পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
চীনের জীবনযাত্রা বাংলাদেশের চেয়ে ব্যয়বহুল, চীনা মুদ্রার মান সেটা নিঃসন্দেহে বুঝিয়ে দেয়। সেই হিসেবে চীনে সবকিছুর মূল্যমান বেশি হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমার এখানে কয়েক বছর থাকার অভিজ্ঞতায় তেমনটা মনে হইনি। বরং দেশের চেয়ে সাশ্রয়ীভাবে এখানে চলার সৌভাগ্য হয়েছে। কিছু কিছু প্রদেশ যেমন বেইজিং, সাংহাই ইত্যাদি অবশ্য ব্যতিক্রম। প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে চীন অনেক এগিয়ে থাকায় চীনাদের হাসপাতালের সেবা পদ্ধতিও অনেক আধুনিক এবং বেশ সাশ্রয়ী। চীনাদের হাসপাতালের সেবা পদ্ধতি তথা চিকিৎসা পদ্ধতি এবং তার মান নিয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু বিষয় তুলে ধরালাম:
চীনে এসে কেউ দীর্ঘ সময় থাকতে চাইলে তাকে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে হয়। স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রতিবেদন যাচাই পূর্বক ভিসা অফিস এদেশে থাকার অনুমোদন তথা রেসিডেন্স পারমিট দিয়ে থাকে। স্বাস্থ্য পরীক্ষায় সাধারণত কোনো গুরুত্বর রোগ বালাই আছে কিনা সেটা পরীক্ষা করা হয়। আমার স্ত্রী এবং বাচ্চা নিয়ে আসার পরে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য ঠিকানা মোতাবেক ‘ফুজো কাস্টমস’ কর্তৃক পরিচালিত ফুজিয়ান প্রদেশের ‘এন্ট্রি এক্সিট ইন্সপেকশান এন্ড কোয়ারেন্টাইন’ নামক প্রতিষ্ঠানে খুব সকালে গিয়ে হাজির হই। বলে রাখা ভালো, ওই প্রতিষ্ঠানটিতে শুধুমাত্র বিদেশি নাগরিক যারা চীনে রেসিডেন্স পারমিটের জন্য আবেদন করবেন এবং স্থানীয় নাগরিক যারা দেশের বাইরে যাবেন তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্যই প্রয়োজনীয় সেবার ব্যবস্থা আছে। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটিতে আলাদা কোন রোগী নেই। সব সুস্থ মানুষই এসে তাদের পরীক্ষার নমুনা দিয়ে চলে যাচ্ছেন বা কেউ কেউ রিপোর্ট নিতে এসেছেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি দেখলে যেকেউ হাসপাতাল মনে করবেন। বিশাল বিল্ডিংয়ের এক একটা ফ্লোরে চলছে এক এক ধরনের নমুনা সংগ্রহ এবং সেটার প্রসেসিংয়ের কাজ।
আমরা গিয়ে আমার স্ত্রীর স্বাস্থ্য পরীক্ষার নমুনা দিয়ে এবং প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করিয়ে ফিরে আসলাম। বেশ কিছু পরীক্ষা করা লাগে ওখানে। এক্সরে, আলট্রাসাউন্ড, ইসিজি, রক্তের কয়েকটি পরীক্ষা সহ ইউরিন পরীক্ষা। সব মিলিয়ে ফিস ছিল ৪২০ ইউয়ান (৫০০০ টাকার মতো)। বাচ্চা ছোট হওয়ায় ওর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা লাগেনি। ৩ দিন পরে রিপোর্ট সংগ্রহের তারিখ ছিল। নির্ধারিত দিনে রিপোর্ট হাতে পেয়ে একটু খারাপই লাগল। রিপোর্টে একটু গড়মিল দেখলাম। আল্ট্রাসাউন্ডের রিপোর্টে পিত্তথলিতে ছোট ছোট পাথর আছে এমনটা লেখা দেখলাম। রিপোর্ট দেখেই আমি একটু চিন্তিত হয়ে কয়েকজন পরিচিত বন্ধুর সাথে কথা বললাম। প্রথম দুঃশ্চিন্তা ছিল এরকম মেডিকেল রিপোর্ট দেখে ভিসা অফিস রেসিডেন্স পারমিট দিবে কিনা। কিন্তু সবাই বলল ‘এরকম রিপোর্টে রেসিডেন্স পারমিট আটকাবে না, রেসিডেন্স পারমিট পেয়ে যাবেন’। পরের দিন ভিসা অফিসে গেলাম এবং কর্তৃপক্ষ কাগজপত্র যাচাই বাছাই সাপেক্ষে পাসপোর্ট জমা নিল। অর্থাৎ রেসিডেন্স পারমিট হবে, এটা মোটামুটি কনফার্ম হলাম। কেননা কাগজপত্রে কোনরকম ত্রুটি থাকলে ভিসা অফিস পাসপোর্ট জমা রাখে না। সেজন্য কর্তৃপক্ষ কাগজপত্র যাচাই করে পাসপোর্ট জমা নেওয়া মানে রেসিডেন্স পারমিট হবে, ধরে নেওয়া যায়। একটু হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাসায় ফিরলাম। ফিরেই চিন্তা করলাম যে সমস্যাটা ধরা পড়েছে সে বিষয়টা নিয়ে এখানকার ডাক্তারের সাথে কথা বলতে হবে এবং ট্রিটমেন্ট নিতে হবে।
‘আরিফ’ ভাই আগে থেকেই আমাদের পরিচিত। এখানে এমবিবিএস শেষ করে ফুজিয়ান মেডিকেল ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স করছেন। ডাক্তার দেখানোর ব্যাপারে ওনার সাথে বিস্তারিত আলোচনা করলাম। উনি আমাদের একটা এপোইন্টমেন্ট দিলেন। আমরা নির্ধারিত দিনে খুব সকালে গিয়ে হাজির হলাম। হাসপাতালটি ফুজিয়ান প্রদেশের সবথেকে বড় সরকারি হাসপাতাল। বেশ লোকের ভিড় লক্ষ করলাম। চীন যেহেতু প্রযুক্তিতে অনেক এগিয়ে তাই হাসপাতালে গিয়ে খেয়াল করলাম, সব উন্নত প্রযুক্তির ছোঁয়া। আরিফ ভাই ভালো চাইনিজ বলতে পারে। ডাক্তার দেখানোর আগে বেশ কিছু প্রক্রিয়া ছিল ওখানে। সেই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে চাইনিজ ভাষার দক্ষতা ছাড়া একটু কষ্টকর। সেক্ষেত্রে আরিফ ভাইয়ের চাইনিজ ভালোই কাজে দিল।
হাসপাতালে রোগী দেখানোর প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে আমাদের একটা কার্ড করতে বলা হলো। সব রোগীদের জন্য হাসপাতালে কার্ড করা বাধ্যতামূলক। ওই কার্ডটাই রোগীর যাবতীয় ডকুমেন্টের হিসাব। অর্থাৎ রোগের বর্ণনা, ডাক্তারের ট্রিটমেন্ট, কী কী ওষুধ প্রেসক্রাইব করা হয়েছে সব তথ্য ওই কার্ডে রক্ষিত থাকে। হাসপাতালের যাবতীয় আর্থিক লেনদেন ও ওই কার্ডের মাধ্যমে হয়ে থাকে। অর্থাৎ ডাক্তারের ফিস, টেস্টের ফিস, ওষুধের টাকা সব কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন হয়। কার্ডটা দেখতে হুবুহু ব্যাংকের এটিএম কার্ডের মতো তবে ব্যাংক কার্ডে শুধুমাত্র আর্থিক লেনদেন করা গেলেও ওই কার্ডে আছে আরও অনেক সুবিধাদি।
আমরা কার্ড করানোর সময় কার্ডে কিছু টাকা জমা দিলাম। কেননা ডাক্তার দেখানোর জন্য লাগবে। এরপরের কাজটুকু ছিল একবারে তড়িৎ গতিতে। অর্থাৎ সবকিছু প্রযুক্তি নির্ভর। হাসপাতালে এটিএম বুথের মতো কিছু সেলফ সার্ভিস মেশিন আছে। সেখানে কার্ড পাঞ্চ করে ডাক্তারের সিরিয়াল নেওয়া, রিপোর্ট নেওয়া, ওষুধ নেওয়া সবকিছু করা যায়। আমরা কার্ড বুথে পাঞ্চ করালাম। নির্দিষ্ট অপশনে গিয়ে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের লিস্ট চলে এলো। এরপর একজন ডাক্তার সিলেক্ট করলাম। মেশিন থেকে ছোট্ট একটা টোকেনে সিরিয়াল নাম্বার প্রিন্ট হয়ে চলে এলো। এর অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে রাখা স্ক্রিনে রোগীর নাম দেখিয়ে ডাক্তারের চেম্বারে ডাক পড়ল। ডাক্তারের রুমে যাওয়ার পরে আমাদের বসতে বলতে বলতে উনি কার্ডটা সামনের কম্পিউটারের সাথে যুক্ত করা ছোট্ট একটি মেশিনে পাঞ্চ করলেন। এরপর ভিসা করানোর আগের করা সেই রিপোর্টটা ডাক্তারকে দেখালাম। ডাক্তার রোগের লক্ষণ নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন করলেন আমার স্ত্রীর কাছে। সব মিলিয়ে প্রায় ২০ মিনিট সময় ধরে রোগের খুঁটিনাটি নিয়ে খুটিয়ে খুটিয়ে শুনলেন। পিত্ত থলির পাথর একটু হলেও ভাববার বিষয়। ডাক্তারকে সেটাই ভালোভাবে বুঝালাম। বললাম, আরেকবার টেস্ট করানোর জন্য। ডাক্তার আমাদের কথায় কর্ণপাত করলেন না। ওনার একই কথা যেহেতু রোগীর কাছে রোগের কোনো লক্ষণ নেই সেহেতু কিছুই করা লাগবে না। কোনো ওষুধও লাগবে না। আর যদি আপনাদের আবার টেস্ট করাতেই মন চায় তাহলে এখন না ছয় মাস পরে এসে একবার টেস্ট করাতে পারেন। তবে এসব রোগের কোনো লক্ষণ প্রকাশ না হলে আমরা কোনো ট্রিটমেন্ট সাজেস্ট করি না।
আমরা কোনো রকম ওষুধ এবং টেস্ট ছাড়া ফিরে এলাম। ডাক্তারের ফিস হয়েছে ২৫ ইউয়ান (৩০০ টাকার মতো)। এত কম টাকায় এত ভালো সার্ভিস দেখে আমরা একটু অবাক হলাম। সবচেয়ে বেশি অবাক হলাম ডাক্তারের আন্তরিকতা দেখে। যেটা দেশে এক হাজার টাকার ফিসেও খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কার্ডে জমা করেছিলাম ২০০ ইউয়ান। বাকি টাকা কার্ড থেকে উইথড্রো করে বাসায় ফিরলাম। ঠিক ছয় মাস পরে আমরা আবার একই হাসপাতালে গেলাম। ওই একই ডাক্তারের সিরিয়াল নিয়ে ওনার কাছে গেলেই, উনি কার্ড পাঞ্চ করার পরে কম্পিউটার স্ক্রিনে আগে থেকে সেভ করে রাখা রোগের বর্ণনা দেখে সব বুঝতে পারলেন। আবার জিজ্ঞাসা করলেন, রোগের কোনো লক্ষণ গেল ছয় মাসে প্রকাশ পেয়েছে কিনা। আমরা না বলায় উনি বললেন ‘এটা নিয়ে উদবিঘ্নের কিছুই নেই। এটাতে কোনো সমস্যা হবে না’। আমরা আবারো ডাক্তারকে আরেকবার টেস্টের জন্য বললাম। উনি টেস্ট দিতে নারাজ। তারপরেও আমাদের জোরাজুরিতে আল্ট্রাসাউন্ড টেস্ট দিলেন।
টেস্ট করাতে গেলে সেখানে অপেক্ষারত নার্স এবং ডাক্তার খুবই দ্রুততার সাথে হেলথ কার্ডটা তাদের ওখানে রাখা কম্পিউটারের সাথে যুক্ত করে বুঝে নিলেন শরীরের কোনো স্থানে আল্ট্রাসাউন্ড করাতে হবে। কোনো রকম সিরিয়াল ছাড়াই ৫ মিনিটের মধ্যেই টেস্ট সম্পন্ন হলো। এরপর আবারো হেলথ কার্ড পাঞ্চ করে এটিএম বুথের মতো মেশিন থেকে সাথে সাথে রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলাম। হ্যাঁ, এখানেও একই ফলাফল। পিত্তথলিতে খুব ছোট ছোট কিছু পাথর আছে। ডাক্তার বললেন, এটা অনেকের থাকে। কারও লক্ষণ প্রকাশ পেলে আমরা অপারেশনে চলে যাই। কিন্তু লক্ষণ না থাকলে এটার কোনো ওষুধ লাগে না। অনেকের এটা সারাজীবনেও প্রকাশ পায় না। যেহেতু রোগীর কোনো লক্ষণ এখনো প্রকাশ পায়নি, সেহেতু এটা নিয়ে আমাদের ঘাবড়ানোর কিছু নেই। আমরা আবারও হাসপাতাল থেকে কোনো রকম ওষুধ ছাড়াই চলে এলাম। ফেরার সময় দেখলাম ডাক্তার যেসব রোগীদের ওষুধ প্রেস্ক্রাইব করেছেন, তারা তাদের হেলথ কার্ড পাঞ্চ করেই মেশিন থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওষুধ পেয়ে যাচ্ছেন। রোগীর কী পরিমাণ ওষুধ দরকার সেটা ওখানে সিলেক্ট করার পরে কার্ড থেকে ওষুধের মূল্যমানের সমপরিমাণ টাকা কেটে খুবই সহজে ওষুধের প্যাকেট হাতে এসে পড়ছে।
সরকারি একটা হাসপাতালে এসব অত্যাধুনিক বিষয় দেখে তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার চিত্র চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। আমার মনে আছে, একবার ঢাকার ‘ল্যাব এইড’ এ গিয়েছিলাম ডাক্তার দেখাতে। ১০০০ টাকা ফিস দিয়ে সন্ধ্যা ৭টায় টাইম দেয়ার পরে রাত ১০.৩০ এ গিয়ে ডাক্তারের দেখা পেয়েছিলাম। সব মিলিয়ে হয়ত মিনিট খানিকের মতো ডাক্তারের চেম্বারে সময় কাটিয়েছিলাম। ডাক্তার সাহেবের তখনও অনেক রোগী দেখা বাকি ছিল। তাই ডাক্তারের হাতে রোগের বর্ণনা শোনার মতো সময় ছিল না। শুধুমাত্র নাম এবং বয়স শুনেই প্রেস্ক্রিপশানের বাম পাশে একের পর এক লিখে দিয়েছিলেন সবমিলিয়ে গোটা দশেকের মতো টেস্ট। ওনার কথা ছিল টেস্ট করিয়ে রিপোর্ট নিয়ে আসেন, তারপরে বিস্তারিত শুনব।
রোগ ধরতে গেলে টেস্টের কোনো বিকল্প নেই। সেটা আমরা সবাই জানি। কিন্তু ওইদিনের ডাক্তার সাহেবের লেখা টেস্টগুলো রোগ ধরার জন্য ছিল কিনা সেটা আজও আমার মনে প্রশ্ন জাগে। সবগুলো টেস্ট ওখানেই করালাম। উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা ছিল আমার। সেজন্য বেশিরভাগ টেস্টই ছিল এক্সারসাইজ ধরনের। টেকশিয়ানরা টেস্টের জন্য হেল্প করল। টেস্ট রিপোর্টের নিচে লেখা ডাক্তার নিজেই টেস্ট করেছেন। যদিও সেসময়ে ডাক্তার নিজস্ব চেম্বারে রোগী দেখায় ব্যস্ত ছিলেন। পরেরদিন রিপোর্ট নিয়ে আবার ডাক্তারের কাছে গেলাম। সেদিনও লম্বা সিরিয়াল। ঘণ্টা দুই বসে থাকার পরে ডাক্তারের নাগাল পেলাম। রিপোর্ট দেখে নিচের অংশে যেখানে ওনার নাম ছিল সেখানে আগে স্বাক্ষর করলেন। জানলেন রিপোর্ট সব নরমাল আছে। এরপর একে একে ছয় ধরনের ওষুধ প্রেসক্রাইব করলেন। এবারের ফিস ৫০০ টাকা (মূল ফিসের অর্ধেক)।
ডাক্তারের প্রেস্ক্রাইব করা ওষুধ ১৫ দিন খাওয়ার পরে আমি আরও অসুস্থতা বোধ করতে লাগলাম। উচ্চ রক্তচাপ তো নিয়ন্ত্রণে আসেইনি, বরং আরও কিছু খারাপ উপসর্গ দেখা দিল। অবস্থার অবনতি দেখে আবারো একই ডাক্তারের কাছে গেলাম। পূর্ণ ফিস দিয়ে সমস্যা বলাতে আরও দুইটা ওষুধ বাড়িয়ে দিলেন। ডাক্তার সাহেব খুব ব্যস্ত একজন মানুষ। রোগীর কাছে ঠিকমত সমস্যা শুনে ওষুধ প্রেস্ক্রাইব করার মতো সময় ওনার হাতে বরাবরই কম। এদিকে আমি বাড়তি ওষুধ খেয়েও কোনো উন্নতি দেখতে পেলাম না। এরপর সকল রিপোর্ট নিয়ে অন্য একজন ডাক্তারের শরণাপন্ন হলাম। এতক্ষণ যার বর্ণনা দিলাম, উনি ছিলেন খুবই নামকরা, ডিগ্রিধারী একজন ডাক্তার। কিন্তু পরের ডাক্তারের ডিগ্রী অত বেশি ভারী ছিল না। ফিস ছিল ৫০০ টাকা। বেশ সময় নিয়েই উনি দেখে সব ওষুধ পরিবর্তন করে দিলেন। ওনার প্রেস্ক্রাইব করা ওষুধ খেয়েই আমি বেশ সুস্থ বোধ করতে লাগলাম।
ঘটনা দুইটি খুবই সংক্ষেপে এখানে বলার কারণ একটাই। সেটা হচ্ছে চীনাদের হাসপাতালের সেবা পদ্ধতির সাথে আমাদের চিকিৎসা পদ্ধতির সামান্য তুলনা করা। চীনে ৩০০ টাকায় সরকারি হাসপাতালে যে সেবা পাওয়া যায়, সেটার নিশ্চয়তা আমাদের দেশের ভালো মানের বিশেষায়িত কোনো হাসপাতালেও সম্ভব নয়। আমার বেশ কয়েকজন চীনা চিকিৎসকের সাথে খুব ভালো বন্ধুত্ব আছে। বলতে গেলে প্রায় সপ্তাহান্তে আমরা একসাথে বেশ পারিবারিক সময় কাটাই। ইন্টারনাল মেডিসিনে বিশেষজ্ঞ একজন ডাক্তার আমাদের খুবই ঘনিষ্ঠ। আমার স্ত্রীর পিত্ত থলির পাথরের ব্যাপারে একদিন ওনাকে জিজ্ঞাসা করলে উনি রিপোর্ট দেখতে চাইলেন। রিপোর্ট দেখে পূর্বের ডাক্তারের ন্যায় একই কথার পুনরাবৃত্তি করেছিলেন। খুব ভালো স্নোকার খেলেন এই ডাক্তার বন্ধু। প্রতিদিন সন্ধ্যায় বের হয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে, খেলাধুলা শেষে রাতে বাসায় ফেরেন। ডিউটির বাইরে ওনাকে এত ফ্রি সময় কাটাতে দেখে আমি একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলাম, উনি ডিউটির বাইরে রোগী দেখেন কিনা। উনি বলেছিলেন, চীনে সরকারি ডাক্তারদের প্রাইভেট প্রাকটিস নিষিদ্ধ। অর্থাৎ কোনো ডাক্তার প্রাইভেটভাবে রোগী দেখতে পারেন না। যে হাসপাতালে উনি কর্মরত শুধুমাত্র সপ্তাহে পাঁচদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ওখানে রোগী দেখেন। বাকি সময় খেলাধুলায় বা পরিবারকে সময় দেন। সাথে আরও বললেন, সরকার যথেষ্ট বেতন দেয় ওনাদের। সেটাই জীবনধারণের জন্য যথেষ্ট। আর হাসপাতালগুলোতে ভালো সেবার নিশ্চয়তা পাওয়ার কারণে প্রাইভেটভাবেও তেমন কেউ দেখাতে আসে না। সেজন্য এখানে প্রাইভেট ক্লিনিকও সচারাচার খুঁজে পাওয়া যায় না।
ডাক্তারের ধর্ম রোগীর সেবা করা। মানবতার সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দেন ডাক্তাররা। কিন্তু বেশ কিছু ডাক্তারের কারণে দেশের পুরো চিকিৎসা সেবা মাঝেমধ্যে অনেকটা হুমকির মুখে পড়ে যায়। যাদের ঘণ্টার আয় দেশের একজন সরকারি চাকরিজীবীর পুরো মাসের বেতনের সমান। সরকারি হাসপাতালগুলোর সেবার মান নিয়েও আছে নানান প্রশ্ন। সরকারি হাসপাতালগুলো থেকে পাওয়া পদবী ডাক্তাররা এখন নিজেদের প্রোফাইলকে ভারী করে প্রাইভেট প্রাকটিসে ব্যবহার করেন। ব্যস্ত থাকেন রোগীর টেস্টের সংখ্যা বাড়িয়ে সেখানে কমিশন পেতে। তারা একবারও ভাবেন না, দেশে অধিকাংশ মানুষের প্রাইভেট ক্লিনিকে মাসে একবার ডাক্তার দেখাতে পুরো মাসের সংসার চালানোর হিসাবে গড়মিল দেখা দেয়। তারা ভাবেন না, একজন খেটে খাওয়া গরিব মানুষের ৫০০ টাকা জোগাড় করতে গেলে সারাদিনেও পার পায় না। যারা অন্তর দিয়ে অনুভব করতে শেখে শুধুমাত্র তাদের কাছেই ডাক্তারি পেশা মহান। যদি সকল ডাক্তার একটু সময় নিয়ে রোগীর থেকে সমস্যাগুলো শুনে তারপরে টেস্ট এবং ওষুধ প্রেস্ক্রাইব করেন তাহলে দেশের চিকিৎসা সেবার মান অনেকাংশে এগিয়ে যাবে, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
লেখক: গবেষক, ফুজিয়ান এগ্রিকালচার এন্ড ফরেস্ট্রি ইউনিভার্সিটি, ফুজো, ফুজিয়ান, চীন।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।