পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
১৯৪০ সালে লাহোরে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের ঐতিহাসিক কাউন্সিল অধিবেশনে গৃহীত হয় এমন এক প্রস্তাব, যা দীর্ঘ পৌনে দু’শ’ বছরের বৃটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে উপমহাদেশের মুসলমানদের জীবনে নিয়ে আসে এক সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন, যা আজ পর্যন্ত স্বর্ণাক্ষরে লিখিত রাখার বাস্তব দাবি রাখে। এত বছর পর আমরা আজ যে বাংলাদেশ নামের স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে গৌরব বোধ করছি, তা সেই লাহোরে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে গৃহীত প্রস্তাবের কল্যাণে বললে এতটুকু অতিরিক্ত বলা হয় না। নিখিল ভারত মুসলিম লীগের এ কাউন্সিল অধিবেশন লাহোরে অনুষ্ঠিত হয় বলে এই প্রস্তাব অদ্যাবধি ইতিহাসে ‘লাহোর প্রস্তাব’ হিসাবে পরিচিতি লাভ করে অমর হয়ে আছে। এই প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন তদানীন্তন বঙ্গীয় প্রদেশের প্রধানমন্ত্রী উপমহাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় মুসলিম লীগ নেতা আবুল কাসেম ফজলুল হক তথা এ. কে. ফজলুল হক। এই জনপ্রিয় নেতা যখন লাহোরের নিখিল ভারত মুসলিম লীগ কাউন্সিল অধিবেশনে প্রবেশ করতে যাচ্ছেন, তখন চারদিক থেকে ‘শেরে বাংলা জিন্দাবাদ’ ধ্বনিতে এমনভাবে তাকে সংবর্ধনা জানানো হয় যে, কাউন্সিল সভায় বিশৃংখল অবস্থার সৃষ্টি হয়। সভার সভাপতির পক্ষে সভার শৃংখলা রক্ষা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। সভায় সভাপতিত্ব করছিলেন নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সভাপতি মুহম্মদ আলী জিন্নাহ, যিনি পরবর্তীকালে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের শ্রেষ্ঠতম নেতা তথা কায়েদে আজম হিসাবে জনপ্রিয়তা লাভ করেন, আর তারই নেতৃত্বে মুসলমানদের স্বাধীন আবাসভূমি প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি সভাপতির আসনে বসে অপেক্ষা করছিলেন, কখন জনপ্রিয় এই নেতাকে মঞ্চে তার পাশে বসিয়ে মুসলিম লীগ কাউন্সিলের অধিবেশনে উপস্থিত জনগণকে শান্ত করার সুযোগ লাভ করবেন। অবশেষে সেই কাক্সিক্ষত সময় এলে শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হককে পাশে বসিয়ে রসিকতা করে জনগণের উদ্দেশ্যে বলেন, বাংলার বাঘকে অর্থাৎ শেরে বাংলাকে আমরা এবার বন্দি করে ফেলেছি। এবার আপনারা শান্ত হন।
এখানে আমরা শেরে বাংলা এ. কে ফজলুল হকের এই বিশাল জনপ্রিয়তার পটভূমি সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করতে চাই। শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক ছিলেন অসমসাহসী এমন এক মুসলিম নেতা, যার নাম ভারতীয় উপমহাদেশ তো বটেই, সমগ্র মুসলিম বিশ্বেই শ্রদ্ধার সাথে উচ্চারিত হতো। এর কারণও ছিল। এখানে মাত্র একটা উদাহরণ দেব। একবার ভারতের বিহার প্রদেশে মুসলিমবিরোধী দাঙ্গা বাঁধে। তাতে বহু মুসলমান প্রাণ হারান। এই অবস্থায় ফজলুল হক বিহারের হিন্দু নেতাদের এই বলে হুমকি দেন যে, বিহারের এই মুসলিমবিরোধী দাঙ্গা যদি দ্রুত বন্ধ না হয়, তাহলে বিহারে নিহত একজন মুসলমানের বদলায় বাংলায় দশ জন করে হিন্দু হত্যা করব। ফজলুল হকের এই হুমকি উচ্চারণের আশ্চর্য সুফল পাওয়া গেল। বিহারে মুসলিমবিরোধী দাঙ্গা বন্ধ হয়ে গেল। এতে মুসলিম জনগণের মধ্যে ফজলুল হকের জনপ্রিয়তা আরো বেড়ে গেল। সে সময় সারা মুসলিম বিশে^ মাত্র আরেক জন ফজলুল হকের মতো জনপ্রিয়তা লাভের সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। তিনি ছিলেন মিসরের নেতা জগলুল পাশা। আমি সে সময় ব্যক্তিগতভাবে এই দুই মুসলিম নেতার এমন ভক্ত হয়ে উঠেছিলাম যে, ঐ সময় আমার জন্মগ্রহণকারী দুই ভাগিনার নাম রেখেছিলাম যথাক্রমে ফজলুল হক ও জগলুল পাশা।
এবার আমরা যে বিষয় নিয়ে আজকের লেখা শুরু করেছিলাম, সেই বিষয়ের দিকে যাচ্ছি। নিখিল ভারত মুসলিম লীগের ১৯৪০ সালের কাউন্সিল অধিবেশনে শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের উত্থাপিত ও সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত যে প্রস্তাব উপমহাদেশের মুসলমানদের ইতিহাসে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে এবং যে প্রস্তাবের ধারাবাহিকতায় ১৯৪৭ সালে আমরা বৃটিশ সা¤্রাজ্যবাদের গোলামীর কবল থেকে মুক্তি পেয়ে পাকিস্তান নামের স্বাধীন রাষ্ট্র লাভ করি এবং পরবর্তীকালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের পথ বেয়ে পরবর্তীকালে অপ্রতিরোধ্য স্বাধিকার চেতনা অর্জন করি। ১৯৭১ সালে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসনামলে আমাদের সে স্বাধিকার চেতনা ধ্বংস করে দেয়ার অপচেষ্টা করা হয়, বাংলার দামাল ছেলেরা সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং মাত্র নয় মাসে বাংলাদেশ নামের নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।
১৯৭১ সালে আমরা বাংলাদেশ নামের যে স্বাধীন জন্মভূমি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হই, তার গৌরবময় ইতিহাস আমরা অনেকেই বিশেষভাবে নতুন প্রজন্ম জানে না। অথচ কোনো জাতি যদি তার স্বাধীন জাতি রূপে গড়ে উঠার পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস সঠিকভাবে না জানে, সে জাতির পক্ষে তার স্বাধীনতার সঠিক মূল্যায়ন করা কিছুতেই সম্ভব হয় না। আমাদের জাতীয় ইতিহাসের সঠিক মূল্যায়ন এবং স্বাধীনতার নিরাপত্তার স্বার্থেই আমাদের সকলকে স্বাধীনতার পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস ভালভাবে অধ্যায়ন করতে হবে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমিসহ সম্পূর্ণ ইতিহাস যদি না জানানো যায়, তাহলে তা হবে অত্যন্ত বিপদজ্জক। কারণ, স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কোন কোন দিক থেকে ষড়যন্ত্র আসতে পারে তা তারা নির্ণয় করতে না পারলে তাদের পক্ষে স্বাধীনতা সুরক্ষা করা সম্ভব হবে না। সুতরাং, আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা নিরাপদ রাখার জন্যই আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের পূর্বাপর প্রতিটা স্তর সম্পর্কে আমাদের অবহিত হতে হবে। এব্যাপারে ইতিহাস ভালোভাবে অধ্যায়ন করা যেমন অত্যাধিক প্রয়োজন, তেমনি তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করাও অপরিহার্য। আমরা সকলেই জানি যে, পৌনে দু’শ’ বছরের বৃটিশ শাসনের অবসানের প্রাক্কালে উপমহাদেশের দুটি প্রধান সম্প্রদায় হিন্দু ও মুসলমানরা বিভক্ত হয়ে পড়ে। কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন হিন্দুদের দাবি ছিল সমগ্র ভারতবর্ষকে অবিভক্তভাবে স্বাধীন করতে হবে। তাতে স্বাধীন ভারত হয়ে পড়ত হিন্দু প্রভাবাধীন। পক্ষান্তরে মুসলিম লীগের নেতৃত্বে মুসলমানরা চেয়েছিল বৃটিশশাসিত ভারতবর্ষ এমনভাবে বিভক্ত করতে হবে, যাতে ভারতবর্ষের পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের মুসলিম-অধ্যুষিত জনপদে একাধিক স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়। ইতোপূর্বে উল্লেখিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের যে অধিবেশন ১৯৪০ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত অধিবেশনে শেরে বাংলা এ. কে ফজলুল হকের উত্থাপিত সে প্রস্তাবই সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।
তার আলোকেই মুসলিম লীগের পরবর্তী সমগ্র কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এর সুপ্রভাব পড়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে। ১৯৪৬ সালে ভারতবর্ষে যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে মুসলিম লীগের বিপুল বিজয় লাভের ফলে উপমহাদেশের মুসলিম অধ্যুষিত পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তান নামের একটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়। এভাবে পৌনে দু’শ’ বছরের বৃটিশ শাসনের অবসানে সমগ্র বৃটিশ-শাসিত ভারতবর্ষ একটি অবিভক্ত রাষ্ট্র রূপে স্বাধীন না হয়ে স্বাধীন হয় ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি পৃথক রাষ্ট্র রূপে। এতে ভারত একটি অবিচ্ছিন্ন জনপদ রূপে স্বাধীন হয় বলে, তার তেমন সমস্যা হয় না। কিন্তু পাকিস্তান নামের রাষ্ট্রটি প্রায় দেড় হাজার মাইলের ব্যবধানে অবস্থিত ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন দুটি জনপদ অবস্থিত হওয়ায় প্রতিষ্ঠার দিন থেকেই পাকিস্তান কিছু সমস্যার সম্মুখীন হয়। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে বাঙালি মুসলমানদের অবদান ছিল অনেক বেশি। প্রথমত পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যে সংগঠনটির ভূমিকা ছিল নিরঙ্কুশ, সেই নিখিল ভারত মুসলিম লীগের জন্মই হয় ১৯০৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম শিক্ষা সম্মেলনের বিশেষ রাজনৈতিক অধিবেশনে। এই অধিবেশনে তদানীন্তন উপমহাদেশের অন্যতম উদীয়মান মুসলিম নেতা মুহম্মদ আলী জিন্নাহকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কিন্তু তিনি সে আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন এই যুক্তিতে যে, এর ফলে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সাথে এবং একই সাথে ভারতের কিছু সম্প্রদায়ের সঙ্গে মুসলমানদের সংঘাত বেড়ে যাবে, যা কোনো মতেই কাম্য নয়।
অবশ্য মুহম্মদ আলী জিন্নাহই পরবর্তীকালে তাঁর ভুল বুঝতে পেরে মুসলিম লীগে যোগ দেন এবং কায়েদে আজম অভিধায় খ্যাতি লাভ করেন।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করে জিন্নাহ অমরত্ব লাভ করলেও তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র অবিভক্ত রাষ্ট্র হিসাবে দীর্ঘদিন স্থায়ী হতে পারেনি বাস্তব কারণেই। আসলে দেড় হাজার মাইলের অধিক ব্যবধানে অবস্থিত দুটি ভৌগোলিকভাবে পৃথক জনপদ নিয়ে একটি রাষ্ট্র গঠনের দৃষ্টান্ত ইতিহাসে নেই। তাছাড়াও পাকিস্তান নামের রাষ্ট্রের ব্যাপারে আরো কিছু বিশেষ সমস্যা দেখা দেয় পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকেই।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।