Inqilab Logo

শক্রবার ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ কার্তিক ১৪৩১, ০৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কুড়িয়ে পাওয়া ফুলের মেলা চট্টগ্রামে

কল-কাকলিতে মুখর ছোটমণি নিবাস

রফিকুল ইসলাম সেলিম | প্রকাশের সময় : ৭ মার্চ, ২০২১, ১২:০০ এএম

লাবিব, জয়, দুর্জয়, নাভান, ডিপজল, জারিন, আদনানসহ ওরা ৩০ জন। তাদের বয়স ১৫ দিন থেকে ৭ বছর। বেশ কয়েকজন দুগ্ধপোষ্য। কয়েকজন হামাগুড়ি দিচ্ছে, হাঁটতে শিখছে কেউ কেউ। এদের কারও সাথে কারও রক্তের সম্পর্ক নেই। যারা সযত্মে লালন-পালন করছেন তারাও শিশুদের আপন কেউ নন। সবাই কুড়িয়ে পাওয়া।

কাউকে পাওয়া গেছে হাসপাতালে কাউকে আবর্জনার ভাগাড়ে। কেউ আবার পথভুলে রাস্তায় হারিয়ে যাওয়ার পর এখানে আশ্রয় পেয়েছে। এ যেন কুড়িয়ে পাওয়া ফুলের মেলা। এসব শিশুর কল-কাকলিতে মুখর চট্টগ্রাম নগরীর রৌফাবাদের ছোটমণি নিবাস। সমাজকল্যাণ অধিদফতর পরিচালিত নিবাসে আশ্রয় পাওয়া শিশুরা খেলছে একসাথে।

কেউ সেখানেই পড়ালেখা করছে। কেউ আবার হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের অপেক্ষায় প্রহর গুণছে। দুগ্ধপোষ্য কয়েকজনকে দত্তক নেয়ার প্রক্রিয়াও চলছে। ছোটমণি নিবাস ঘুরে দেখা যায়, নবজাতকসহ ৩০ শিশু রয়েছে সেখানে। তাদের ১০ জন ছেলে শিশু, বাকিরা মেয়ে। সর্বশেষ এ নিবাসে ঠাঁই হয় নাবিলের। কয়েকদিন আগে চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গার একটি ময়লার ভাগাড় থেকে তাকে উদ্ধার করা হয়। জন্মের পরপর তাকে ছুঁড়ে ফেলা হয় ওই ভাগাড়ে। আদালতের নির্দেশনায় পুলিশ তাকে ছোটমণি নিবাসে রেখে যায়।

গেল বছর আরও তিনজন আসে সেখানে। তাদের মধ্যে এক বছর বয়সী জয়নাব জারিন সমবয়সী আদিল আদনান। চমেক হাসপাতালে জন্মের পর তাদের ফেলে যায় মা-বাবা। চিকিৎসক-নার্সদের সহযোগিতায় দীর্ঘদিন হাসপাতালে ছিল তারা। অবশেষে ঠাঁই হয় ছোটমণি নিবাসে। তাদের সাথে রোকেয়া রওনকও চমেক হাসপাতাল থেকে সেখানে আসে। তবে এক নিঃসন্তান দম্পতি তাকে দত্তক নিয়েছেন।

১৯৮০ সালে কুড়িয়ে পাওয়া শিশুদের লালন-পালন করতে ছোটমণি নিবাস চালু হয়। এ পর্যন্ত সেখানে ৪১৩ জন শিশু আসে। তাদের মধ্যে ৩৭৪ জনকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। মূলত তাদের দত্তক এবং হারিয়ে যাওয়াদের মা-বাবার কাছে ফিরিয়ে দেয়ার মাধ্যমে পুনর্বাসন করা হয়। বাকিদের সেখানে সাত বছর বয়স পর্যন্ত রেখে সমাজসেবা অধিদফতরের অধীনে পরিচালিত বালক-বালিকা কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে।

ছোটমণি নিবাসে শূন্য থেকে সাত বছর পর্যন্ত বয়সী শিশুদের আশ্রয় দেয়া হয়। তাদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ জন্মের পর মা-বাবা কর্তৃক ফেলে রেখে যাওয়া। নবজাতকসহ যেসব শিশু কেন্দ্রে আসার পর নাম রাখা হয়। হারিয়ে যাওয়া শিশুদেরও আশ্রয় দেয়া হয়। কেন্দ্রে পড়ালেখার সুযোগ পায় তারা। এসব শিশুদের দেখভাল করার জন্য আছেন তিনজন। তারা হলেন- মেট্রন কাম নার্স আফসানা ইসলাম, খালাম্মা শেফাতী জাহান এবং কোয়াট্রন সুমাইয়া খাতুন।

ছোটমণি নিবাসের কর্মকর্তারা জানান, অনেক শিশু এখানে ক্ষণিকের অতিথি হিসেবে আসে। জন্মের পর যাদের এখানে-সেখানে ফেলে যাওয়া হয় তাদের বিরাট অংশকে দত্তক নিয়ে যায় নিঃসন্তান দম্পতি। কোনো নবজাতক এখানে আসার পর অনেকে তাদের দত্তক নিতে আসেন। তবে আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে শিশুদের তাদের জিম্মায় দেয়া হয়। অবাঞ্ছিত হওয়ায় কিংবা কন্যা শিশু হওয়ায় অনেক মা জন্মের পর তাকে ছুঁড়ে ফেলে দেন। কিন্তু নিঃসন্তান অনেক দম্পতি তাদের হাহাকার মেটাতে পরম মমতায় এ শিশুদের কোলে তুলে নিচ্ছেন। শিশুরাও পরম যত্মে লালিত-পালিত হচ্ছেন নতুন পিতা-মাতার ঘরে।

ছোটমণি নিবাসের কর্মকর্তারা জানান, পছন্দ অনুযায়ী নিঃসন্তানরা এখান থেকে শিশুদের দত্তক নেন। কারও পছন্দ ছেলে শিশু, কারও মেয়ে শিশু। পতেঙ্গা থেকে আসা শিশু লাবিবকে নিতে বেশ কয়েকজন আবেদন করেছেন বলে জানা গেছে। আবার যারা হারিয়ে যাওয়া শিশুদের ঠিকানা পাওয়ার পর মা-বাবার কাছে বুঝিয়ে দেয়া হয়। যাদের কেউ দত্তক নেয়না কিংবা মা-বাবার ঠিকানা পাওয়া যায়না তারাই মূলত এখানে থেকে যায়।

সম্প্রতি সামিরা নামে এক রোহিঙ্গা শিশুকে হাটহাজারীর রাস্তায় পেয়ে উদ্ধার করে পুলিশ। পরে তাকে এ নিবাসে রাখা হয়। উখিয়ার ক্যাম্পে তার ঠিকানা জানার পর তাকে তার বোনের জিম্মায় দেয়া হয়। এছাড়া হারিয়ে যাওয়া শিশু নুরনবী ও মো. রনিকে নগরীর গণি কলোনী এলাকায় তাদের মা-বাবার কাছে পৌঁছে দেয়া হয়।

ছোটমণি নিবাসের উপ-তত্ত্বাবধায়ক নুরুন নাহার জান্নাতী বলেন, কুড়িয়ে পাওয়া শিশুদের নিয়েই ছোটমণি নিবাস। শূন্য থেকে সাত বছর বয়সী শিশুরাই মূলত এ নিবাসের সুবিধাভোগী। এসব শিশুদের স্বাস্থ্যসম্মতভাবে লালন-পালনের পাশাপাশি তাদের মেধা মননের বিকাশেও আমরা কাজ করছি। বেশিরভাগ শিশু এখানে আসে স্বল্প সময়ের জন্য। আর যাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা হয়না তারা এখানে সাত বছর বয়স পর্যন্ত থাকে। এরপর তাদের পাঠিয়ে দেয়া হয় সরকারি অন্য কোন প্রতিষ্ঠানে। সেখানে তারা পড়ালেখা করে কর্মজীবনে প্রবেশ করে। এ কেন্দ্রে একসাথে সর্বোচ্চ ৬২ জন পর্যন্ত শিশু ছিল।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চট্টগ্রাম

৩০ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ