পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
কৃষিতে বিপ্লব, বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও গার্মেন্ট রফতানির হাত ধরে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে বিবেচিত। অথচ সর্বব্যাপী দুর্নীতি-লুটপাট ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয়ের পাশাপাশি দেশ থেকে বছরে প্রায় লক্ষকোটি টাকা পাচার হয়ে যাওয়ার কারণে এর অর্থনৈতিক সম্ভাবনা যেমন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, সেইসাথে দেশে আয় বৈষম্যও বেড়ে চলেছে। বছরে প্রায় তিনলক্ষ কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন বাজেটের বিপুল অংশ দুর্নীতি-অপচয়ের মধ্য দিয়ে বেহাত হয়ে যাচ্ছে। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন খাতে। একেকটি সড়ক-মহাসড়কস নির্মানে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রাক্কলিত ব্যয় সময়মত বাস্তবায়ন না হওয়ায় যেমন দেশের মানুষ বছরের পর বছর ধরে বহুবিধ দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে, তেমনি প্রকল্প বাস্তবায়নে অহেতুক সময় ক্ষেপন, বার বার প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির সাথে সাথে এর ব্যয়বৃদ্ধির ফলে জনগণের ট্যাক্সের টাকার বিপুল অপচয় ও লুটপাট হচ্ছে। নির্মান কাজ দীর্ঘদিন ফেলে রাখার কারণে এমনিতেই অবকাঠামো কাঙ্খিত মান বা স্থায়ীত্ব অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে। তার উপর নিম্নমানের নির্মান সামগ্রী, অনুন্নত প্রযুক্তি, ত্রুটিপূর্ণ নকশায় অবকাঠামো নির্মিত হলে তার কাঙ্খিত মান বা স্থায়ীত্ব নিশ্চিত করা অসম্ভব।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত একাধিক রিপোর্টে জানা যায়, শুধু দক্ষিণ এশিয়া বা এশিয়াতেই নয়, পশ্চিমা দুনিয়ার অর্থনৈতিকভাবে উন্নত রাষ্ট্রগুলোর অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যয়ের তুলনামুলক বিচারেও সড়ক-মহাসড়ক ও সেতু নির্মানে কিলোমিটার প্রতি সবচেয়ে বেশি খরচ হয় বাংলাদেশে। বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতির প্রায় পুরোটাই প্লাবন সমভূমি। সাধারণত গিরিখাত, পর্বতসঙ্কুল সমুদ্রোপকুলীয় এলাকায় অবকাঠামো নির্মানে বেশি ব্যয় হওয়ার কথা। সবকিছু ছাপিয়ে অস্বাভাবিক ও অপ্রত্যাশিত উচ্চ খরচে যে অবকাঠামো বাংলাদেশে নির্মিত হচ্ছে তার মান ও স্থায়ীত্ব অত্যন্ত কম। এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় বিষ্ময়কর বাস্তবতা। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল সড়ক-মহাসড়কগুলো অল্পদিনের মধ্যেই ভেঙ্গে নষ্ট হয়ে চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। এ ক্ষেত্রে দেশের বাণিজ্য-অর্থনীতি ও যোগাযোগ অবকাঠামোর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লাইফলাইন হিসেবে পরিগণিত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কথা উল্লেখ্য। দেড় দশক আগে২০০৫ সালে এই মহাসড়কটিকে চারলেনে উন্নীত করার প্রকল্প গ্রহণ করে প্রকল্প ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছিল ১ হাজার ৬৯ কোটি টাকা এবং বাস্তবায়নের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছিল ২০০৬ সাল থেকে ৫ বছর। তবে প্রকল্পের মেয়াদ চারদফা এবং ব্যয় বরাদ্দ ৩ হাজার ৮১৬ কোটি টাকায় উন্নীত করে ২০১৭ সালের জুনের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা থাকলেও তা পুরোপুরি সম্ভব হয়নি। দ্বিগুণ ব্যয় ও সময় বাড়িয়ে যে স্বপ্নের চারলেন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে তার মান নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই মহাসড়কটি নির্মান কাজ শেষ হওয়ার পর বছর না ঘুরতেই বিভিন্ন স্থানে ভাঙ্গাচোরা ও খানাখন্দকে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।
গতকাল দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত রিপোর্টে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক চারলেন প্রকল্পের হাল অবস্থা উঠে এসেছে। প্রতি কিলোমিটারে যথাক্রমে ১৯ কোটি ও ২১ কোটি টাকার বেশি খরচ করে চারলেনে উন্নীত মহাসড়কগুলোর উন্নয়ন কাজ শেষ হওয়ার আগেই বিভিন্ন স্থানে ধসে যাওয়া, পিচ উঠে যাওয়ায় পেভমেন্ট দেবে যাওয়ার বাস্তবতা থেকে বুঝা যায়, এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রায় প্রতিটি ধাপে এবং প্রত্যেক সেক্টরে অস্বাভাবিক দুর্নীতি, খামখেয়ালি ও অব্যবস্থাপনা ও নজরদারির ঘাটতি ছিল। প্রকল্প ব্যয় এবং বাস্তবায়নে নয়ছয় করে দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা তসরুফ করেও ন্যুনতম টেকসই অবকাঠামো নির্মান করতে না পারার ব্যর্থতার দায় যেন কারোই নেই। উন্নয়ন বাজেটের এমন বল্গাহীন অপচয়ের খেসারত নানাভাবে দিতে হচ্ছে দেশের জনগণকে। দীর্ঘদিন বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের কারণে মানুষের দুর্ভোগ এবং অর্থনীতিতে তার পরোক্ষ নেতিবাচক প্রভাবের ক্ষয়ক্ষতির হিসাব অগ্রাহ্য করার মত নয়। বিশ্বব্যাংকের এক রির্পোট অনুসারে মহানসড়ক চারলেনে উন্নীত করতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভারতের চেয়ে ১০গুণ এবং চীনের চেয়ে আটগুন খরচ হয়েছে বাংলাদেশে। এমনকি ইউরোপের দেশগুলোর চেয়েও বাংলাদেশে সড়ক ও সেতু অবকাঠামো নির্মান ব্যয় বেশি। সবচেয়ে বেশি টাকা খরচ করে সবচেয়ে বাজে ও নিম্নমানের অবকাঠামো তৈরীর পর এসব অবকাঠামোর সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষনের নামে প্রতি বছর শত শত কোটি টাকা ব্যয় করা হচ্ছে। দেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা এবং জনগণের অর্থের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হলে অবকাঠামো উন্নয়নে বিদ্যমান দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও অস্বচ্ছতা দূর করার কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারি আমলাতন্ত্র, বাস্তবায়নকারি সংস্থা এবং ঠিকাদার-ইঞ্জিনিয়ারদের যোগসাজশে অবকাঠামো উন্নয়ন খাতে গড়ে ওঠা এই দুর্নীতির দুষ্টচক্র ভাঙতে না পারলে দেশের মানুষ উন্নয়নের সুফল থেকে বঞ্চিত হতে থাকবে। দুর্নীতি-লুটপাট, অপচয়ের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা ছাড়া এ ধারা বন্ধ করা সম্ভব নয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।