Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দেশের ভাবমর্যাদা ক্ষুন্ন’র বিষয়টি পরিষ্কার করা উচিত

| প্রকাশের সময় : ১০ মার্চ, ২০২১, ১২:০১ এএম

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮-এর বিভিন্ন ধারা নিয়ে যৌক্তিক কারণেই দেশের জাতীয় সংবাদ মাধ্যমের সম্পাদক পরিষদ, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যম কর্মীদের প্রবল আপত্তি রয়েছে। সরকারের সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি ছিল, এই আইনের নিবর্তনমূলক ধারাগুলো সংশোধনসহ আইনের অপব্যবহার বন্ধের ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। এখন পর্যন্ত তা করা হয়নি। সরকারের করোনাবিরোধী কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তোলা, কার্টুন আঁকা ও ক্যাপশন লেখার কারণে কার্টুনিস্ট কিশোর এবং মুশতাকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা ও গ্রেফতারের পর গত ২৫ ফেব্রæয়ারী কারা হেফাজতে লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর পর এ নিয়ে দেশে-বিদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। পশ্চিমা ১৩টি দেশের রাষ্ট্রদূতগণ এক যৌথ বিবৃতিতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং লেখক মুশতাকের মৃত্যুর বিষয়ে সরকারের কাছে কার্যত ব্যাখ্যা ও তদন্ত দাবি করেছেন। দেশের আভ্যন্তরীন বিষয়ে বিদেশিদের এমন ভূমিকা নি:সন্দেহে দেশের ইমেজের জন্য ইতিবাচক নয়। কিন্তু এ পরিস্থিতির জন্য কি মুশতাকের মৃত্যু এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার দায়ী, নাকি যারা এ নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে তারা দায়ী এমন প্রশ্ন তোলা অবান্তর। তবে ইচ্ছাকৃত বা অজ্ঞতাপ্রসূত কারণে কারো লেখায় রাষ্ট্রের ভাবমর্যাদা ক্ষুন্ন হলে তার ক্ষেত্রে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তবে তার অর্থ এই নয় যে, তাদেরকে মাসের পর মাস বিনা বিচারে আটক রেখে নির্যাতন করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে হবে।

সিলেটে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গত বছর মার্চ মাসে আটক ষাটোর্ধ্ব গোলাম সারোয়ার হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে অন্তবর্তিকালীন জামিন লাভের পরও রাষ্ট্রপক্ষের আপীলে তা স্থগিত হয়ে যাওয়ায় গত এক বছরেও মুক্তি পাননি গোলাম সারওয়ার। রাষ্ট্রপক্ষের আপীল শুনানিটি অবশেষে খারিজ হয়ে গেলে গোলাম সারওয়ারের জামিনে মুক্তির বাঁধা দূর হয়। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত তিন সদস্যের আপিলেট ডিভিশন বেঞ্চের শুনানীতে মাননীয় প্রধান বিচারপতি কিছু মূল্যবান মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘সবার আগে দেশের ইমেজ, কারো লেখায় দেশের ইমেজ ক্ষুন্ন হলে ভবিষ্যতে জামিনের জন্য গ্রহণ করা হবে না’। দেশের ইমেজ বা ভাবমর্যাদা ক্ষুন্নের ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতির এ বক্তব্যের সাথে বিরোধীদল থেকে শুরু করে সুশীল সমাজ একমত হয়েছেন। তবে আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বক্তব্যটি আরও স্পষ্ট হলে ভাল হতো। কি ধরনের কর্মকান্ডে দেশের ভাবমর্যাদা ক্ষুন্ন হয়, এ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের মতামত রয়েছে। বিষয়টি দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করে। ফলে ভাবমর্যাদা ক্ষুন্নের বিষয়টি স্পেসিফিকলি ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এক্ষেত্রে অ্যাবস্ট্রাক্ট বা বিমূর্ত কোনো ধারণা থাকা বাঞ্চনীয় নয়। সংবিধানেও এ নিয়ে বলা আছে। এমনিতেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে জামিন অযোগ্য ধারা রয়েছে। গত দুই বছরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলার জামিন অগ্রাহ্য করার অনেক নজির রয়েছে। মুশতাক আহমেদ জামিন না পেয়ে কারাগারে মৃত্যুবরণ করেছেন। কার্টুনিস্ট কিশোর কারাগারে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে তিনি নিজে বলেছেন। সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে, তিনি নির্যাতনের শিকার হননি। এহেন বাস্তবতায় দেশের ইমেজ এবং লেখক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সীমারেখা স্পষ্ট হওয়া উচিৎ। আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, প্রধান বিচারপতির বক্তব্য নিম্ন আদালতে জামিন না দেয়ার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলার আশঙ্কা রয়েছে।

গতকাল ইংরেজী দৈনিক ডেইলি স্টার-এ প্রকাশিত মন্তব্য কলামে রাষ্ট্রের ইমেজ সংক্রান্ত মাননীয় প্রধান বিচারপতির মন্তব্যের বিশ্লেষণ করে তা নিয়ে সৃষ্ট যেকোনো অস্পষ্টতা ও ভুল বুঝাবুঝি অবসানে হাইকোর্ট ও প্রধান বিচারপতির হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করা হয়েছে। বিশেষত রাষ্ট্রের ইমেজ রক্ষা বলতে কি বুঝায়, তা পরিষ্কার করতে গিয়ে যেসব বিষয় তুলে ধরা হয়েছে তাতে বুঝা যাচ্ছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে রাষ্ট্রের ইমেজ রক্ষার কথা বলে জামিন অগ্রাহ্য করার প্রবণতা আরো বেড়ে যাওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। রাষ্ট্রের ইমেজ ক্ষুন্নের বিষয়টি একেক জনের কাছে একেক রকম অর্থ ও ব্যাখ্যার অবকাশ থাকায় তা বিতর্কিত হতে পারে। কোনো ব্যক্তি বা লেখকের স্বাধীনমত প্রকাশ পছন্দ না হলে অতি উৎসাহী যে কেউ ভাবমর্যাদা ক্ষুন্নের কথা উল্লেখ করে ডিজিটাল আইনের বিতর্কিত ধারার সুযোগ নিতে পারেন। প্রধান বিচারপতি যে অর্থে রাষ্ট্রের ইমেজ রক্ষার কথা বলেছেন, তাতে কারো দ্বিমত থাকার কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু রাষ্ট্রের ইমেজের বিষয়টি নানাভাবে বিশ্লেষণের সুযোগ থাকায় এ নিয়ে একটি সুস্পষ্ট ধারণা ও ব্যাখ্যা এখন জরুরী হয়ে পড়েছে। ডেইলি স্টারের মন্তব্য প্রতিবেদনে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, প্রমানিত বা ঘটমান বাস্তবতায় যদি রাষ্ট্রের ইমেজ সম্পর্কে বিরূপ ধারণা তৈরী করে তা নিয়ে লেখা বা প্রতিবেদন তৈরী করলে তা ‘ইমেজ ক্ষুন্ন’র দায়ে অভিযুক্ত হবে কিনা। এ ক্ষেত্রে সরকারের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ২০৪০ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশের রূপরেখা এবং ক্লাইমেট চেঞ্জের কারণে আগামী দুই দশকে দেশের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ভূমি সমুদ্রে তলিয়ে গিয়ে কোটি কোটি মানুষের জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিনত হওয়াকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। এসব বিষয় নিয়ে মন্তব্য বা লেখালেখি ভাবমর্যাদা ক্ষুন্ন’র বিষয়টি জড়িত কিনা, তারও ব্যাখ্যার দাবী রাখে। আমরা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বসবাস করি, মানবাধিকার সনদের প্রতিও আমরা অঙ্গিকারাবদ্ধ। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মত বিতর্কিত আইনে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে দেশে-বিদেশে তুমুল বিক্ষোভ-প্রতিবাদ চলছে. তখন প্রধান বিচারপতির একটি সরল ও ইতিবাচক মন্তব্যকে যেন কেউ এই আইনের অপব্যবহারের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে না পারে, তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন


আরও
আরও পড়ুন