পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
এটা মার্চ মাস। মুক্তিযুদ্ধের মাস। স্বাধীনতার মাস। এই মাসে মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার ওপর অনেক লেখালেখি হবে, এটাই স্বাভাবিক। অতীতেও হয়েছে। এবারেও হবে। লেখালেখি ছাড়াও অনেকে মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার স্মৃতিচারণ করবেন। যারা লেখক নন, কিন্তু এ সম্পর্কে কিছু বলতে চান, তাদের বক্তব্য অন্য কেউ অনুলেখন করবেন।
যথারীতি অন্যান্য বছরের মতো এবছরও মার্চ মাস আসতে কি-না আসতেই স্বাধীনতা সংগ্রামের ওপর লেখালেখি এবং স্মৃতিচারণ শুরু হয়ে গেছে। তেমনি একটি স্মৃতিকথন আমার দৃষ্টি আর্কষণ করেছে। এটি ছাপা হয়েছে ৪ মার্চ একটি জাতীয় দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায়। শিরোনাম, ‘ইতিহাস অবিকৃত রাখুন / নূরে আলম সিদ্দিকী’। নূরে আলম সিদ্দিকী মুক্তিযুদ্ধকালে ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল আজ থেকে ৫০ বছর আগে। তাই এখনকার প্রজন্ম ঐসব দিন দেখেন নাই। তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে খবরের কাগজ, বইপত্র, টেলিভিশন অনুষ্ঠান প্রভৃতির মাধ্যমে জানতে পারছেন। আর জানতে পারছেন তাদের কাছ থেকে শুনে, যারা মুক্তি যুদ্ধকালে যুবক বা প্রৌঢ় ছিলেন এবং আজও বেঁচে আছেন। মুক্তিযুদ্ধের ৪/৫ বছর আগে এবং মুক্তিযুদ্ধকালে মাঠের রাজনীতি যারা নিয়ন্ত্রণ করতেন তাদের কয়েকজন হলেন, তোফায়েল আহমদ, শেখ ফজলুল হক মনি, কে এম ওবায়দুর রহমান, সিরাজুল আলম খান, আ স ম আব্দুর রব, আব্দুল কুদ্দুস মাখন, নূরে আলম সিদ্দিকী, শাহ্জাহান সিরাজ প্রমুখ। আমি এখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম উল্লেখ করি নাই। কারণ মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার সমগ্র পটভ‚মি তো তিনিই রচনা করেছিলেন এবং সমগ্র সংগ্রাম এবং যুদ্ধও তো তার নামেই হয়েছে।
স্বাধীনতার এক বছর পূরণের আগেই ছাত্রলীগ বিভিক্ত হয়। এক অংশের নেতৃত্বে ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি এবং শেখ শহীদুল ইসলাম। এর দুজনই বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধুর আপন ভাগনে। এ ছাড়াও ছিলেন নূরে আলম সিদ্দকী। আরও ছিলেন আব্দুল কুদ্দুস মাখন। ১৯৭০ সালে ডাকসুর সহসভাপতি (ভিপি) ছিলেন আ স ম আব্দুর রব এবং সাধারণ সম্পাদক (জিএস) ছিলেন আব্দুল কুদ্দুস মাখন। ছাত্রলীগের বিভক্তির ঢেউ অবধারিতভাবে এসে লাগে আওয়ামী লীগের ওপর। ছাত্রলীগের শেখ শহীদ এবং শেখ মনির অংশ ‘মুজিববাদী’ নামে পরিচিতি পায়। অপর অংশের নেপথ্য নেতা ছিলেন সিরাজুল ইসলাম খান। মুক্তিযুদ্ধের ৯ নং সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিলকে সভাপতি এবং আ স ম আব্দুর রবকে সাধারণ সম্পাদক করে গঠিত হয় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, জাসদ। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে শেখ মুজিবের ভূমিধ্বস বিজয় এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সর্বাত্মক বিজয়ের পর বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কোনো রাজনৈতিক দল ছিল না বললেই চলে। তেমন এক গভীর রাজনৈতিক শূন্যতায় অভ্যুদয় ঘটে জাসদের এবং অতি সহসাই আওয়ামী লীগের শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী দল হিসাবে দাঁড়িয়ে যায়। জাসদে আর যারা ছিলেন, তারা হলেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহ্জাহান সিরাজ, কর্নেল আবু তাহের, মোহাম্মদ শাহ্জাহান, হাসানুল হক ইনু, কাজী আরেফ আহমেদ, মনিরুল হক, শরীফ নূরুল আম্বিয়া প্রমুখ।
দুই
মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের পূর্বাপর লিখতে ওপরে যে কটি কথা বললাম সেটা ধান ভানতে শীবের গীত নয়। একটি জাতির ইতিহাসে এমন কিছু ঘটনা থাকে যেসব কথা কোনো দিনই ইতিহাসের পাতায় স্থান পায় না। আবার অনেক সময় কিছু ঘটনা লেখা থাকে, যেসব ঘটনার লেখকগণ ঐসব ঘটনা প্রকাশের ওপর এমবার্গো বা সাময়িক নিষেধজ্ঞা দিয়ে রাখেন। যেমন মওলানা আবুল কালাম আজাদের India Wins Freedom বইটি। বইটি লেখার পর মওলানা আজাদ বলে যান যে, তাঁর মৃত্যুর ৩০ বছর পর বইটি যেন প্রকাশ করা হয়, তার আগে নয়। আসলে ঘটেছেও তাই। তার মৃত্যুর ৩০ বছর পর বইটি প্রকাশিত হয়েছে। বাংলা নাম, ‘ভারত স্বাধীন হল’। এসব কথা বলতে হচ্ছে এজন্য যে, মি. সিদ্দিকী ঐ সাক্ষাৎকারে, জাসদ ও সিরাজুল আলম সম্পর্কে এমন সব উক্তি করেছেন, যা ইতিহাসের কষ্টিপাথরে কতটা সঠিক তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। এখানে আমি আমার ব্যক্তিগত অবস্থান পরিষ্কার করতে চাই। জাসদ এবং মি. খান সম্পর্কে আমার অনেক রিজার্ভেশন রয়েছে। তাদের রাজনীতিকে আমার গণতান্ত্রিক বলে কোনোদিনই মনে হয়নি। খান সাহেব সব সময় নেপথ্যে থাকতে পছন্দ করেন। তাই অনেকে তাকে রাজনীতির রহস্যপুরুষ বলে মনে করেন। জুনিয়রদের কাছে তিনি ‘দাদা’ নামেই পরিচিত। যে দলটি তিনি গঠন করেন তার নাম জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল। এর ইংরেজী নাম হলো National Socialist Party. তিনি কি জার্মান ডিক্টেটর হিটলারের নিকট থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন? কারণ, হিটলারের নাৎসী পার্টির নাম ছিল National Socialist German Workers Party বাংলায় জাতীয় সমাজতন্ত্রী জার্মান শ্রমিক দল। হিটলার বলতেন, জাতীয় সমাজতন্ত্রী। জাসদও জাতীয় সমাজতন্ত্রী। মি. খানের স্বাধীনতার পূর্বাপর কর্মকান্ডে ভায়োলেন্স বা সহিংসতার গন্ধ পাওয়া যায়।
কিন্তু তাই বলে তাকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অপকর্মে ‘নাটের গুরু’ এবং ‘নেপথ্যের খলনায়ক’ বলা যায় কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক দেখা দিতে পারে। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর বাসা অভিমুখে জাসদের যে মিছিল যায়, সেই মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণে বেশ কয়েক ব্যক্তি নিহত হন। এ ব্যাপারে জনাব সিদ্দিকী বলছেন, “সিরাজুল আলম খান অবোধ শিশুর সরলতা প্রদর্শন করে বঙ্গবন্ধুকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছেন যে ‘এটি জলিল রবের হঠকারিতা’। সরকার জাসদকে নিষিদ্ধ করলে ওদের ঔদ্ধত্য অবদমিত হবে।”
সাক্ষাৎকারের শুরুতে জনাব সিদ্দিকী বলেন, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ‘লালসায়’ ৭০-এর নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে একটি তথাকথিত এবং স্বকল্পিত সশস্ত্র বিপ্লবের দুঃস্বপ্নে বুঁদ হয়ে ৭০-এর নির্বাচনের আগে এরা শ্লোগান দিতেন, ‘নির্বাচনের কথা বলে যারা / ইয়াহিয়া খানের দালাল তারা’, ‘মুক্তির একই পথ / সশস্ত্র বিপ্লব’, ‘বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধর, পূর্ব বাংলা স্বাধীন কর’।
তিন
এই লেখাকে কেউ যদি যদি সিরাজুল আলম খানের সাফাই বলে মনে করেন, তাহলে তিনি ভুল করবেন। ইংরেজীতে একটি কথা আছে। সেটি হলো Put the record straight. অর্থাৎ ইতিহাসকে তার সঠিক স্থানে স্থাপন কর। সেটিই আমার উদ্দেশ্য। তবে সেই কাজটি সঠিকভাবে করতে গেলে এরকম একটি দুটি কলাম নয়, বরং একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ রচনা করতে হবে। তারপরেও কথা থাকে। কারণ, এমন কিছু প্রশ্ন থাকে যার কোনো উত্তর পাওয়া যায় না। যেমন ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সাথে আলোচনার জন্য পাকিস্তানের মিলিটারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসেন। তখন থেকে শেখ মুজিব এবং ইয়াহিয়া খান আলোচনা শুরু করেন। শেখ মুজিব বলেন, আলোচনা এগিয়ে যাচ্ছে এবং আলোচনা সন্তোষজনক। ৩/৪ দিন পর জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকায় আসেন। এই কয়দিন চলছিল দ্বিপক্ষীয় বৈঠক। দ্বিপক্ষীয় বৈঠক, অর্থাৎ শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়ার মধ্যে বৈঠক। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ভুট্টো এসে সেই বৈঠকে যোগ দেওয়ার পর শুরু হয় ত্রিপক্ষীয় বৈঠক। ২২ মার্চ শেষ বৈঠক হয়। ২১ মার্চেও বৈঠক শেষে বলা হয় যে, আলোচনা সন্তোষ গতিতে এগিয়ে চলছে। ২২ মার্চ আওয়ামী লীগ টিমের তরফ থেকে বলা হয় ‘আর আলোচনা না, আমরা ঘোষণা চাই’। No more discussion, we want declaration.
তখন বাংলাদেশ তথা সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ কোটি। এই সাড়ে ৭ কোটি মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন একটি আশার বাণী শোনার জন্য, একটি সন্তোষজনক সমাধানের জন্য। কিন্তু তার পরিবর্তে নেমে এলো ২৫ মার্চের কালো রাত্রি। বাংলাদেশের শিক্ষিত সচেতন মানুষ আজো জানে না, ঐ ৮ দিন বা ৯ দিন ধরে কী কী বিষয়ে আলোচনা হয়েছে? একদিন দুইদিন নয়, ৮ দিন ধরে কী কথা হলো তাদের মাঝে। ৮ দিন ধরে আলোচনার পর কোন পয়েন্টে আলোচনা ব্যর্থ হলো? লক্ষ মানুষের রক্ত ঝরেছে। মানুষকে জানতে হবে, কেন পাকিস্তানি সামরিক জান্তা বাংলাদেশের মানুষের ওপর বর্বর ও হিংস্রভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
চার
সিরাজুল আলম খান প্রসঙ্গ। তার উদ্ভাবিত শ্লোগান ছিল, ‘বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধর / বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘তোমার আমার ঠিকানা / পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘তুমি কে আমি কে, বাঙ্গালী বাঙ্গালী’। মেননপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন এবং তাঁর প্যারেন্ট সংগঠন ন্যাপ ৭০-এর নির্বাচন বর্জনের ডাক দিয়েছিল। তাদের শ্লোগান ছিল, ‘ভোটের বাক্সে লাথি মারো / পূর্ব বাংলা স্বাধীন করো’।
স্বাধীনতা উত্তর সিরাজুল আলম খানের তথা জাসদের ভ‚মিকা নিয়ে অনেক প্রশ্ন উত্থাপনের অবকাশ রয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতা পূর্ব সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধে তার ভূমিকা প্রশ্নাতীত। শেখ মুজিব ৭০-এর নির্বাচন করুন, তার পক্ষে খান সাহেবের বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল। সিরাজুল আলম খান একটি বই লিখেছেন। নাম, ‘আমি সিরাজুল আলম খান বলছি’। এই পুস্তকে এমন কিছু তথ্য আছে, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কিত অন্য কোনো পুস্তকে পাওয়া যায় না। এই পুস্তকে বর্ণিত কতিপয় তথ্যকে চ্যালেঞ্জ করেছেন আমীর হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, নূরে আলম সিদ্দিকী প্রমুখ। এই তিন নেতার উচিত, প্রকৃত সত্য তুলে ধরা। বাংলাদেশ টিকে থাকবে। ডক্টর কামাল হোসেন আজও জীবিত আছেন। তিনি ঐ ৮ দিনের ঘটনা বলুন।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।