পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আজকের বাংলাদেশ উন্নয়ন সূচকের মাপকাঠিতে প্রতিবেশী অনেক দেশ, বিশেষত ভারত ও পাকিস্তান থেকে অর্থনৈতিভাবে এগিয়ে আছে। বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদনেও বাংলাদেশের উন্নয়নের চিত্র ফুটে উঠেছে। এই উন্নয়নের ব্যাপ্তি শিল্প-বাণিজ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, যোগাযোগ, বিদ্যুৎ, তথ্যপ্রযুক্তিসহ বিভিন্নি খাতে। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা স্পষ্টভাবে প্রায় সর্বত্র পরিলক্ষিত হলেও বীমা খাতে এখনও চোখে পড়ার মতো তেমন কোনো সফলতা নেই। নানা কারনেই বীমা শিল্পটি এখনও অবহেলিত। এর মূলে রয়েছে এদেশের মানুষের অনভিজ্ঞতা এবং বীমা সম্পর্কে অসচেতনতা। ফলে উন্নত বিশ্বের তুলনায় এমনকি ভারত ও শ্রীলংকার তুলনায়ও বাংলাদেশের বীমা খাত অনেক পিছিয়ে রয়েছে।
পৃথিবীর উন্নত দেশসমূহে জিডিপিতে বীমার অবদান উল্লেখযোগ্য। যুক্তরাজ্যে এই অবদান শতকরা ১১.৮%, ইউএসএ ৮.১%, জাপান ৮.১%, হংকং ১১.৪%, সিঙ্গাপুর ৭%, ভারত ৪.১%, ব্রাজিল ৩.২%, চীন ৩%। অথচ বাংলাদেশের জিডিপিতে বীমার অবদান ০.২% মাত্র, যা লজ্জাজনক। ঐ সকল দেশে বীমার ঘনত্ব (প্রিমিয়াম পার ক্যাপিটা মার্কিন ডলারে) ইউকে ৪৫৩৫, ইউএসএ ৩৮৪৬, জাপান ৫১৬৯, হংকং ৩৯০৪, ব্রাজিল ৩৯৮, চীন ১৬৩, ভারত ৫৯, ডলার। পক্ষান্তরে বাংলাদেশে প্রতি হাজারে মাত্র ৪ জনের জীবন বীমা রয়েছে। অর্থাৎ বেশিরভাগ বীমাযোগ্য জীবন ও সম্পদ বীমার আওতা বহির্ভূত থেকে যাচ্ছে। আশার কথা, ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর বীমা শিল্পের উন্নয়ন এবং এ শিল্পে গতিশীলতা আনায়নের লক্ষ্যে বিভিন্নমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। এ বছর ১ মার্চ প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক জাতীয়ভাবে বীমা দিবস পালনের ঘোষণা বীমা শিল্পে অর্থবহ পরিবর্তন আনার নতুন দিগন্ত উম্মোচন করেছে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর রাজনৈতিক জীবনে রাজনীতির পাশাপাশি জীবিকার জন্য পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন বীমাকে। তিনি ১৯৬০ সালের ১ মার্চ তৎকালীন আলফা ইনস্যুরেন্সের বাংলাদেশ অঞ্চলের প্রধান হিসেবে যোগদান করেছিলেন। সে সময় রাষ্ট্রীয়ভাবে রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকায় তিনি রাজনীতির চাকা সচল রাখার স্বার্থে বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার সাথে বেছে নিয়েছিলেন বীমা পেশাকে। বীমা পেশার কার্যক্রম সংগঠন ভিত্তিক হওয়ার কারণে রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে এর সাদৃশ্য রয়েছে। তিনি বীমা কোম্পানির কাজের পাশাপাশি জনগণের অধিকার আদায় ও তাদেরকে সংঘবদ্ধ করার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। বিভিন্ন অঞ্চলে কোম্পানির কাজের জন্য ভ্রমণ করে তিনি নিরবে নিভৃতে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে সংহত ও বেগবান করেন। সেবাধর্মী এই পেশার মাধ্যমে মানুষকে সঞ্চয়মুখী করার প্রয়াসে পুঁজি সৃষ্টি করে দেশের অর্থনীতিতে বিশেষ অবদান রাখার ব্যাপারে অগ্রনী ভূমিকাও তিনি পালন করেন। নিজের দলীয় নেতা কর্র্মীদেরও তিনি এই বীমা পেশার সাথে সম্পৃক্ত করে কর্মসংস্থনের সুব্যবস্থা করেছিলেন। এছাড়াও তৎকালীন সময়কার বীমা ব্যক্তিত্ব খোদা বকশ, গোলাম মাওলা, গাজী গোলাম মোস্তফা, সামছুল আলম, নুরুল ইসলাম প্রমুখের বীমা শিল্পের সকল স্তরের কর্মকর্তা কর্মচারীদের সাথে ছিল তার গভীর সম্পর্ক। তাই জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর আহবানে বীমা শিল্পের কর্মকর্তা কর্মচারীরা সবার আগে ঝাঁপিয়ে পড়তেন।
স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই বঙ্গবন্ধু যুদ্ধ বিধস্ত দেশ গঠনে আত্মনিয়োগ করেন। ভঙ্গুর অর্থনীতি, বুভুক্ষ মানুষের হাহাকার এবং ক্ষতবিক্ষত বাংলাদেশ পুনর্গঠনের পাশাপাশি তিনি বীমা শিল্প পুনর্গঠনেও মনোযোগ দেন। তিনি বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স (জাতীয়করণ) আদেশ ১৯৭২ জারী করে ৪৯টি দেশি, বিদেশি বীমা কোম্পানিকে জাতীয়করণের মাধ্যমে সুরমা, রূপসা, তিস্তা এবং কর্ণফুলী নামক ৪টি বীমা কর্পোরেশন গঠনসহ বীমা প্রতিষ্ঠানসমূহকে নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে জাতীয় বীমা কর্পোরেশনও গঠন করেন। এছাড়াও অল্প সময়ের মধ্যে বীমা শিল্পের উন্নয়নে ইনস্যুরেন্স কর্পোরেশন আইন ১৯৭৩ প্রণয়ন করেন। পরবর্তিতে ৪টি কর্পোরেশনকে ভেঙ্গে জীবন বীমা কর্পোরেশন এবং সাধারণ বীমা কর্পোরেশন নামক ২টি পৃথক বীমা কর্পোরেশন গঠন করেন। এরই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর সুযোগ্য কন্যা, বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী, জননেত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর পরই বীমাকে যুগপোযোগী করে ঢেলে সাজানোর জন্য পুরাতন বীমা আইন ১৯৩৮ পরিবর্তন করে বীমা আইন ২০১০ প্রবর্তন করেন। পাশাপাশি প্রণয়ন করা হয় বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ আইন ২০১০। পরবর্তিতে ২০১১ সালে বীমা খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে বীমা অধিদপ্তর বিলুপ্ত করে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) প্রতিষ্ঠা করা হয়। স্বল্পতম সময়ের মধ্যে বীমা বিধি ও প্রবিধানমালা তৈরি করা হয় এবং বীমাকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে বের করে অর্থমন্ত্রণালয়ে ন্যাস্ত করা হয়। এসব সংস্কারের ফলে বীমা শিল্পের গ্রহণযোগ্যতা এবং গুরুত্ব পূর্বের তুলনায় বহুগুণ বৃদ্ধি পায়।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতি বিজড়িত বীমা পেশা এবং ১ মার্চ ১৯৬০ সালে বঙ্গবন্ধুর বীমা পেশায় যোগদানের তারিখকে ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ করে রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রী বীমা শিল্পকে এক অনন্য উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করেছেন। ১ মার্চ ২০২০ বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী ১ মার্চকে জাতীয় বীমা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন এবং বীমা দিবসের উদ্বোধন করেন।
বীমা পেশাটি অবহেলিত থাকার কারণে, অনেকেই বীমাকে পেশা হিসেবে গ্রহণে অনিহা প্রকাশ করে আসছিলেন। প্রধানমন্ত্রী এক্ষেত্রে বীমা পেশাজীবীদের উৎসাহ প্রদানের লক্ষ্যে বলেছেন, ‘জাতির পিতা বীমা পেশায় চাকরি করেছেন, আমি অবসরে যাওয়ার পরে আমার জন্য বীমাতে যেন একটি চাকরি থাকে’, প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যটিও বীমা শিল্পের জন্য একটি অলংকার ও বড় অর্জন। এ ছাড়াও প্রথম জাতীয় বীমা দিবসে প্রধানমন্ত্রী স্কুল পড়–য়া ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বঙ্গবন্ধু শিক্ষা বীমা চালুর ঘোষণা দেন। ইতিপূর্বে প্রবাসী কর্মীদের সুরক্ষার জন্য প্রবাসী বীমা চালু করা হয়েছে। এ দশের জনসাধারণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সার্বজনীন স্বাস্থ্য বীমা, সার্বজনীন পেনশন বীমা, কৃষি/ফসলী বীমা প্রচলনের উদ্যোগ ইতোমধ্যেই গ্রহণ করা হয়েছে। জাতীয় বীমা দিবস পালন করার মধ্য দিয়ে দেশের সকল শ্রেণীর মানুষ বীমা সম্পর্কে জানতে পেরেছে, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বীমা বিষয়ে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে এবং সকল শ্রেণী পেশার মানুষের মধ্যে বীমা বিষয়ে কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে। বীমা শিল্পের ভালমন্দ বিচার বিশ্লেষণের সুযোগ সুষ্টি হয়েছে। আশা করা যায়, অদূর ভবিষ্যতে বীমা মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক সুরক্ষার নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।
লেখক: ঊর্ধ্বতন নির্বাহী পরিচালক, পপুলার লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেড
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।