পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
জলবায়ুর বিরূপ পরিবর্তন ও উষ্ণায়ন নিয়ে সারাবিশ্ব যখন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠিত এবং কিভাবে তা ঠেকানো যায়, এ নিয়ে মহাসম্মেলন থেকে শুরু করে নানা উদ্যোগের কথা বলা হচ্ছে, তখন আমাদের দেশে এ নিয়ে তেমন কোনো উদ্যোগ, পরিকল্পনা ও চিন্তা-ভাবনা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। প্রতি বছর ঝড়-ঝঞ্ঝা ও জলোচ্ছ্বাসের আঘাতে উপকূলীয় এলাকা লন্ডভন্ড হওয়ার আশঙ্কা নিয়েই কোটি কোটি মানুষ বসবাস করছে। এ থেকে রক্ষা পাওয়া এবং পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হচ্ছে, উপকূলীয় এলাকায় বনায়নের মাধ্যমে ‘সবুজ বেষ্টনী’ গড়ে তোলা। যত মজবুত করে বেষ্টনী গড়ে তোলা হবে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা তত সহজ হবে। বিশেষজ্ঞরা বরাবর এর উপরই জোর দিয়েছেন। উপকূলে সবুজায়নের দায়িত্ব বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের হলেও দেখা যাচ্ছে, এ কাজটি যথাযথভাবে করতে পারছে না। মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতা এবং দায়িত্বহীনতার কারণে উপকূলজুড়ে যতটুকু সবুজ বেষ্টনী রয়েছে, তা বনখোকো ও ভূমিদস্যুরা সাবাড় করে দিচ্ছে। বনবিভাগ, পুলিশ, জনপ্রতিনিধিদের ম্যানেজ করে নির্বিচারে ধ্বংস করা হচ্ছে। বলা যায়, রক্ষকই ভক্ষকে পরিণত হয়েছে। গতকাল দৈনিক ইনকিলাবের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত তিন দশকে দেশের উপকূলভাগে ৫০ ভাগেরও বেশি সুশোভিত কেওড়া-বাইন-ঝাউবন, প্যারাবন ও ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল উজাড় হয়ে গেছে। এর ফলে সমুদ্রের ভাঙ্গন বৃদ্ধি এবং ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে উপকূলের মানচিত্র বদলে যাচ্ছে। লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়ে ফসলি জমি ধ্বংস হচ্ছে। ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে। ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে ৭১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূল অঞ্চলকে।
বহু বছর ধরেই বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিষয়টি বিজ্ঞানীদের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে রয়েছে। ধারাবাহিকভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে উত্তর মেরুর বরফ গলতে শুরু করেছে। এর ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। গত সপ্তাহে হিমালয়ের বিশাল বরফ খন্ড গলে পড়ে ভারতের উত্তরখন্ডে যে ভয়াবহ বন্যা ও দুর্যোগ দেখা দেয়, তা এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলেই হয়েছে বলে জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। বিশ্ব জলবায়ুর বিরূপ পরিবর্তন থেকে বাংলাদেশেরও রক্ষা পাওয়ার উপায় নেই। ইতোমধ্যে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এই পরিবর্তনের ফলে বঙ্গোপসাগরের উচ্চতা প্রতিবছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকলে আগামী কয়েক দশকে উপকূলের অধিকাংশ এলাকা ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর ফলাফল যে কতটা ভয়াবহ হবে তা বন ও পরিবেশ বিষয়ক মন্ত্রণালয় উপলব্ধি করছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না। এক্ষেত্রে তার উদাসীনতা অমার্জনীয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, জলবায়ুর পরিবর্তন অত্যন্ত ধীরে হওয়ায় তাৎক্ষণিকভাবে তা বোঝা যায় না। প্রতিনিয়ত তা যেমন পর্যবেক্ষণে রাখতে হয়, তেমনি এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া মোকাবেলায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হয়। এ কাজ করার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতা দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। ঝড়-ঝঞ্ঝা, জলোচ্ছ্বাস মোকাবেলা করার ক্ষমতা মানুষের নেই। তবে তার ক্ষয়ক্ষতি কমানোর উদ্যোগ নেয়া যায়। এর প্রধানতম কাজ হচ্ছে, উপকূলজুড়ে ব্যাপক হরে সবুজ বনায়নের মাধ্যমে প্রাকৃতিক বেষ্টনী তৈরি করা। এটা কঠিন কোনো কাজ নয়। আমরা দেখেছি, আইলা, সিডর, নার্গিসের মতো ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়ে কিভাবে উপকূল লন্ডভন্ড হয়েছে। ’৭০ ও ’৯১-এর ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহ আঘাতে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু ও সম্পদের অপরিসীম ক্ষতি ইতিহাস হয়ে রয়েছে। এ ধরনের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের তান্ডব এবং ক্ষতি রুখে দিতে পারে উপকূলজুড়ে সবুজ বনায়ন ও বেষ্টনী। সরকারের পক্ষ থেকে বহু বছর ধরে এ ধরনের উদ্যোগ চলমান এবং বিশ্ব জলবায়ু তহবিল থেকেও ফান্ড পাচ্ছে। তবে এ কার্যক্রম যে যথাযথভাবে করা হচ্ছে না, তা উপকূলের বন উজাড় হওয়ার মধ্য দিয়েই বোঝা যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট বন বিভাগ ও প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় বন ও ভূমিখেকো নির্বাধে বন উজাড় করে চলেছে। পুরো উপকূল ন্যাড়া করে ফেলছে। সাধারণত উপকূলীয় তটরেখা বরাবর শতকরা ৮০ ভাগ সবুজ বেষ্টনী থাকতে হয়। বর্তমানে স্থানভেদে রয়েছে ২০ থেকে ৩০ ভাগ। অন্যদিকে, দেশে মোট আয়তনের ২৫ ভাগ বনাঞ্চল থাকা অপরিহার্য হলেও রয়েছে মাত্র ৮ থেকে ১০ ভাগ। এ এক ভয়াবহ চিত্র। উপকূলের বনাঞ্চলের এমন শোচনীয় অবস্থায় শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় আঘাত করলে কি ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি হবে, তা কল্পনাও করা যায় না। বলার অপেক্ষা রাখে না, চট্টগ্রাম, মহেশখালিসহ উপকূলীয় অঞ্চলে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে যে অর্থনৈতিক অঞ্চল ও বড় বড় প্রকল্প গড়ে তোলা হচ্ছে এবং চট্টগ্রাম বন্দর রয়েছে, ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে এগুলো ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়বে। শুধু উপকূলীয় অঞ্চল নয়, বিশ্বের একমাত্র ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনকে যেভাবে উজাড় করা হচ্ছে, তা এখন অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখি। অথচ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তো বটেই অতীতেও এই সুন্দরবন ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহ আঘাত ঠেকিয়ে দিয়েছে। দেখা যাচ্ছে, বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় এসব কোনো কিছু বিবেচনায় নিচ্ছে না। নাকের ডগার সামনে নির্বিচারে উপকূলীয় বনাঞ্চল ও সবুজ বেষ্টনীর ধ্বংসযজ্ঞ চললেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস এবং জলবায়ুর বিরূপ পরিবর্তন মোকাবেলায় উপকূলীয় বনাঞ্চল ও সবুজ বেষ্টনীর অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য। প্রাকৃতিক দুর্যোগের রক্ষাবুহ্য হয়ে থাকা বনাঞ্চল ধ্বংস করে পুরো উপকূলকে যেভাবে অরক্ষিত করা হচ্ছে, তা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। চোখের সামনে এমন ভয়াবহ অপকর্ম ঘটলেও বন ও পরিবশে মন্ত্রণালয় কেন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না? তার কাজ কি নীরবে এসব ধ্বংসযজ্ঞ দেখা? দেশের পরিবেশ ও প্রতিবেশকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেয়া? আর বনাঞ্চল ধ্বংসের লিজ দেয়া ও সার্টিফিকেট ব্যবসা করা? অথচ উপকূলজুড়ে বনায়ন সরকারের অগ্রাধিকারভিত্তিক কর্মসূচি। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এ কর্মসূচির যথাযথ বাস্তবায়নে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। আমরা মনে করি, এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। উপকূলীয় অঞ্চলে সবুজায়ন কর্মসূচি কতটা বাস্তবায়িত হচ্ছে, কারা ধ্বংস করছে, কেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় তা প্রতিরোধ করছে না, এ ব্যাপারে জবাবদিহি ও ব্যাখ্যা চাওয়া জরুরি। যাদের মদদে যারা এর সাথে জড়িত তাদের চিহ্নিত করে আইনানুগ কঠোর ব্যবস্থা নেয়া সময়ের দাবী।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।