হয়ে যায়। শিক্ষকরা রাজনীতির অনুসরণ করবেন, উপদেশ দেবেন, সমালোচনাও করবেন, কিন্তু তাঁদের নৈতিক অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ করে নয়। এ উদ্দেশ্যে সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। ব্যক্তিত্ব, ভাবমূর্তি, পান্ডিত্য দেখে উপাচার্য নিয়োগ না পাওয়ায় অপ্রত্যাশিত অবস্থার উদ্ভব ঘটছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। কেউ কেউ অসলগ্ন বক্তব্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ণ করছেন। একাডেমিক গবেষণার সাফল্যের কোনো সংবাদ এখন আর পত্রপত্রিকায় চোখে পড়ে না। আমরা মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, উপাচার্য নিষ্কলঙ্ক থাকবেন। দুর্নীতি তাঁদের স্পর্শ করবে না। পদের প্রতি নয়, ন্যায়বিচারের জন্য অবিচল থাকবেন। পদের মর্যাদা অবশ্যই বজায় রাখতে হবে।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: দলীয়-লেজুড়বৃত্তি
আরও পড়ুন