পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় আমি পুরান ঢাকার কে এল জুবলি স্কুলের ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। তখন আমাদের ক্লাশ শিক্ষক ছিলেন কামরুজ্জামান স্যার। তিনি পরবর্তীতে যুক্তফ্রন্ট থেকে মনোনয়ন নিয়ে এমপি হয়েছিলেন। হয়েছিলেন কে এল জুবলি স্কুলের প্রিন্সিপাল। পরবর্তীতে কে এল জুবলি স্কুল কলেজে রূপান্তরিত হলে তিনি কলেজেরও প্রিন্সিপাল হন। তিনি সারাদেশের শিক্ষক সমিতির সভাপতি ছিলেন। কামরুজ্জামান স্যার ভাষা আন্দোলনের ব্যাপারে আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। আমি ক্লাশ ক্যাপ্টেন হওয়ায় স্যারের সঙ্গে আমার সখ্য ছিলো ভালো। স্যারের নেতৃত্বে আমরা একাধিকবার মিছিল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলাম। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতেও আমরা মিছিল সহকারের ভাষা আন্দোলনের জনসভায় যোগ দিয়েছিলাম।
যাই হোক আসল কথায় আসি, ভাষা আন্দোলন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) সংঘটিত একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন, যা ছিল বাংলাভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। ১৯৪৭ সালে ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান গঠিত হয়, কিন্তু পাকিস্তানের দুটি অংশ পূর্ব পাকিস্তান (পূর্ব বাংলা হিসেবেও পরিচিত) ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সাংস্কৃতিক, ভৌগলিক ও ভাষাগত দিক থেকে পার্থক্য ছিল প্রচুর। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, যা পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষী জনগণের মধ্যে তুমুল ক্ষোভের সৃষ্টি করে। পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষী মানুষ (যারা সংখ্যার বিচারে সমগ্র পাকিস্তানে গরিষ্ঠ ছিল) এ সিদ্ধান্তকে মোটেই মেনে নিতে চায়নি। পূর্ব পাকিস্তানে বাংলাভাষার সমমর্যাদার দাবীতে শুরু হয় আন্দোলন।
১৯৪৭ সালেই করাচীতে অনুষ্ঠিত জাতীয় শিক্ষা সম্মেলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণাপত্রে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ব্যবহারের সুপারিশ করা হয় এবং প্রচারমাধ্যম ও স্কুলে কেবলমাত্র উর্দু ব্যবহারের প্রস্তাব করা হয়। তাৎক্ষণিকভাবে এ প্রস্তাবের বিরোধিতা ও প্রতিবাদ জানানো হয়। ঢাকার ছাত্রসমাজ অধ্যাপক আবুল কাসেমের নেতৃত্বে মিছিল করে, যিনি ছিলেন তমদ্দুন মজলিস নামক একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের সম্পাদক। ওই সমাবেশে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারের প্রবল দাবী উত্থাপন করা হয়। কিন্তু পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশন বাংলাকে তাদের অনুমোদিত বিষয় তালিকা হতে বাদ দেয় এবং সাথে সাথে মুদ্রা ও স্ট্যাম্প হতেও বাংলা অক্ষর লুপ্ত হয়। কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বানানোর জন্যে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। পূর্ব পাকিস্তানে জনরোষের সৃষ্টি হয় এবং ১৯৪৭ সালের ৮ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রদের একটি বিশাল সমাবেশে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দানের আনুষ্ঠানিক দাবী উত্থাপন করা হয়। দাবী আদায়ের লক্ষ্যে ছাত্ররা ঢাকায় মিছিল, মিটিং ও র্যালির আয়োজন করে।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টা থেকে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে এসে জড়ো হয়। তারা ১৪৪ ধারা জারির বিপক্ষে স্লোগান দিতে থাকে এবং পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সদস্যদের ভাষা সম্পর্কে সাধারণ জনগণের মতকে বিবেচনা করার আহ্বান জানাতে থাকে।
পুলিশ অস্ত্র হাতে সভাস্থলের চারদিকে প্রাচীর তৈরি করে। বিভিন্ন অনুষদের ডীন এবং উপাচার্য সে সময় উপস্থিত ছিলেন। বেলা সোয়া এগারটার দিকে ছাত্ররা গেটে জড়ো হয়ে প্রতিবন্ধকতা ভেঙে রাস্তায় নামতে চাইলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস বর্ষণ করে ছাত্রদের সতর্ক করে দেয়।
কিছু ছাত্র এই সময়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের দিকে দৌড়ে চলে গেলেও বাকিরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে পুলিশ দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে এবং পুলিশের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে। উপাচার্য তখন পুলিশকে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ বন্ধ করতে এবং ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ত্যাগ করতে বলে। কিন্তু ছাত্ররা ক্যাম্পাস ত্যাগ করার সময় পুলিশ তাদের গ্রেফতার করা শুরু করলে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। বেলা ২টার দিকে আইন পরিষদের সদস্যরা আইনসভায় যোগ দিতে এলে ছাত্ররা তাদের দাবি উত্থাপনের দাবি জানায়।
কিন্তু পরিস্থিতি নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে যখন কিছু ছাত্র সিদ্ধান্ত নেয় তারা, আইন সভায় গিয়ে তাদের দাবি উত্থাপন করবেন। ছাত্ররা সেই উদ্দেশ্যে রওনা করলে বেলা ৩টার দিকে পুলিশ দৌড়ে এসে গুলিবর্ষণ শুরু করে। পুলিসের গুলিবর্ষণে কিছু ছাত্রকে ছাত্রাবাসের বারান্দায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। আব্দুল জব্বার এবং রফিক উদ্দিন আহমেদ ঘটনাস্থলেই নিহত হন। আবুল বরকত সে সময় আহত হন এবং রাত ৮টায় মারা যান। এখানে উল্লেখ্য ওই দিন বর্তমান যেখানে শহীদ মিনার সেখানের দেওয়াল টপকাতে গিয়ে আমার পরনের শার্ট ও প্যান্ট ছিড়ে যায়। হাত পা ছুলে সামান্য আহতও হই।
বাংলাভাষা বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষায় মর্যাদা পেয়েছে। আমাদের দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শহর-নগর-গ্রাম-বন্দর সর্বত্র একুশে উদযাপিত হয়। শিক্ষার মাধ্যমও এখন বাংলা (উচ্চ শিক্ষার কতিপয় ক্ষেত্র বাদে)। সরকারি কর্মকান্ডের ভাষাও বাংলা। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, বাংলাভাষা এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত মর্যাদা পায়নি। প্রকৌশল, চিকিৎসাবিজ্ঞান ও বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে এখন পর্যন্ত বাংলা ভাষার প্রচলন হয়নি। উচ্চ আদালতেও পুরোপুরি বাংলার ব্যবহার হচ্ছে না। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষার পর্যায় পর্যন্ত শুদ্ধরূপে বাংলা ভাষা লেখা ও বলার ক্ষেত্রে যে দুরবস্থা বিরাজ করছে, তা কেবল লজ্জাজনক নয়, ক্ষমার অযোগ্য অপরাধও বটে।
ইউরোপের প্রতিটি উন্নত জাতি, এশিয়ায় চীন, জাপান, মধ্যপ্রাচ্যে আরবি ভাষাভাষী প্রতিটি জাতি যদি রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ড, শিক্ষা-সংস্কৃতি, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং সামাজিক জীবনে নিজ নিজ মাতৃভাষা ব্যবহার করে উন্নতির চরম শিখর স্পর্শ করতে পারে, তা হলে বাঙালি কেন সর্বক্ষেত্রে বাংলার ব্যবহার করবে না? এবারের একুশের প্রতিজ্ঞা হোক, আসুন আমরা সেই আলোকোজ্জ্বল পথে মাতৃভাষা বাংলাকে জীবনের সর্বক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত করি। বাংলা ভাষার অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাই।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষাবিদ ও ভাষা সংগ্রামী, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, সদস্য এফবিসিসিআই এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে ২ ও ৩ নং সেক্টরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।