Inqilab Logo

শক্রবার ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ কার্তিক ১৪৩১, ০৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

এগিয়ে যাচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম

নাছির উদ্দিন | প্রকাশের সময় : ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:০১ এএম

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রাণকেন্দ্র বাংলাদেশের প্রায় এক দশমাংশ আয়তনের রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলা নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল গঠিত। এ তিনটি জেলার মোট আয়তন ১৩,২৯৫ বর্গ কিলোমিটার। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী মোট জনসংখ্যা ১৫,৮৭০০০ জন। পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট জনসংখ্যার ১১টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ৫০ ভাগ এবং বাকি ৫০ ভাগ অ-উপজাতীয়। তাঁরা নিজ নিজ ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, ঐতিহ্য, ও কৃষ্টির স্বকীয়তা বজায় রেখে যুগ যুগ ধরে পাশাপাশি বসবাস করে আসছে। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল দীর্ঘদিন ব্রিটিশ ও পাকিস্তান শাসনাধীনে থেকে যথেষ্ট পশ্চাদপদ ও অনুন্নত ছিল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বিভিন্ন বাস্তবভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল ধাপে ধাপে উন্নয়নের গতিধারায় যুক্ত হতে শুরু করে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা সপরিবারে নিহত হওয়ার পর এ অঞ্চলের বহুমুখী উন্নয়ন পরিকল্পনা ও অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী উদ্যোগ ও যোগ্য নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাসরত জনেগাষ্ঠীর জীবনমানের উন্নয়ন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনসহ দারিদ্রমোচন, সকল নাগরিকের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষাগত ও অর্থনৈতিক অধিকার এবং আর্থসামাজিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিতকরণের লক্ষ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটির সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে ঐতিহাসিক ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়, যা পরবর্তীতে ‘শান্তি চুক্তি’ নামে পরিচিতি হয়।

শান্তি চুক্তির অন্যতম ফসল পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, যা চুক্তি স্বাক্ষরের পরবর্তী বছর ১৯৯৮ সালের ১৫ জুলাই প্রতিষ্ঠার পর থেকে মন্ত্র্রণালয়টি পার্বত্যবাসীর সার্বিক কল্যাণে এবং শান্তিচুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নে ভূমিকা রেখে চলেছে। চার খন্ডে বিভক্ত পার্বত্য শান্তি চুক্তিতে মোট ৭২টি ধারা রয়েছে। এর মধ্যে ৪৮ টি ধারা ইতোমধ্যে সম্পূর্ণ, ১৫টি আংশিক এবং অবশিষ্ট ৯টি ধারা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। পার্বত্য চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সমূহের সহযোগিতা অব্যাহত রয়েছে।

যুগ যুগ ধরে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও জাতিসত্তা এবং অ-উপজাতীয় জনগণ বসবাস করছে। উপজাতীয়রা যেমন একদিকে সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের অধিকারী, অন্যদিকে তার মূল জনগোষ্ঠীর অপরিহার্য অংশ। স্বাধীনতার পর থেকে এ অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে আসছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের আওতায় রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও অখন্ডতার প্রতি পূর্ণ ও অবিচল আনুগত্য রেখে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের সকল নাগরিকের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষাগত ও অর্থনৈতিক অধিকার এবং আর্থসামাজিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করাসহ বাংলাদেশের সকল নাগরিকের স্ব স্ব অধিকার এবং সংরক্ষণ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী ১৯৯৮ সালের ১৫ জুলাই পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠিত হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন দপ্তর/প্রতিষ্ঠানসমূহ: পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসন এবং অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু নির্দিষ্টকরণ ও পুনর্বাসন বিষয়ক টাস্কফোর্স, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ, এবং বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ।

পার্বত্য চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করার জন্য আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ, এমপি’কে আহবায়ক করে পার্বত্য চুক্তি পরীবিক্ষণ ও বাস্তবায়ন কমিটি ১৮ জানুয়ারি ২০১৮ তারিখে পুনর্গঠন করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জমির অধিকার নিশ্চিতকরণ এবং সুরক্ষার লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন, ২০১৬ (সংশোধিত) জারি করা হয়েছে। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন বিধিমালা জারির লক্ষ্যে ভূমি মন্ত্রণালয়ে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। শান্তি চুক্তির আলোকে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে বর্তমান সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

সরকারের ঐকান্তিক সদিচ্ছা ও প্রত্যক্ষ তত্ত¡াবধানে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের জনগণের প্রভূত আর্থসামাজিক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। তা সত্তে¡ও দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল উন্নয়ন সূচকে দেশের অপরাপর অঞ্চলের তুলনায় এখনো পিছিয়ে আছে। পিছিয়ে থাকা এ অঞ্চলকে দেশের উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত করতে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের জনগণের আর্থসামাজিক উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য দারিদ্র্যমোচন, আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি, সুপেয় পানি, অবকাঠামো নির্মাণ, সৌর বিদ্যুৎ সুবিধা প্রদান স¤প্রসারণ ইত্যাদি কার্যক্রমকে অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়েছে। বর্তমান সরকারের প্রেক্ষিত পরিকল্পনার আলোকে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় উন্নত ও সমৃদ্ধ পাবর্ত্য চট্টগ্রাম বিনির্মাণের লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে।
বর্তমান সরকার বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর মাতৃভাষায় প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা নৃ-গোষ্ঠীসমূহে নিজ ভাষায় প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানের কার্যক্রম জানুয়ারি ২০১৭ থেকে শুরু হয়েছে। এই তিন নৃ-গোষ্ঠীর প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের তাদের মাতৃভাষার পাঠ্যপুস্তক বিনামূল্যে নববর্ষের প্রথম দিন বিতরণ করা হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘ দুই যুগব্যাপী সংঘাতের কারণে পিছিয়ে থাকা অনগ্রসর মানুষের জীবনমান ও আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে বর্তমান সরকার উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে উন্নয়ন বরাদ্দ ছিল ৬৮.৯০ কোটি টাকা। এই উন্নয়ন বরাদ্দ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২০-২১ অর্থ বছরে দাঁড়ায় ৮৬৪.৪ কোটি টাকা। এছাড়াও সরকারের অন্যান্য মন্ত্রণালয়/বিভাগও নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল মানুষের সার্বিক উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প/কর্মসূচি বাস্তবায়ন অব্যাহত রেখেছে।

পাহাড়ি মানুষের নিবিড় সেবা প্রদানের লক্ষ্যে সৃষ্ট পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় পার্বত্য এলাকার উন্নয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারসহ এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), ইউএনডিপি, ইউনিসেফ প্রভৃতি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা পার্বত্যবাসীর সামগ্রিক উন্নয়নে ও সামাজিক নিরাপত্তা বিধানের লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ২০১৮-২০১৯ অর্থ বছরে এ মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ ছিল ১০১৭.৬৫ কোটি টাকা যার মাধ্যমে তিন পার্বত্য জেলায় সর্বমোট ২২১৮টি প্রকল্প/স্কিম বাস্তবায়ন করা হয়েছে।

Leave no one behind এসডিজির এই নীতিকে সামনে রেখে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল এবং এই অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির জন্য অবকাঠামোসহ অন্যান্য খাতসমূহে সুষম উন্নয়নের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় নিরলসভাবে কাজ করছে। ফলে বর্তমানে বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের পার্বত্য এলাকার অধিবাসীগণ এখন দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সাথে একই তালে উন্নয়ন ও অগ্রগতির অভিযাত্রায় শামিল।
লেখক: জনসংযোগ কর্মকর্তা, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পার্বত্য-চট্টগ্রাম
আরও পড়ুন