পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টির সেরা ও সুন্দরতম অবয়বে এ পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন, যাতে তারা একটি সুন্দর ও শান্তির সমাজ গঠন করতে পারে। যে সমাজের মানুষেরা গভীর রজনীতে একাকী দূর-দূরান্তে পথ চলবে, থাকবে না কোন হিংস্র দানবের হামলার আশঙ্কা। থাকবে না হিংসা, বিদ্বেষ, পরাশ্রীকাতরতা। থাকবে না মারামারি, কাটাকাটি, হানাহানি, চুরি-ডাকাতি, খুন-রাহাজানি, জুলুম-নির্যাতন, ব্যভিচার-ধর্ষণ প্রভৃতি অসামাজিক কর্ম। থাকবে শুধুমাত্র দয়ামায়া, স্নেহ, ভালোবাসা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সম্মান, ন্যায়পরায়নতা, সুবিচার ও সুষ্ঠ পারিবারিক বন্ধন। অথচ সমাজের লোকেরা আজ নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হওয়ায় খুন-খারাবি, হত্যা, রাহাজানী, ধর্ষণ-ব্যভিচারের মতো গর্হিত কাজে জড়িয়ে পড়েছে। তারা আদর্শিক শিক্ষা পরিত্যাগ করে কুপ্রবৃত্তির গোলামী করছে। দৈনন্দিন জীবনে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় দিন দিন বেড়েই চলেছে। এর লাগাম টেনে না ধরলে জাতিকে চরম মাশুল দিতে হবে। প্রতি নিয়ত আমাদের মা-বোনেরা, এমনকি শিশু ও বৃদ্ধারা পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। হত্যা, গুম, আর মাদকের আগ্রসন দিন দিন বাড়ছেই। এসব আমাদের নৈতিকতা বিপর্যয়ের ফলাফল।
সামাজিক অবক্ষয়ের মূল কারণ অনৈতিকতা, অশিক্ষা, কুশিক্ষা, অধার্মিকতা, দরিদ্রতা, অসচেতনতা এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ না থাকাকে সবাই চিহ্নিত করে। কিন্তু এর পাশাপাশি মানসিক ও সাংস্কৃতিক কারণও আছে। অনেকে আইনের প্রয়োগ না থাকাকে দায়ী করেন। এ ছাড়া ইসলামের যথাযথ জ্ঞান ও অনুসরণের অভাব, ধর্মীয় শিক্ষার অভাব, আদর্শিক ও নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রতকরণ ও পরিচর্যার অভাব, সৎ নেতৃত্বের অভাব, ন্যায়বিচারের অভাব, রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি এবং পরকালকেন্দ্রিক জীবন গঠনে অনীহাও দায়ী। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা ও পারিবারিক শিক্ষাব্যবস্থায় গলদের কারণেও আমাদের নৈতিকতার বিপর্যয় ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটে চলেছে। আমরা আমাদের সন্তানদের জিপিএ-৫, ভালো ফলাফল, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিসিএস এবং সম্মানজনক চাকরির পেছনে ছুটার প্রতি উৎসাহ দিচ্ছি। কিন্তু তাদের নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করার কথা ভাবছি না। পাঠ্যসূচিতে অনেক বিষয় অন্তর্ভুক্ত হলেও নৈতিক ও মূল্যবোধ সম্পর্কিত বিষয় খুবই কম এবং দিন দিন তা আরো হ্রাস পাচ্ছে। ফলে শিক্ষার্থীরা মেধাবী হচ্ছে, কিন্তু ভালো নৈতিকতাসম্পন্ন মানুষ হয়ে উঠছে খুবই কম।
একটি আদর্শ সমাজ গঠন করতে হলে সর্বপ্রথম আমাদের যেতে হবে ইসলাম তথা কুরআন ও সুন্নাহর যে নীতি ও বিধান রয়েছে তার কাছে। ইসলাম, ইসলামের ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও রীতিনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতে হবে। পাশাপাশি সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে সচেতন করতে হবে। শিশুদের প্রতি অভিভাবকদের বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে, নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশা, যৌন উদ্দীপক সংস্কৃতি প্রচার-প্রসার রোধ করে ব্যভিচারের পথ রুদ্ধ করতে হবে, সামাজিক কলহ-বিবাদের অবসান ঘটাতে, সৎকাজের আদেশ অসৎ কাজের নিষেধ করতে এবং পরকালীন জবাবদিহিতার অনুভূতি জাগ্রত করতে হবে। প্রত্যেককে নৈতিক শিক্ষার মানদন্ডে উন্নিত করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন: ‘অতঃপর তাতে ঢেলে দিলেন অপরাধপ্রবণতা ও তাকওয়া। অবশ্যই সফল হলো সে, যে তার নফসকে পরিশুদ্ধ করল; আর বিপদগ্রস্ত হলো সে, যে নফসকে দূষিত ও কুলষিত করল’। (সুরা শামস ৮-১০)
অন্য আয়াতে এসেছে: ‘আহলে-কিতাব ও মুশরেকদের মধ্যে যারা কাফের, তারা জাহান্নামের আগুনে স্থায়ীভাবে থাকবে। তারাই সৃষ্টির অধম। যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, তারাই সৃষ্টির সেরা।’ (সুরা বাইয়িনা ৬-৭) নৈতিক শিক্ষা সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেছেন: ‘জেনে রাখো, শরীরের মধ্যে একটি গোশতের টুকরা আছে, তা যখন ঠিক হয়ে যায়, গোটা শরীর তখন ঠিক হয়ে যায়। আর যখন তা খারাপ হয়ে যায়, গোটা শরীর তখন খারাপ হয়ে যায়। জেনে রাখো, সে গোশতের টুকরাটি হলো কলব।’ (বুখারী)
আমাদের আত্মিক, মানবিক ও সামাজিক উন্নতির জন্য প্রয়োজন সদগুণাবলি অর্জন ও কুপ্রবিত্তি নিয়ন্ত্রণ করা। সদগুণাবলির মধ্যে- সততা, সত্যবাদিতা, ন্যায়বোধ, দয়া, মহানুভবতা, আত্মসংযম, ধৈর্য-সহনশীলতা, পরোপকারিতা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। সাথে সাথে জুলুম-নির্যাতন, গর্ব-অহংকার, গীবত, চোগলখোরী, পরনিন্দা-পরচর্চা, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদসহ সকল প্রকার খারাপ থেকে নিজেকে দূরে রাখা, সমাজকে কুলষিত মুক্ত করা।
পরিবেশ ও প্রতিবেশের প্রভাব সমাজ জীবনে প্রকট। আমাদের সমাজ জীবনের প্রতিচ্ছায়া শিক্ষার্থীর মন, মানস ও শিক্ষায় ব্যাপক প্রভাব ফেলে। তাই সুশিক্ষার জন্য চাই সহায়ক পরিবেশ, ন্যায়বিচার, সুুশাসন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। ইসলাম কখনোই অশ্লীলতা, পৈশাচিকতা প্রশ্রয় দেয় না, বরং সভ্যতার ইতিহাসে অশ্লীলতা নির্মূলে ইসলাম কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। অশ্লীল পোশাক, নৃত্য, জিনা-ব্যভিচার ইসলাম কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। প্রকৃত মুসলিম সমাজে কখনোই অশ্লীলতা, বেহায়াপনা স্থান পায়নি। আল্লাহ তায়ালা বলেন: ‘তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেও না। এটা অশ্লীল ও নিকৃষ্ট আচারণ’। (সুরা বনি ইসরাইল ৩২)
তাই মানুষের মধ্যে সামাজিক অবক্ষয়ের বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। সামাজিক অবক্ষয় সৃষ্টিকারী মাধ্যমের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সমাজে যে অনাচার, দুরাচার, অশ্লীলতা, মারামারি, হানাহানি, জুলুম ও নির্যাতনের তান্ডব চলছে তা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার একমাত্র পথ হলো ইসলাম। ইসলামের নীতির আদর্শ বাস্তবায়নের মাধ্যমেই শান্তি ও কল্যাণময় সমাজ গঠন সম্ভব, সম্ভব অবক্ষয় মুক্ত সমাজ গঠন।
লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।