Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রাজধানীতে বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট

প্রকাশের সময় : ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ঢাকা ওয়াসার সরবরাহকৃত পানির মান নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন রয়েছে। সাম্প্রতিককালে এই প্রশ্ন গুরুতর আকারে দেখা দিয়েছে। রাজধানীবাসীর পানি সরবরাহের একমাত্র প্রতিষ্ঠান ঢাকা ওয়াসার পানির ওপর ন্যূনতম ভরসা করার কোনো উপায় নেই। পানি দুর্গন্ধযুক্ত। পানিতে ময়লা-আবর্জনা-কেচো ইত্যাদি পাওয়া যাচ্ছে। নতুন উপসর্গ হিসেবে এমন কিছুর মিশ্রণও লক্ষ্য করা যাচ্ছে যাতে পানি পান তো দূরের কথা ওযু-গোসলেও ব্যবহার করা যাচ্ছে না। পানি ব্যবহারের ফলে হাত-মুখ-গায়ে জ্বালপোড়া এমনকি চর্মরোগও হচ্ছে। অধিকাংশ এলাকাতেই পানি পান ও ব্যবহার যোগ্যতা হারিয়েছে। এমনিতেই প্রয়োজনের তুলনায় পানির সরবরাহ কম, তার ওপর ময়লা-আবর্জনা ও দুর্গন্ধময় পানি সরবরাহের কারণে মানুষের দুর্ভোগ, বিড়ম্বনা, দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। বিশুদ্ধ পানির বিকল্প উৎস না থাকায় এই দূষিত ও ব্যবহার অযোগ্য পানিই পান ও ব্যবহার করতে বাধ্য হতে হচ্ছে। এর ফলে অনিবার্যভাবে চর্মযোগ ছাড়াও ডায়রিয়া ও নানারকম পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হতে হচ্ছে। বিশুদ্ধ পানির কোনো বিকল্প না থাকলেও ঢাকা ওয়াসা যেমন অতীতে তার নিশ্চয়তা দিতে পারেনি, এখনও দিতে পারছে না। এখনকার অবস্থা আরও শোচনীয়। জানা যায়, ঢাকা ওয়াসার পানির প্রধান উৎস গভীর নলকূপ। সরবরাহকৃত পানির প্রায় ৮০ শতাংশ আসে এই উৎস থেকে। বাকি পানির উৎস সায়েদাবাদ ও চাঁদনিঘাট শোধনাগার। শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গার পানি শোধন করে এই দুই শোধনাগার থেকে সরবরাহ করা হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গার পানি এতই দূষিত যে, শোধন করেও পান ও ব্যবহারযোগ্য করা যায় না। পানি শোধনে মাত্রাতিরিক্ত কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। এতে পানি অনেক সময় দুর্গন্ধময় হয়ে ওঠে এবং তা ব্যবহারে চোখে-মুখে-গায়ে জ্বালাপোড়া করে। পানির পান ও ব্যবহারযোগ্যতা হারানোর আরও একটি বড় কারণ, পুরনো ও জরাজীর্ণ লাইন, যা দিয়ে সহজেই ময়লা-আবর্জনা- কেচো, পয়োবর্জ্য পানিতে মিশে যায়। বাসাবাড়িতে অবস্থিত পানি সংরক্ষণাগার নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না করাও পানি দূষণের একটি উল্লেখযোগ্য কারণ।
বলা হয়, পানির অপর নাম জীবন যদি সেই পানি বিশুদ্ধ হয়। পানি বিশুদ্ধ না হলে তা হয়ে ওঠে রোগ-ব্যাধি এমন কি মৃত্যুর কারণ। বিশেষজ্ঞদের মতে, মানবদেহের শতকরা ৭৫ ভাগ রোগের কারণ পানি। বলাবাহুল্য, দূষিত পানি। বিশুদ্ধ পানির নিশ্চয়তা বিধান করা সম্ভব হলে মানুষ ৭৫ শতাংশ রোগ থেকে মুক্ত থাকতে পারে। বিপুল অংকের চিকিৎসা ব্যয় থেকে রেহাই পেতে পারে। ওয়াকিবহাল মহলের অজানা নেই, পানির প্রাকৃতিক উৎসকে কেন্দ্র করেই মানবসভ্যতাগুলো গড়ে উঠেছে। পানি যেখানে সহজপ্রাপ্য হয়েছে, সেখানেই জনবসতি গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। ইতিহাসবিদদের অনেকের ধারণা, পানির অভাব ও পানির দূষণ কিংবা বিশুদ্ধ পানির সংকটে অনেক সভ্যতা ও বসত বিলীন হয়ে গেছে। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য, স্বাচ্ছন্দ্য জীবনযাপনের জন্য পানির অপরিহার্যতা প্রশ্নের অতীত। এককালে পানির প্রাকৃতিক উৎসহসমূহ থেকে বিশুদ্ধ ও নিরাপদ পানির যোগান আসতো। এখন সে অবস্থা নেই। নানা কারণে পানির প্রাকৃতিক উৎসের সংখ্যা যেমন হ্রাস পাচ্ছে তেমনি অধিকাংশ ক্ষেত্রে পানির উৎসগুলো দূষণের শিকার হচ্ছে। ফলে বিশুদ্ধ পানির সংকট কেবল আমাদের দেশেই নয়, বিশ্বজুড়েই বৃদ্ধি পাচ্ছে। আশংকা করা হচ্ছে, ভবিষ্যতে বিশুদ্ধ পানির সংকট ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। ফলে বহু সভ্যতা ও বসতি অস্তিতের গভীর সংকটে নিপতিত হতে পারে। সভ্যতা ও বসতির এই আশংকিত সংকট মোকাবিলায় বিশ্বজুড়ে সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশুদ্ধ পানির নিশ্চয়তা বিধানে নানা উদ্যোগ ও কর্মসূচি নেয়া হচ্ছে। আমাদের দেশে এ ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ লক্ষ্যগোচর নয়। তেমনি বিশুদ্ধ পানির নিরাপত্তা গড়ে তোলার পদক্ষেপও দেখা যাচ্ছে না।
একথা স্বাভাবিকভাবেই বলা যায়, এই রাজধানী নগরে যদি পান ও ব্যবহারযোগ্য পানি না পাওয়া যায় তাহলে দেড় কোটি মানুষের বিশাল বসতিটি থাকবে না। মানুষ এ শহর ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হবে। ইতিহাসে পরিত্যক্ত নগরের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে শত শত বছরে গড়ে উঠা এই নগর। আমরা সেটা চাইনে, চাইতে পানি না। সে কারণেই এই নগরের অধিবাসীর জন্য বিশুদ্ধ পানির সংস্থান নিশ্চিত করতে হবে। পানির নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এটা প্রমাণিত, ঢাকা ওয়াসা এ নগরবাসীর পানির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অপারগ। এ মুহূর্তে যেখানে প্রতিদিন অন্তত ২৩০ কোটি লিটার পানির প্রয়োজন সেখানে ঢাকা ওয়াসা সরবরাহ করতে পারছে ২১০ কোটি লিটার। তাও সেই পানির ওপর নির্ভর করার উপায় নেই। ঢাকা ওয়াসা পানির জন্য যে উৎসটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করছে সেই গভীর নলকূপেও এমন এক সময় আসতে পারে যখন পানি পাওয়া যাবে না। ভূগর্ভ থেকে নির্বিচারে পানি উত্তোলনের ফলে প্রতি বছর ঢাকায় পানির স্তর তিন ফুট করে নিচে নেমে যাচ্ছে। এটাও একটা বিরাট আশংকার ব্যাপার। ঢাকায় পানিনিরাপত্তার নিশ্চিত করতে পানির বিকল্প উৎস যেমন সন্ধান ও ব্যবহার করতে হবে তেমনি ঢাকা ওয়াসার কার্যক্রম আরও বাড়াতে ও গতিশীল করতে হবে। এই মুহূর্তে ঢাকা ওয়াসাকে সরবরাহকৃত পানির বিশুদ্ধতা সংরক্ষণে মনোযোগ দিয়ে প্রয়োজনীয় কার্যব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যে কোনো মূল্যে বিশুদ্ধ পানির নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রাজধানীতে বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট
আরও পড়ুন