পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
কমলাপুর রেল স্টেশন বর্তমান স্থানে স্টেশন থাকলে তা নির্মাণাধীন ঢাকা মেট্রো রেলের স্থাপনার আড়ালে পড়বে। আবার স্টেশনকে ঘিরে নেওয়া মাল্টিমোডাল হাব নির্মাণ প্রকল্পও বাধাগ্রস্ত হবে। এ বিবেচনায় স্টেশনটি ১৩০ মিটার উত্তরে সরিয়ে নেওয়ার অনুমোদন দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। গত বছরের চব্বিশে নভেম্বর বাংলাদেশ রেলওয়ে ও মেট্রো রেল কর্তৃপক্ষের বৈঠকের পর রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী বর্তমান স্টেশন ভবনটি ভেঙে ফেলা হবে এবং এর উত্তরে অনুরূপ একটি স্টেশন তৈরি করা হবে। এটি যেহেতু একটি আইকনিক স্থাপনা, তাই এটি ভেঙে ফেলার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।’
খবরটি প্রকাশের পর উল্লেখযোগ্য প্রতিক্রিয়া চোখে পড়লো না। খানিকটা প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন কয়েকজন স্থপতি। সেটাও সংবাদমাধ্যম প্রকাশ করলো বেশ হেলাফেলায়। জেষ্ঠ্য স্থপতি ও নগরবিদরা বিস্ময় ও অসন্তোষ প্রকাশ করে যা বলেছেন তার সারমর্ম হলো: প্রত্যেক জনপদে বা নগরে এমন কিছু ‘ল্যান্ডমার্ক স্থাপনা’ থাকে যাতে হাত দিতে হাজারবার ভাবতে হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নগরে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগানোর সময় উন্নত বিশ্বেও ‘ল্যান্ডমার্ক স্থাপনাগুলো’ অক্ষুণ্ণ রেখেই পরিকল্পনা করে। কেননা এসব স্থাপনা শহরকে প্রতিনিধিত্ব করে। কিছু কিছু স্থাপনা থাকে যেগুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শহরের ইতিহাস-ঐতিহ্যে পরিণত হয়। স্থাপনাগুলো ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত থাকে, কারণ বিখ্যাত লোকজনের ডিজাইনে এগুলো তৈরি হয়।
উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন মানেই ভাঙ্গা-গড়ার মহাজজ্ঞ। নতুন কিছু গড়তে পুরনোর মায়া ত্যাগ করতে হয়। আমাদের মতো দেশে অনেক ক্ষেত্রে যত্নে বেড়ে ওঠা শতবর্ষী বৃক্ষ বা ঐতিহ্যের স্মারক ধ্বংসের কবলে পড়ে। পরিবেশবিদ ও ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতি অনুরক্তরা প্রতিবাদ-প্রতিক্রিয়া জানালেও সেটা কমই আমলে নেওয়া হয়। ররং প্রতিবাদকারীদের চরম মূল্য দেওয়ার নজিরও কম নয়।
কমলাপুর স্টেশনটি ঢাকার অন্যতম ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা। দেশের কেন্দ্রীয় রেলস্টেশন। এটি সবচেয়ে বড় ট্রেনস্টেশনও। ষাটের দশকের আধুনিক স্থাপত্য নিদর্শনগুলোর মধ্যেও অন্যতম। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, পূর্ববঙ্গের প্রথম রেল যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৮৬২ সালে কলকাতা ও কুষ্টিয়ার মধ্যে। ট্রেন যোগাযোগ ব্যবস্থাকে দেখা হয়েছিল পূর্ববঙ্গের ঔপনিবেশিক অর্থনীতির চালিকা শক্তি হিসেবে। কিন্তু পদ্মার পূর্বে তখন কোনো রেল যোগাযোগ ছিল না। পূর্ব বাংলায় নদী-খালের আধিক্য ট্রেন যোগাযোগ ব্যবস্থাকে জোরালো হতে দেয়নি। ১৮৮৫ সালেও পদ্মার পূর্বে ট্রেন যোগাযোগ ছিল শুধু ঢাকা আর ময়মনসিংহের সঙ্গে। ঢাকার ফুলবাড়িয়ায় অবস্থিত রেল স্টেশন ছিল একেবারেই সাদামাটা। তা ছাড়া এই স্টেশনটি ঢাকার দক্ষিণ আর উত্তরের সড়ক যোগাযোগব্যবস্থাকে বিভাজিত করে ফেলেছিল। অবশেষে ১৯৫৮ সালে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হলো যে, স্টেশনকে এমন জায়গায় সরিয়ে নিতে হবে, যাতে উত্তর-দক্ষিণ সড়ক যোগাযোগে কোনো বাধা না থাকে। সে অনুযায়ী ১৯৬৮ সালে নির্মিত কমলাপুর রেল স্টেশন পূর্ববঙ্গেও ট্রেন যোগাযোগের এক নতুন অধ্যায় তৈরি করে। ১৫৬ একর জায়গায় নির্মিত স্টেশনটি ঢাকা নগরের আধুনিকায়নের অন্যতম প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। এখানে রয়েছে ১০টি প্লাটফর্ম, ১১টি টিকিট কাউন্টার, আর অনেক যাত্রী বিশ্রামকেন্দ্র।
স্থাপত্যশৈলির দিক থেকেও কমলাপুর স্টেশনটি অনিন্দ্যসুন্দর ও ব্যতিক্রমী। এর স্থপতি ছিলেন দুজন মার্কিন। ড্যানিয়েল বার্নহ্যাম এবং বব বুই। দুজনেই এই দেশে এসেছিলেন লুই বার্জার অ্যান্ড কনসালটিং ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের স্থপতি হিসেবে। বার্নহ্যাম পড়াশোনা করেছেন হার্ভার্ডে। বুই নিউইয়র্কের প্র্যাট ইনস্টিটিউটে ও লন্ডনের এএ স্কুলে। কমলাপুর রেল স্টেশনে বার্নহ্যাম ও বুই তৈরি করতে চেয়েছিলেন আধুনিক স্থাপত্য আর গ্রীষ্মন্ডলীয় আবহাওয়ার উপযোগী নির্মাণশৈলীর সংযোগ ঘটিয়ে একটি বিরল স্থাপত্যকর্ম হিসেবে। অনেক গবেষণার পর তাঁরা প্রস্তাব করলেন ছাতার মতো একটি স্থাপনা। মূলত কংক্রিটের অনেকগুলো প্যারাবোলিক ডোমের সমন্বয়। তার নিচে স্টেশনের সব কর্মকান্ড।
৩৬টি বর্গক্ষেত্রের সমন্বয়ে পুরো স্থাপনাটি একটি বৃহৎ বর্গক্ষেত্র। ৪৯টি কলামের ওপরে দাঁড়িয়ে আছে ৩৬টি সরু কংক্রিটের ডোম নিয়ে একটি ছাদ উচ্চতা ৫৯ ফুট প্রতিটি কলাম ওপরের দিকে গিয়ে চারটি শাখা বিস্তার করে ছাদটাকে ধরে রেখেছে। এ স্থাপনার প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, শুধু ছাদ আর চারদিকে খোলামেলা। কমলাপুরের নির্মাণশৈলীতে ডেনমার্কের স্থপতি জন উটজনের ডিজাইন করা সিডনির বিখ্যাত অপেরা হাউসের অনুপ্রেরণা, নিউইয়র্কে অবস্থিত এরও সারিনেনের টিডাব্লিওএ টার্মিনালে কবিতার মতো গতিময় স্থাপত্যের ভাষা আর মোগল স্থাপত্যের প্যাভিলিয়ন ধাঁচের স্থাপনার প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে বলে মনে করেন প্রখ্যাত স্থপতিরা ।
কমলাপুর রেল স্টেশনের আধুনিক স্থাপত্যধারা বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত ছিল বিরল। বৈশ্বিক স্থাপত্য ইতিহাসে এই ভবনের আলোচনা হয়, যখন এর নির্মাণকাজ শেষ হয়েছিল, এটাকে বলা হচ্ছিল বিশ্ব স্থাপত্যের নিদর্শন। এই স্থাপত্যকর্মের রাজনৈতিক তাৎপর্য বুঝে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান কমলাপুরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছিলেন। এটা ছিল পূর্ব পাকিস্তানে আইয়ুব খানের উন্নয়ন দশকের (১৯৫৮-৬৮) অন্যতম প্রতীক। পাঁচ দশকের ওপরে এই রেল স্টেশন ঢাকার প্রবেশপথ, ঢাকার তোরণ। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস। এ রকম একটি তাৎপর্যপূর্ণ স্থাপত্যকর্ম ভেঙে ফেলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষতি কত? রেল কর্তৃপক্ষ কি একবারও ভেবেছে উন্নয়নের দীর্ঘমেয়াদি তাৎপর্য?
উন্নয়ন ও আধুনিকতার ছোঁয়া যে কোন দেশের স্বাভাবিক গতিধারার অংশ। কিন্তু যে কোন উন্নয়ন পরিকল্পনার গ্রহণের সময় ‘আইকনিক স্থাপনা’ রেখে করা জরুরি। আইকনিক স্থাপনাগুলো শহরকে প্রতিনিধিত্ব করে। নাগরিকের স্মৃতি ও অনুভূতিকে সম্মান দেখিয়ে নতুন পরিকল্পনা করা বাঞ্ছনীয়। কীভাবে একটি পুরোনো স্থাপত্য নিদর্শন রেখে নতুন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যায় তা অগ্রাধিকার পাবে এটাই কাম্য। কমলাপুরের সঙ্গে নিশ্চয়ই অনেক জ্যেষ্ঠ নাগরিকের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। এই স্মৃতির মূল্য কতটুকু সেটি নবীন পরিকল্পনাবিদরা অনুধাবন করবেন সেটাই প্রত্যাশিত।
মেট্রোরেল প্রকল্পটি নিঃসন্দেহে একটি জনআকাক্সক্ষার এবং বহুল প্রত্যাশিত যোগাযোগ খাতের প্রকল্প। যানজটের ঢাকা নগরিতে মানুষ যখন হাসফাঁস করছে তখন তাদের অধীর আগ্রহে মেট্টোরেল চালুর প্রতীক্ষার কথা কে না জানে। বাস্তবায়নাধীন মেট্রোরেল-৬ এর রুট কিন্তু কমলাপুর পর্যন্ত ছিল না। এটি ছিল উত্তরার দিয়াবাড়ি থেকে মতিঝিল পর্যন্ত। হঠাৎ করেই প্রকল্পটি সম্প্রসারণ করে কমলাপুর পর্যন্ত নেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়। তাও প্রকল্পটি বাস্তবায়নের শেষ পর্যায়ে এসে। মতিঝিলে পরিকল্পিত মেট্রোরেলের সর্বশেষ স্টেশন থেকে কমলাপুরের দূরত্ব হাঁটার। উন্নত বিশ্বে এর চেয়ে অনেক বেশি পথ হেঁটে মানুষ রেল বা বাস স্টেশনে যায়। এক কিলোমিটারেরও কম দূরত্বে থাকা কমলাপুর স্টেশনকে মেট্রোরেলের সঙ্গে যুক্ত করতে গিয়ে যে ব্যয় ও ঐতিহ্য বিনাশের উদ্যোগ তা কারো কাম্য হতে পারে না। কমলাপুর স্টেশনটি ভাঙ্গার বিকল্প সন্ধানের সময় এখনও শেষ হয়ে যায়নি। স্টেশনের দক্ষিণ পাশে যেসব স্থাপনা রয়েছে বরং সেগুলোর সরানোর কথা বিবেচনা করা যেতে পারে।
লেখক: সাংবাদিক ও সভাপতি, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।