Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

টেকসই বন ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে

নাজমুনাহার নিপা | প্রকাশের সময় : ১৩ মার্চ, ২০২১, ১২:০২ এএম

দেশের জীববৈচিত্র্য অফুরন্ত ভান্ডার হচ্ছে বন। বন অক্সিজেন বাড়ায়, বিষাক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড কমায়, বৃষ্টিপাত ঘটায়, ভূমিক্ষয় রোধ করে, বন্যা-খরা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো প্রতিরোধ করে। বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, পানিদূষণ ও মাটিদূষণ রোধ করে। ওজনস্তর ক্ষয়রোধ করে। বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা কম রাখে। সর্বোপরি পরিবেশ নির্মল রাখে।

বাংলাদেশে সাধারণত জুলাইয়ের মধ্যেই বর্ষা শুরু হয় এবং অক্টোবর অবধি অব্যাহত থাকে, অর্থাৎ এই সময় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ থাকে প্রায় ৮০ ভাগ, যেখানে বার্ষিক গড়ে ১,৪২৯ মিমি থেকে ৪,৩৩৮মিমি (বিবিএস ১৯৯৬) হয়। দেশের মোট আয়তনের মধ্যে কৃষিজমি ১৮% (বন বিভাগ অনুসারে)। একটি গ্রীষ্মমন্ডলীয় দেশ হিসাবে, বাংলাদেশ বন্য এবং চাষাবাদকৃত উভয় জমি জুড়ে বিস্তৃত জৈব-বৈচিত্র্য উপভোগ করে থাকে।
টেকসই বন ব্যবস্থাপনা (এসএফএম) একটি গতিশীল ধারণা হিসাবে সংজ্ঞায়িত হয়েছে, যার লক্ষ্য বর্তমান এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের সুবিধার জন্য সকল প্রকার বনের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পরিবেশগত মান বজায় রাখা এবং বৃদ্ধি করা। বন এবং গাছগুলি যখন স্থিতিশীলভাবে পরিচালিত হয়, মানুষ এবং গ্রহে উভয়ই জীবিকা নির্বাহ করে, বিশুদ্ধ বায়ু এবং জল সরবরাহ করে, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করে এবং জলবায়ু পরিবর্তনে সাড়া দেয়।

দেশকে মানুষের বাসযোগ্য করে রাখায় বন ও বনাঞ্চলের ভূমিকাই প্রধান। জাতীয় অর্থনীতি ও পরিবেশের টেকসই উন্নয়ন এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা- উভয় ক্ষেত্রেই এর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য যেখানে দেশের মোট আয়তনের শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন, সেখানে বাংলাদেশের মোট ভূমির ১০ শতাংশের নিচে বনাঞ্চল রয়েছে বলে আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিনিয়ত বন উজাড় হওয়ার কারণে বনজ সম্পদকে এদেশের সবচেয়ে বেশি হুমকির সম্মুখীন ও ক্ষতিগ্রস্ত একটি খাত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

বায়ুমন্ডলের আর্দ্রতা বৃদ্ধি ও তাপের সমতা রক্ষা, বন্যা ও প্লাবন রোধ, ভূমির ক্ষয়রোধ, ভূমির উর্বরতা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস রোধ, কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণের মাধ্যমে বায়ু বিশুদ্ধকরণ, বায়ুমন্ডলে অক্সিজেন সরবরাহ, পশুপাখির আশ্রয়স্থল সংরক্ষণ, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে বনের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

বন বিভাগ প্রদত্ত তথ্যানুসারে, বর্তমানে বাংলাদেশে মোট ২.৫২ মিলিয়ন হেক্টর বনভূমি রয়েছে, যা দেশের মোট ভূমির প্রায় শতকরা ১৭.৪ শতাংশ। বন বিভাগ বর্তমানে দেশের ১০.৩০ শতাংশ বা ১.৫২ মিলিয়ন হেক্টর ভূমি নিয়ন্ত্রণ করছে। এর মধ্যে রয়েছে পাহাড়ি বন, সমতল ভূমির বন, সুন্দরবন, উপকূলে তৈরি করা বন এবং চা ও রাবার বাগানে সৃষ্ট বন। অবশিষ্ট ০.৭৩ মিলিয়ন হেক্টর জুড়ে রয়েছে জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণাধীন অশ্রেণীভুক্ত বনাঞ্চল এবং ০.২৭ মিলিয়ন হেক্টর গ্রামীণ বন। তবে ২০০৫-২০০৭ সালে এফএও এর সহযোগিতায় বন বিভাগ ও স্পার্সোর যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত এই জরিপ অনুযায়ী দেশে মোট বনভূমির পরিমাণ ১.৪৪২ মিলিয়ন হেক্টর যা দেশের মোট ভূমির ৯.৮%।
দেশের অন্যতম সম্পদশালী বনায়ন হচ্ছে সুন্দরবন। এর উপর নির্ভরশীল প্রায় কয়েক লক্ষ মানুষ। সে লক্ষে জেলেদের মাছ ধরার সময়ে নিজস্ব প্রয়োজন মেটানোর জন্য কিছু জ্বালানি সংগ্রহের অনুমতি দেওয়া হয়। এই সুযোগে মাছ ধরে ফিরে আসার সময় জেলেরা অতিরিক্ত জ্বালানি বিক্রির জন্য সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। সুন্দরবন থেকে অবৈধ কাঠ পাচারের অন্যতম নিয়মিত মাধ্যম হচ্ছে গোলপাতা-গরানের নৌকা এবং জেলে নৌকা। বিভিন্ন রিপোর্ট মতে, জেলে নৌকা সুন্দরবন থেকে গড়ে ১৫ সিএফটি সুন্দরী ও পশুর কাঠ পাচার হয়। এভাবে প্রতি বছর গোলপাতা ও জেলে নৌকায় গড়ে প্রায় ১৩৫ কোটি টাকার কাঠ পাচার হয়ে যাচ্ছে।

সরকারি বন বিভাগ ও তার সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহ, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও তাদের অঙ্গ সংগঠনসমূহের মতে বন বিনাশের কারণ হচ্ছে, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ব্যাপক দারিদ্র্য, ভূমিহীন মানুষের বনের দিকে অভিগমন, জুমচাষ এবং বন সম্পদের অনুপযুক্ত ব্যবহার। এছাড়া পশুচারণ ভূমি হিসেবে বনভূমির ব্যবহার, অবৈধ বৃক্ষ কর্তন, জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ, বন সম্পদের নিয়ন্ত্রণহীন ও বিবেচনাহীন বাণিজ্যিক ব্যবহারকেও বন বিনাশের কারণ হিসেবে দায়ী করা হয়। তবে জনসংখ্যা বৃদ্ধিকেই বন বিনাশের সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। জনসংখ্যা বৃদ্ধি বনের উপর চাপ সৃষ্টি করে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই, কেননা জনসংখ্যার চাপ ও দারিদ্র বন বিনাশে অনেকটাই দায়ী।

বাংলাদেশের পাহাড়ী বন মূলত চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, কক্সবাজার ও সিলেট জেলায় অবস্থিত। এই পাহাড়ী বনের মোট আয়তন ৬,৭০,০০০ হেক্টর যা বন বিভাগ নিয়ন্ত্রিত বনের ৪৪% এবং বাংলাদেশের মোট আয়তনের ৪.৫৪%। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবনের মোট আয়তন ৬,০১,৭০০ হেক্টর, যা বন বিভাগ নিয়ন্ত্রিত বনের ৪০% এবং বাংলাদেশের মোট আয়তনের ৪.০৭%।

বর্তমানে বাংলাদেশ বন বিভাগ যে সকল নীতি, আইন, ধারা ও বিধি দ্বারা বন ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করে থাকে তা হলো, জাতীয় বন নীতি-১৯৯৪, বন আইন-১৯২৭ (সংশোধিত ২০০০), বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ) আইন-১৯৭৩ (সংশোধিত ১৯৭৪), সামাজিক বনায়ন বিধিমালা-২০০৪, ব্যক্তি মালিকানাধীন বন অধ্যাদেশ- ১৯৫৯, আতিয়া বন (সংরক্ষণ) অধ্যাদেশ-১৯৮২, পূর্ব বাংলা মৎস্য সংরক্ষণ আইন-১৯৫০, কাঁকড়া রপ্তানি বিধি- ১৯৮৮, বাঁশ রপ্তানি নীতি-১৯৯৯, ইট ভাটা আইন, (সংশোধিত) ২০০১, বন নির্দেশিকা (১ ও ২), নার্সারি ও বৃক্ষরোপণ নির্দেশিকা-২০০৪, বনজদ্রব্য চলাচল বিধি-২০০৮ (প্রস্তাবিত)।

গাছের সঙ্গে সঙ্গে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণেরও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। প্রবাদে আছে, বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে- অর্থাৎ যার যেখানে থাকার কথা সে সেখানে থাকলেই সব কিছু ঠিক থাকে। বন্যপ্রাণী অর্থাৎ বাঘ, সিংহ, হাতি যদি শিকারীর অত্যাচারে উৎপীড়িত হয় তখন তারাও মনুষ্য সমাজে ঢুকে ক্ষয় ক্ষতি করে। এদের উপর অত্যাচার বন্ধ করা একান্ত প্রয়োজন। তাহলেই সমস্ত ভারসাম্য বজায় থাকবে।

আইইউসিএনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈরী জলবায়ুর কারণে বাংলাদেশে ৭০৮ প্রজাতির মাছের মধ্যে ৫৪টি, ৬৩২ প্রজাতির পাখির মধ্যে ১২টি প্রজাতি বিলুপ্ত হয়েছে এবং ৩০ প্রজাতি বিলুপ্তির পথে। ৪৯ প্রজাতির উভচর প্রাণীর মধ্যে ৮টি, ১৬৭ সরীসৃপ প্রজাতির মধ্যে ১৭টি বিলুপ্তির পথে। ১২৭টি স্তন্যপায়ী প্রজাতির মধ্যে ১২টি বিপন্ন আর ১৭টি বিলুপ্তির পথে। ৫ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদের মধ্যে ১০৬টির অস্তিত্ব হুমকির মুখে। ডাইনোসোরের মতো বিলুপ্ত হতে যাচ্ছে বাঘ। প্রতি বছর পৃথিবীতে প্রায় ৫০টি বাঘ কমে যাচ্ছে।

ক্রমবর্ধমানভাবে স্বীকৃত যে বনজ সম্পদগুলি বিভিন্ন উপায়ে সরাসরি জীবিকাতে অবদান রাখে। এশিয়ার বনগুলি কয়েক লক্ষ লোককে খাদ্য, চাদর, জ্বালানি কাঠ এবং কাঠ সরবরাহ করে। তদুপরি, বনজ খাত গ্রামীণ দরিদ্রদের অনেকের জন্য আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান হয়ে থাকে। উন্নয়নশীল দেশগুলি প্রতি বছর ৩০-৪০ বিলিয়ন ডলারের কাঠ এবং প্রক্রিয়াজাত কাঠের পণ্য উৎপাদন করে, যদিও এর সামান্য একটি অংশ বর্তমানে দরিদ্র পরিবারের উপকার করে।

প্রায় দুই বিলিয়ন মানুষ তাদের শক্তির জন্য মূলত জ্বালানি কাঠ, কাঠকয়লা এবং অন্যান্য বায়োমাস জ্বালানির উপর নির্ভর করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমান করে যে দুই বিলিয়ন মানুষ তাদের স্বাস্থ্যের জন্য ঔষধের উপর নির্ভর করে, যার বেশিরভাগ বন থেকে আসে। শিকার এবং ফিশিং ৬২টি উন্নয়নশীল দেশে ২০% পরিবারের প্রোটিনের প্রয়োজনীয়তা সরবরাহ করে এবং এর বেশিরভাগই বনাঞ্চল থেকে ঘটে।

বনাঞ্চলের উপর নির্ভরশীল মানুষের কল্যাণ বাড়ানোর জন্য অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে: বনভিত্তিক কর্মসংস্থান এবং আয়ের সুযোগগুলি বাড়ানো, জীবিকার উপর নেতিবাচকভাবে প্রভাব ফেলতে থাকে এমন বনজ সম্পদ হ্রাসের উপায় অনুসন্ধান করা, তাদের শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিশ্চিত করা ইত্যাদি

বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তন, খাদ্য ঘাটতি এবং ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার উন্নত জীবন-জীবিকার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বনজসম্পদগুলির কেন্দ্রীয় ভূমিকা রয়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে, সমস্ত জাতির দুই-তৃতীয়াংশ জল সরবরাহের চাপের মুখোমুখি হবে এবং ২.৪ বিলিয়ন মানুষ মৌলিক স্বাস্থ্য, কৃষি এবং বাণিজ্যিক প্রয়োজনের জন্য পর্যাপ্ত জল সরবরাহ করতে অক্ষম এমন দেশগুলিতে বাস করবে।

বহু শতাব্দী ধরে, দুর্ভিক্ষ বা অন্যান্য কারণে বনের আশেপাশের মানুষের জন্য এক ধরনের প্রাকৃতিক সুরক্ষার জাল হিসাবে কাজ করে, যা কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনকে প্রভাবিত করে, তারা জ্বালানির জন্য ফল, পাতা, আঠা, বাদাম এবং কাঠ সরবরাহ করে। বন সমৃদ্ধ দেশগুলিতে বনজ অর্থনৈতিক বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থানের উৎস হতে পারে। বিশ্বব্যাপী ১৬০ মিলিয়নেরও বেশি লোক বন উদ্যোগের মাধ্যমে কাজ খুঁজে পান।

আমাদের বনগুলি গতিশীল বাস্তুসংস্থান, যা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হতে পারে। বাহ্যিক বা অভ্যন্তরীণ হুমকি থেকে সুরক্ষা থাকা সত্তে¡ও জনসংখ্যার ভারী চাপ, তাদের আবাসন বা দূষণ এবং বনজ পণ্যের অত্যধিক ব্যবহারের কারণে তারা চারণভূমিতে পরিণত হতে পারে। তদুপরি, বনের চারপাশের চাষের ফলে বনের উদ্ভিদ এবং তাদের পণ্যগুলির বৃদ্ধি মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে।

পরিবেশের সকল ক্ষেত্রে ভারসাম্য ও সুস্থতা বজায় রাখায় বনাঞ্চল মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। তাই, বনাঞ্চলের উপর নির্ভরশীল প্রতিটি পরিবার এবং ব্যক্তিকে তাদের সকল সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। সেই সাথে তারা যেন পুরোপুরি বনের উপর নির্ভরশীল না হয়, সে দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। সেক্ষেত্রে বন ব্যবস্থাপক এবং সুবিধাভোগী সবাইকে একসাথে কাজ করার বিকল্প নেই।
লেখক: শিক্ষার্থী, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বন-ব্যবস্থাপনা
আরও পড়ুন