পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বাংলাদেশে বিনামূল্যে সকল শিক্ষার্থীর মধ্যে বই বিতরণ হবে, আমাদের কাছে তা এক সময় কল্পনাতীত ছিল। এই অসাধ্য কাজটি ২০১০ সালে শুরু হয়। প্রতিবছর প্রায় চারকোটি শিক্ষার্থীর ৩৫ কোটি বই দেওয়া হয়। আমরা যারা সেকালের লোক তারা কোনভাবেই ভাবতে পারিনি একালে সকল শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বিনা মূল্যে বই পাবে। সেকালে আমরা যারা লেখাপড়া করেছি, তখন আমরা অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া করেছি। আমাদের চেয়ে আরো বেশী কষ্ট করেছে আমাদের বাবা এবং দাদারা। দেশ স্বাধীনের আগে এবং পরে গ্রামের গরিব শিক্ষার্থীরা যে কষ্ট করে বই সংগ্রহ করে পড়েছে তার কিছু কথা পাঠক মহলের উদ্দেশ্যে বলছি। আমি দেশ স্বাধীনের পরের ঘটনাই বলছি। বৃটিশ-পাক আমলের কথা না’ই বললাম। দেশ স্বাধীনের পর আমি যখন স্কুলে আসা-যাওয়া করছি, তখন আমার আব্বা বাজার থেকে একটি বাল্য শিক্ষা বই, ধারাপাত বই, লেখার জন্য কাঠের বাঁধাই করা কালবোর্ড, চক এবং পেন্সিল ইত্যাদি কিনে এনে দিয়েছিলেন। আমি পরম আনন্দে তখন স্কুলে গিয়াছি এবং পড়েছি। আমার সাথের অনেক সহপাঠী তাও কিনতে পারতো না। অনেকে একটি বাল্য শিক্ষা বই নিয়ে স্কুলে আসা যাওয়া করতো। অনেক সময় কাঠের পেন্সিল দিয়ে কলা পাতায় লিখতো।
আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আমরা যা নিয়ে বিদ্যালয়ে গিয়েছি তা দিয়েই আমাদের খুব যত্নসহকারে পড়াতেন। গ্রামের মা, বোন, খালা, চাচাী, জেঠিরা তাদের ছেলে-মেয়েদের জন্য হাঁস, মুরগী এবং ডিম বিক্রি করে বই, খাতা, কলম ইত্যাদি কিনে দিতেন। গ্রামের সাধারণত চার শ্রেণির শ্ক্ষিার্থী দেখা যেতো। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্ন বিত্ত এবং খুব গরীব। গ্রামের উচ্চবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত লোকের ছেলে-মেয়েরা জানুয়ারী মাসে বাজার থেকে নতুন বই কিনতো। আর নিম্ন মধ্যবিত্তরা এবং গরীব ছেলে-মেয়েরা আগের বছরের পুরাতন বই বাজার থেকে কিনে আনতো বা সংগ্রহ করতো। যারা নতুন বই কিনতো আমরা এক বছর আগে থেকেই তাদেরকে বলে রাখতাম আগামী বছর আপনার পড়া বইগুলি আমি কিনে নেবো, আপনি যত্ন করে রাখবেন। ঠিক এক বছর পর বার্ষিক পরীক্ষার ফল বের হওয়ার পর আমরা অর্ধেক মূল্যে আমাদের বড় ভাই-বোনদের নিকট থেকে বই কিনে আনতাম। পুরাতন বই কিনে আনার সময় বইয়ের সকল পাতা ঠিক আছে কিনা তা প্রতি পৃষ্ঠা গুনে গুনে দেখতাম। এখনকার চেয়ে তখনকার বইগুলি খুবই ভালো ছিল। বইয়ের কাগজগুলো খুব শক্ত পুরো বাঁধাই এবং গঠনপ্রাণালী মজবুত ছিল। এক বছরের বই তিন-চার বছর পড়া যেতো। যাদের ঘরে ভাই-বোন বেশি ছিল, তারা একবার নতুন বই কিনলে ছোট ভাই-বোন সবাই পড়তো। ২/৩ বছর আর বই কিনা লাগতো না।
বাজার থেকে নতুন বই কিনে এনে আমরা খুব শক্ত করে সেলাই করে মলাট বা কভার বাঁধাই করতাম। পরের বছর বইয়ের মলট বা কভার খুললে একদম নতুন দেখাতো। তখনকার নতুন বই থেকে একটি গন্ধ বের হতো যা ভালো লাগতো। এক সেট বই কিনে দুই, তিন বছর পড়লেও তেমন নষ্ট হতো না। এখনকার নতুন বইগুলি দেখলে খুব নিম্নমানের মনে হয়। বইয়ের গঠণপ্রণালী এবং বাধাই তেমন মজবুত নয়। এক বছর বা ছয় মাস না যেতেই বই নষ্ট হয়ে যায়। বর্তমানে ছেলে-মেয়েদের প্রায়ই বই-খাতা কিনে দিতে হয়। তারা এক বছরের বই পরের বছর পড়ার প্রয়োজন বোধ করে না। অনেক সময় বলে, আমি কি পুরাতন বই পড়বো নাকি? আমরা যদি আমাদের এই কষ্ট করে লেখাপড়া করার কথা তাদেরকে বলি তারা তা বিশ্বাস করতে চায় না। এ সকল কথা বললে তারা আরো বেশি হাসা-হাসি করে। এখনকার বইগুলিকে ওয়ান টাইম ব্যবহারের উপযোগী মনে হয়। আমরা বাংলা, ইংরেজি, ব্যাকরণ বই এবং জ্যামিতি বক্স একবার কিনলে তা পর্যায়ক্রমে সকল ভাই-বোন পড়েছি এবং ব্যবহার করেছি। এইগুলি আর দ্বিতীয়বার কিনি নাই। বই, খাতা, কলম খুব যত্ন করে রেখেছি। অনেক সময় নিজের শরীরকে কষ্ট দিয়েছি কিন্তু, পাঠ্যবইয়ের কোন ক্ষতি যেন না হয় সেদিকে সর্বদা খেয়াল রেখেছি। আমরা সারা বছর যে টেনশন নিয়ে লেখাপড়া করেছি। তার চেয়ে বেশি টেনশন ছিল বার্ষিক পরীক্ষার ফল বের হলে নতুন ক্লাসের বই সংগৃহ করা।
আমরা বই কিনার জন্য আমাদের আব্বা, বড়ভাইয়ের সাথে জানুয়ারী থেকে মার্চ পর্যন্ত মাঠের পর মাঠ দৌড়িয়ে পার হয়ে বাজারে গিয়েছি নতুন, পুরাতন বই দেখেছি এবং কিনেছি। যে সহপাঠী নতুন বই কিনেছে তার সাথে ঘনিষ্ট বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছি, তার বাড়ী গিয়েছি এবং খেয়েছি। তার থেকে বই ধার এনে পড়েছি, আবার যথা সময়ে ফেরত দিয়েছি। আমাদের সময় গ্রামের অধিকাংশ শিক্ষার্থী পুরাতন বই পড়তো এবং সংগ্রহ করতো। আর কমসংখ্যাক শিক্ষার্থী নতুন বই কিনে পড়তো। গ্রামের শিক্ষার্থীর কাছে নতুন ক্লাসের বই কিনা ছিল বিরাট খুশির বিষয়। বইয়ের এবং সাংসারিক অভাব-অনটনে অভাবে অনেক শিক্ষার্থীর পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যেতো। বই কেনার সাথে আরো অনেক অভাব দেখা দিতো, ফলে লেখাপড়া থেকে বঞ্চিত হতো হাজারো শিক্ষার্থী। আমরা যারা নতুন ক্লাসের বই সংগ্রহ করেছি বা নতুন বই কিনতে পেরেছি আমাদের কাছে আনন্দের আর সীমা থাকতো না। মনে হতো যেন আমাদের পিতা-মাতা অনেক বিরাট কিছু করে দিয়েছে। সেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে আমরা সারা বছর খুব যত্নসহকারে লেখাপড়া করেছি, পিতা-মাতা এবং স্কুলের শিক্ষকদের অনুগত থেকেছি।
এখন আমাদের ছেলে-মেয়েদের অনেক অজুহাত। তাদের হাজার সমস্যার সমাধান করে দিলেও আমাদের মতো তেমন খুশি হয়না এবং অনুগত থাকেনা। এখনকার মতো যদি দেশ স্বাধীনের পর বিনামূল্যে বই বিতরণ করা হতো, তাহলে এখন আমাদের দেশে শিক্ষিতের হার শতভাগ হতো। দারিদ্রের হার হ্রাস পেতো। মানুষ আরো বেশি স্বনির্ভর হতো। তাই দেরিতে হলেও আমাদের দেশে বিনামূল্যে বই বিতরণ কর্মসূচী সাফল্যের সাথে এগিয়ে যাচ্ছে। স্কুল থেকে শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়ার সংখ্যা কাঙ্খিত মানে হ্রাস পেয়েছে। বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়ে উন্নত রাষ্ট্রের দিকে যাচ্ছে। ২০১০ সালে দুই কোটি ৭৬ লাখ ৬২ হাজার ৫২৯ শিক্ষার্থীকে দেওয়া হয় ১৯ কোটি ৯০ লাখ ৯৬ হাজার ৫৬১টি বই। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড থেকে আরো জানাযায় ২০১০ শিক্ষাবর্ষ থেকে ২০২১ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত মোট ১২ বছরে ৩৬৫ কোটি ৮৪ লক্ষ ৪৫ হাজার ৭৮১টি বিনা মূল্যের বই বিতরণ করা হয়েছে।
লেখক: শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।