পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
সাংবাদিকতা বা গণমাধ্যমের সঙ্গে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। তবে সাংবাদিকতার সুচনালগ্ন থেকে পেশাটি কখনো পুরোপুরি স্বাধীন ছিল, তা বলা যায় না। আমাদের দেশে স্বাধীন সংবাদিকতা সীমাবদ্ধতার মধ্যে বরাবরই ছিল, এখনও আছে। এটা সেই হাতে লেখা সংবাদপত্র থেকে শুরু করে আজকের তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে ঝকঝকে মুদ্রিত চাররঙ্গা পত্রিকা, টেলিভিশন, রেডিও, অনলাইন মিলিয়ে সবখানেই সীমাবদ্ধতার বেড়াজালে আটকে রয়েছে। এর মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার স্বাদ নেয়ার চেষ্টা করেছে। মানিয়ে চলেছে, তাল মিলিয়েছে। দেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে এই নিষ্ঠুর বাস্তবতা বিরাজিত।
ক্ষমতাসীনরা বরাবরই সমালোচনা সহ্য করতে পারে না। কি স্বৈরাচারি, কি গণতান্ত্রিক আর নির্বাচিত-অনির্বাচিত, কেউই সমালোচনাকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেনি। বস্তুনিষ্ঠ তথ্য এবং সত্য ক্ষমতাসীনদের কাছে সবসময় ভীষণ ভয়ের কারণ হয়ে থাকে। কেবল সাংবাদিকতা নয়, গল্প-কবিতা, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, কার্টুন-ছড়ায় তার মতের অমিল ঘটলে ভীত হয়ে পড়ে। প্রশ্ন হচ্ছে, সমালোচনা করলেই কি সরকার পড়ে যায়? পড়ে না। বরং সরকারের সুযোগ হয়, শুধরে নেয়ার। তা না করে, তারা ক্ষমতাহারা হওয়ার আতঙ্কে ভুগে। কোনো কোনো সমালোচনাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা মনে করে। ফলে তারা বেশির ভাগ সময় সরকারবিরোধী আর রাষ্ট্রবিরোধী একাকার করে ফেলে। অবশ্য ডিজিটাল আধুনিকতার সুবাদে মানুষের এখন আগের মতো আর তথ্যের জন্য সংবাদপত্র বা টিভি-রেডিওর জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। হাতে হাতে মোবাইলে এখন সংবাদ ও তথ্যের ডিপো। লাখ-লাখ অ্যাকাউন্ট ফেসবুক আর ইউটিউব। যার যা ইচ্ছা লিখছে-বলছে। সত্য-মিথ্যা তথ্য দিচ্ছে। কিন্তু এতে কী হয় বা হবে সরকারের? এখন পর্যন্ত সেই ধরনের কোনো শঙ্কাও নেই। আবার এসব মাধ্যমে সরকারের পক্ষে প্রচারও কম নয়। অর্থাৎ মানুষ নানাভাবে মতপ্রকাশ করার চেষ্টা করছে। মুক্তভাবে মতপ্রকাশ করতে পারছে না। এক্ষেত্রে বাধা হয়ে আছে বহুল বিতর্কিত ডিজাটাল নিরাপত্তা আইন। ২০১৮ সালে আইনটি প্রণয়নের পর থেকে এর কিছু ধারা নিয়ে সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা তীব্র বিরোধিতা করে আসছে। তারা বলছে, এ আইন স্বাধীন মতপ্রকাশকে রুদ্ধ করার জন্য করা হয়েছে। তাদের এ কথার প্রতিফলন আইনটি প্রণয়নের পর থেকেই দেখা যাচ্ছে। এ পর্যন্ত এই আইনের শিকার হয়েছে চারশ’র বেশি মানুষ। এদের মধ্যে সাংবাদিক, লেখক ও বিভিন্ন পেশাজীবী রয়েছেন। ৭৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে এ আইনে মামলা দেয়া হয়েছে। আমরা দেখেছি ফটোগ্রাফার কাজল এই আইনের খড়গে পড়ে কি হেনস্থার শিকার হচ্ছেন। সর্বশেষ লেখক মুশতাক আহমেদ তো এই আইনের শিকার হয়ে কারাগারে মৃত্যুবরণ করেছেন। এখন তার মৃত্যুর প্রতিবাদ ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করার দাবীতে আন্দোলনও চলছে। মুশতাক আহমেদের মৃত্যুতে কিছু পারসেপশন তৈরি হয়েছে। মামলা ও রাষ্ট্রপক্ষের মতিগতিতে মুশতাক এক ভয়ংকর অপরাধী। দশ মাস ধরে তাকে জেলে আটকে রাখা হয়েছে। অন্তত ছয়বার জামিন আবেদন করেছেন তিনি কিন্তু, বারবারই তা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত তার মৃত্যু হয়েছে। অথচ যেখানে খুনের বা যাবজ্জীবন দন্ডিত আসামী ছাড়া পেয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে, সেখানে অজানা এক লেখককে নিয়ে কেন এমন কঠোর ভ‚মিকা নিয়েছে সেটাই প্রশ্ন। সমালোচনা, লেখালেখি, ব্যঙ্গচিত্র আঁকলেই সরকারকে ক্ষেপে উঠতে হবে কেন? এতে সরকার পড়ে যায়? সরকার কেন ভিন্নমত সহ্য করতে পারে না। অথচ গণতান্ত্রিক সরকারের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে, ভিন্নমত যতই অপছন্দ হোক তা গ্রহণ করা। অসহিষ্ণু হয়ে উঠা নয়। রাস্তা-ঘাটে, হাটে-মাঠে, দোকানে, বাজারে হোটেল-রেস্টুরেন্টে, বাসে-লঞ্চে মানুষ কি সরকারের সমালোচনা করছে না? তার বিরুদ্ধে কি সরকার ব্যবস্থা নিতে পারছে? আর এতে সরকারের কি ক্ষতি হচ্ছে? কেবল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখালেখি ও মতপ্রকাশ করলেই সরকার কেন সহ্য করতে পারছে না? অথচ এর বিপরীতে রাষ্ট্রীয় এবং বেসরকারি প্রচারমাধ্যমে বর্তমান সরকারের মতো প্রশংসা অতীতে কোনো সরকারই নিশ্চিত করতে পারেনি। একটি সরকারের যেমন ভাল দিক আছে, তেমনি সমালোচনারও অনেক জায়গা থাকে। উভয় দিককেই সরকারকে গ্রহণ করতে হয়। যখন সমালোচনাকে সহ্য করতে পারে না, তখন তাতে সরকারের দুর্বলতাই প্রকাশ করে। এই দুর্বলতা ঢাকতেই বিরোধীমত দমনের নানা কৌশল অবলম্বন করে। সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করে তাই করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে নেতিবাচক খবরের কারণে নানা ধরনের সামাজিক সমস্যা ও অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রোপাগান্ডা বা অপপ্রচার সব সময়ই ছিল। আগেও ছিল, এখনো আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সবকিছুই প্রোপাগান্ডা নয়। ইতিবাচক অনেক কিছু রয়েছে। পাঠক যখন বুঝতে পারবেন তিনি সত্য তথ্য পাচ্ছেন না, তখন তারা মুখ ফিরিয়ে নেবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে কে কীভাবে ব্যবহার করবে ভালো-মন্দ নির্ভর করে তার ব্যক্তিগত মনোভাবের উপর। তবে স্বাধীন সাংবাদিকতা এখন সারাবিশ্বে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে। আমেরিকাকে স্বাধীন সাংবাদিকতার দেশ হিসেবে মনে করা হয়। বাস্তবতা তা নয়। দেশটিতে সংবিধানের প্রথম সংশোধনীর মতো একটা অনন্য বিধান আছে, যা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। সেই দেশেও কথায় কথায় সাংবাদিকদের হ্যানস্থা করা হয়। শুধু আমেরিকা নয়, পশ্চিমা দেশগুলো ছিল স্বাধীন সাংবাদিকতার তীর্থস্থান। সেখানেও সাংবাদিকতা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। সেই বিবেচনায় সাংবাদিকতা দমনকে একটা বৈশ্বিক প্রবণতা বলা যায়। তবে উন্মুক্ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কেউই পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি, পারবেও না। কোনো না কোনোভাবে তথ্য প্রকাশিত হবেই। এই যে দেশের বাইরে থেকে কিংবা ভুয়া আইডি দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে যায়, এমন অসংখ্য তথ্য প্রকাশিত হচ্ছে, তার কি কোনো প্রতিকার সরকার করতে পারছে? পারছে না। কেবল দেশে যারা মতপ্রকাশ করছে, তাদের ধরতে পারছে। এক্ষেত্রে, যারা গঠনমূলক সমালোচনা করছে তাদেরও আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। এ প্রবণতা স্বাধীন ও গঠনমূলক মতপ্রকাশের জন্য ভয়ংকর।
এ কথা অনস্বীকার্য, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সাংবাদিকতাকে চ্যালেঞ্জে ফেলেছে। পাঠকের সামনে এখন সংবাদের অনেক পথ উন্মোচিত। তারা এখন খবরের কাগজ, টেলিভিশন ও রেডিওর ওপর নির্ভরশীল নয়। যেকোনো খবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তৎক্ষণাৎ জেনে ফেলছে। শুধু জেনেই ফেলছে না, নিজের অভিমত দেওয়ারও সুযোগ পাচ্ছে। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খবরাখবরের সত্য-মিথ্যা যাচাই-বাছাই করা হয় না। সেগুলো অস¤পাদিত। কিছু বলায় বাছবিচার নেই, যার যা খুশি তাই বলে দিচ্ছে। সংবাদ মাধ্যমের মতো এডিটোরিয়াল কন্ট্রোল বা স¤পাদকীয় নিয়ন্ত্রণ সামাজিক মাধ্যমে নেই। এতে যে লাভবান তার কাছে তখন মাধ্যমটি ভালো বা উৎকৃষ্ট। যে ক্ষতিগ্রস্ত তার কাছে নিকৃষ্ট। তিনি তখন আইন খোঁজেন। পৃথিবীর অনেক দেশ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের মতো পদক্ষেপ নিচ্ছে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, সেখানে সাংবাদিকতাকেও জড়িয়ে ফেলা হচ্ছে, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সাংবাদিকতা-অসাংবাদিকতাকে গুলিয়ে ফেলার এই প্রবণতা কাম্য নয়। এতে স্বাধীন সাংবাদিকতা ভীষণভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আইনি বিপদ সাংবাদিকতায় আগেও কম ছিল না। তবে প্রয়োগ কম ছিল। এক সময় মানহানির মামলায় সাংবাদিকদের নাজেহাল করা হতো। এখন এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে কথায় কথায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হচ্ছে। মানহানির মামলা দুই রকমের হতো। একটি ফৌজদারি, আরেকটি দেওয়ানি। কেউ মানহানি মামলা করতেই পারে। তবে তা নিজেকে করতে হয়। আইনে ¯পষ্ট লেখা আছে, মামলা করতে পারবেন শুধু সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি, অন্য কেউ নয়। যিনি নিজের মানহানি হয়েছে বলে মনে করেন, শুধু তিনিই মামলা করতে পারবেন। দেখা যাচ্ছে তার বন্ধু, শুভানুধ্যায়ী, সমর্থক, অনুসারীরা মামলা করে এবং সেসব মামলা গ্রহণ করা হয়। একই অভিযোগে একাধিক মামলা হয়। অথচ আইনে বলা হয়েছে, একটি মানহানির ঘটনায় একের বেশি মামলা হতে পারবে না। এখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আর মানহানির মামলা এই দুইয়ের জেরে সাংবাদিকতায় সেলফ সেন্সরশিপ বেড়ে গেছে। চাচা আপন প্রাণ বাঁচানোর প্রবণতা তৈরি হয়েছে। এটা কোনো রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে না। গঠনমূলক ও যৌক্তিক মতপ্রকাশের স্বাধীনতা যদি না থাকে এবং সহ্য করার ক্ষমতা সরকারের না থাকে, তবে তা দেশের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। মানুষকে বধির করে রাখার এ প্রবণতা একসময় বিস্ফোরক আকার ধারণ করে। তখন তা যেকোনো সরকারের পক্ষে সামাল দেয়া কঠিন।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।