Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সাংবাদিকরা আর কত মারা যাবে?

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:০৩ এএম

অবশেষে রণে ভঙ্গ দিলেন নোয়াখালী জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বসুরহাট পৌরসভার নবনির্বাচিত মেয়র আব্দুল কাদের মির্জা। গত শুক্রবার স্থানীয় চাপরাশিরহাট পূর্ব বাজারে দুই বিবদমান পক্ষের সংঘর্ষের খবর সংগ্রহের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে এক সাংবাদিক মারা গেলে সব কর্মসূচিই প্রত্যাহার করেন নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের এই নেতা। সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বাদল ও কাদের মির্জার সমর্থকদের মধ্যে ওই সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষের খবর সংগ্রহের সময় দৈনিক বাংলাদেশ সমাচার ও অনলাইন পোর্টাল বার্তা বাজার-এর স্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত বুরহান উদ্দিন মুজাক্কির গুলিবিদ্ধ হন, পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। এ ঘটনার পরপরই কাদের মির্জা নোয়াখালীর রাজনীতিতে চলমান সংকট নিরসনে সবার আস্তার শেষ ঠিকানা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে পূর্বে ঘোষিত সব ধরনের কর্মসূচি প্রত্যাহার করেন। এ দিকে মর্মান্তিক এ মৃত্যুর ঘটনায় গত রবিবার ২১ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১২টায় নোয়াখালী প্রেসক্লাবের সামনে স্থানীয় সাংবাদিক নেত্রীবৃন্দ, আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মী ও উন্নয়নকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার প্রতিনিধিরা ঘণ্টাব্যাপী মানববন্ধন করেন এবং হত্যাকন্ডে জড়িত ব্যক্তিদের অবিলম্বে গ্রেফতার করা না হলে কঠোর কর্মসূচির ঘোষণা প্রদান করেন।

মৃত্যু অবধারিত, চিরন্তন সত্য একটি বিষয়। এ থেকে নিস্তার পাওয়া যায় না। অতীতে কেউ পায়নি ভবিষ্যতেও পাবে না। এটা বাস্তব এবং চিরসত্য। মৃত্যু স্বাভাবিক হলে কথা নেই কিন্তু অকারণে অস্বাভাবিক হলে আত্মীয়-স্বজন ও পরিজনদের পীড়া দেয়। বুরহান উদ্দিন মুজাক্কির তার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছে।

সাংবাদিক কলম সৈনিক। তারা বছরের পর বছর মার খাচ্ছে, ভবিষ্যতেও খাবে। তাই যতদিন এ সমাজটিতে হিংস্র মানুষদের বিরুদ্ধে সর্বমহলে বিবেক জাগ্রত না হবে ততদিন কলম সৈনিকরা মার খাবেই। বুরহান উদ্দিন মুজাক্কিরকে খুন করা হয়েছে। আমরা সতীর্থরা দুঃখ পেয়েছি, আঘাত পেয়েছি, মর্মাহত হয়েছি। বিবেক কিন্তু এখনো জাগেনি। এর আগেও সারাদেশে সাংবাদিকরা মার খেয়েছে, খুন হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই এসবের বিচার হয়নি। বার বার কলম সৈনিকদের লাঞ্ছিত করা হচ্ছে, খুন করা হচ্ছে, মামলাও হচ্ছে। দেশের এ কলম সৈনিকরা যদি অন্ধকার জগতের মানুষদের সাথে নৈতিকতা বর্জন করে আপোস করে চলতো তাহলে এসব আক্রমণের শিকার তাদের হতে হতো না। কলম সৈনিকদের মনের দৃঢ়তা এখনো আছে বলে নীতি ও নৈতিকতার চর্চা হচ্ছে। মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে তারা নীরবে ও সরবে যুদ্ধ করে যাচ্ছে অন্যায়, অবিচার ও অপশক্তির বিরুদ্ধে। সমাজ সুসংহত করার দায়িত্ব এ দেশের মানুষেরই। দেশের সকল সমাজশক্তি যদি এ বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন না করে তাহলে সময়ের পাগলা হাওয়ার চক্রে পড়ে আমরা সকলেই নিঃশেষ হয়ে যাবো।

সাংবাদিক ও কলম সৈনিকদের কলম বহতা নদীর মতো চলেছে জনগণের জন্য। তারা কখনো এককভাবে সাংবাদিক সমাজের সুখ-দুঃখের কথা লেখেনি। যেখানে সাংবাদিক সমাজ নিজেদের দুঃখের কথা না লিখে অন্য পেশার জন্য লিখে সমাজকে জাগ্রত করছে সে জাগ্রত মানুষগুলো কি সাংবাদিকদের বিপদে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে? রাজনৈতিক দলগুলো পত্রিকার পাতায় দু’কলম বক্তব্য দিয়ে নিজেদের দায়িত্ব শেষ করেছে। প্রশাসন বলে, ব্যবস্থা নেয়া হবে। পুলিশ বলে, অপরাধী যেই হোক তাকে ধরে বিচারের জন্য সোপর্দ করা হবে। এটাই তো স্বাভাবিক নিয়ম ও প্রচলিত ভাষা। এ পর্যন্ত যতজন সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার অথবা মৃত্যু বরণ করেছে তারা কি নিজের স্বার্থের জন্য কলম চালিয়েছিল? প্রতিটি নির্যাতন এবং হত্যার কারণ ছিলো সমাজের কল্যাণ ভাবনা। সাংবাদিকরা সমাজের অনিয়ম, দুর্নীতি এবং অনৈতিক বিষয়গুলো তুলে ধরছে সমাজ প্রগতির জন্য। আর সে জন্য হিংস্র অপশক্তি তাদের শেষ করে দিতে সচেষ্ট। শামসুর রহমান, ফারুক ইকবালসহ বহু সাংবাদিককে হত্যার মধ্য দিয়ে ঘাতক দল প্রমাণ করেছে তারা কলম সৈনিকদের আদর্শের কথাগুলোকে হিং¯্রতা দিয়ে দমন করতে চায়। কিন্তু হিংস্র মানুষরূপী পশুরা জানে না, কলম সৈনিকদের নিঃশেষ করা যাবে না। কারণ, একজন কলম সৈনিকের রক্ত থেকে বেরিয়ে আসবে হাজারো তেজী কলম সৈনিক। এদের হত্যা বা নির্যাতন করে অতীতে যেমন কোনো অপশক্তি দমাতে পারেনি, বর্তমানে পারছে না এবং ভবিষ্যতেও পারবে না।

সাংবাদিকদের শুধু একটি পেশার মানুষ হিসাবে ভাবলে ভুুল হবে। বরং তাদের ভাবতে হবে জাতির বিবেক হিসেবে। অন্য পেশার মানুষরা যা বলতে পারে না, সাংবাদিকরা তাই প্রকাশ করে সমাজের কল্যাণে। তারা প্রতিটি পেশা ও শ্রমের মানুষের কথা বলে চিত্তের শক্তি দিয়ে। যে মেধা সাংবাদিকরা দেশের কাজে ব্যয় করছে দেশ তাদের জন্য করছে কী? শুধু একটি মিছিল, দু’চার ছবক বক্তৃতা এবং পত্রিকায় কিছু বিবৃতি। শ্রেফ এগুলো অতীতেও আমরা অনেক দেখেছি। কিন্তু যারা সাংবাদিকদের নির্যাতন করেছে তাদের কোনো শাস্তি হয়নি। তাই অনেকে বলেন, সাংবাদিকদের জন্ম হয়েছে মার খাওয়ার জন্য। এখন কথা হলো, সমাজের অবক্ষয়, অন্যায়, দুর্নীতি এবং অনিয়মের বিরুদ্ধে লেখা যাবে না? এসব যারা করছে, তারা সমাজের মাথা। তারা যা করে আমাকে আপনাকে তা চোখ বুঝে সইতে হবে, বলতে হবে আমি দেখিনি? বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, এসব অন্যায়কারী সব ম্যানেজ করে ফেলে প্রভাব, অস্ত্র এবং অর্থ দিয়ে। অতীতের ঘটনাবলীর সাথে বর্তমানকে মিলালে একই ফলাফল বেরিয়ে আসে। বিভিন্ন সময় সংবাদ প্রকাশের কারণে বিভিন্ন সাংবাদিককে হুমকি দেওয়া হয়, এটাতো মামুলি ব্যাপার। এসব হরহামেশাই ঘটছে। তথাকথিত শিক্ষিত ক্রিমিনালরা বিভিন্ন বিভাগে ও প্রতিষ্ঠানের মাথায় বসে আছে বলে শিক্ষার বিকাশ স্তব্ধ হয়ে আছে। ন্যায় অন্যায়ের কথা বলা এখানে বাতুলতা। এখন তিনি ভালো প্রশাসক যিনি নিজে ঘুষ খাবেন, ঘুষ দেবেন, যিনি বসদের তেল দিয়ে রাতকে দিন এবং দিনকে রাত বলবেন, তার সাত খুন মাফ। এখন তারাই ভালো, প্রশাসনের যারা রাজনৈতিক নেতা বা মন্ত্রীদের কথামত চলবেন, সব কিছুতেই হ্যাঁ বলবেন, অন্যায় হলেও মেনে নেবেন, সাহস করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলবেন না, প্রতিবাদ করবেন না। তারাই ভালো, তাদের পদোন্নতি হবে, ভালো পোস্টিং পাবেন। এটা হলো সা¤প্রতিক হাল। নিজে অন্যায় করে অন্যকে অন্যায় না করতে বলা, এটা হলো তাদের আদর্শ। এসবের ব্যাপারে সাংবাদিকরা আপোস করতে পারে না বলেই তারা এখন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। তাদের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও দেশের বা সমাজের জন্য কাজ করতে পারছে না, তাদের ভিন্নভাবে দেখা হয়, দেখা হচ্ছে।

এখন প্রশ্ন হলো, সাংবাদিকরা কি এভাবে মার খেতেই থাকবে? এ প্রশ্নের জবাব দেবে কে? যখন সাংবাদিক মার খায় তখন সাংবাদিক সমাজ মাঠে নামে এবং তারপর ভুলে যায় সব। এভাবে চলবে কি? স্থায়ী প্রতিকার চাই। এর জন্য সাংবাদিকদের ক্ষমা করে দেয়ার মানসিকতা ত্যাগ করতে হবে, ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। প্রতিনিয়ত ক্ষমা করে দেওয়ার মানসিকতার কারণে অপশক্তি প্রশ্রয় পেয়ে যাচ্ছে। তাদের ধারণা, সাংবাদিকদের আঘাত করার পর দু’চারদিন হৈ চৈ হবে, তারপর তারা একটি আপোস রফায় এসে মাফ করে দেবে। এটি চলতে দেয়া ঠিক নয়। কারণ, দুষ্টের দমন করতে হবে আইনের আওতায়। এ কথাটি মনে রেখে কলম সৈনিকদের পথ চলতে হবে। ভবিষ্যতে যেন আর কাউকে কলম পেশার জন্য অপশক্তির হিংস্রতার শিকার হতে না হয় সে পথ সৃষ্টি করতে হবে। সন্ত্রাসী অপশক্তি যেমন করে অস্ত্র নিয়ে তেড়ে আসে কলম সৈনিকদের অস্ত্র হলো কলম।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সাংবাদিক

১৫ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন