Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নদী রক্ষায় অবহেলা কাম্য নয়

আর কে চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ৩০ জানুয়ারি, ২০২১, ১২:০২ এএম

এক বছরে সারাদেশের নদী দখলদারদের মাত্র ৩৩ শতাংশ উচ্ছেদ করা গেছে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংবিধিবদ্ধ সংস্থা জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন বলেছে, উদ্ধারকাজ প্রত্যাশিত পর্যায়ে হয়নি। নানামুখী চাপে অনেক জায়গায় উচ্ছেদ অভিযান বেশি দূর এগোয়নি। আবার একই অববাহিকা অঞ্চলের সব নদীতে একসঙ্গে অভিযান না হওয়ায় উচ্ছেদের সুফলও আসেনি। দখলমুক্ত করার পর অনেক জায়গা ইতোমধ্যে আবারও অবৈধ দখলে চলে গেছে। সেখানে অস্থায়ী স্থাপনা গড়ে উঠেছে। এখন পর্যন্ত দেশের আট বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে কম উচ্ছেদ হয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগে। আর সবচেয়ে বেশি ঢাকায়। জেলা প্রশাসনের সহায়তায় সারাদেশে ৫৭ হাজার ৩৯০ জন অবৈধ দখলদার চিহ্নিত করেছে জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন। ঢাকার তুরাগ, বালু, বুড়িগঙ্গা নদীও দিন দিন অস্তিত্ব হারাচ্ছে। দখল, দূষণ আর নাব্য সংকটই এর মূল কারণ। তবে শুধু নদ-নদীর ধারে ওয়াকওয়ে নির্মাণ ও বনায়ন সৃষ্টি করে অস্তিত্ব ফিরে পাওয়া যাবে না। প্রথমে দূষণ রোধ, এরপর দখল ও সরাসরি প্লাস্টিক বর্জ্য নদ-নদীতে না ফেলার বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে।

জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনকে নদীরক্ষায় উচ্ছেদ ও উদ্ধার, পানি ও পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধের দায়িত্ব দেওয়া হলেও প্রায়োগিক আইনি ক্ষমতা ও প্রয়োজনীয় জনবল, পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ না থাকায় জেলা-উপজেলা প্রশাসন, অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও পরিবেশ অধিদফতরের ওপরই নির্ভর করতে হয়েছে। কালেক্টর, রাজস্ব কর্মকর্তা, বিআইডবিøউটিএ নদ-নদীর জমি ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানকে লিজ, দখল হস্তান্তর করেছে, তাদের দ্বারা উচ্ছেদ বা উদ্ধারকাজ শুরু করানো গেলেও প্রত্যাশিত পর্যায়ে সুফল অর্জিত হয়নি। কমিশনের পক্ষ থেকে বারবার অনুরোধ করা সত্তে¡ও অবস্থার প্রত্যাশিত পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব হয়নি। ঢাকা নদীবন্দর কর্তৃপক্ষ বলছেন, নদ-নদীগুলোর অস্তিত্ব ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। নদ-নদী দখল-দূষণের সঙ্গে জড়িতদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে।

নদী গবেষকেরা বলছেন, ষাটের দশকে সাড়ে ৭০০ নদী ছিল বাংলাদেশে। এ সংখ্যা কমে মাত্র ২৩০টিতে দাঁড়িয়েছে। ৫০ বছরে হারিয়ে গেছে ৫২০টি নদী। অবশ্য সরকারি হিসাবে দেশে এখন নদীর সংখ্যা ৪০৫। বাস্তবতা হলো, শুকনো মওসুমে এসব নদীতে পর্যাপ্ত পানি থাকে না।
নদীর ‘মৃত্যু’র নানা কারণ রয়েছে এবং সেগুলো সরকার, প্রশাসন, সংশ্লিষ্ট গবেষক এবং সাধারণ মানুষও জানেন। নদীর অস্তিত্বের জন্য প্রধান হুমকি হলো দখল ও দূষণ। খোদ রাজধানীর চারপাশের নদীগুলোও মরে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত দখল ও দূষণের কারণে। ঢাকার চারপাশের শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বুড়িগঙ্গার সর্বত্রই চলছে দখলবাজদের আগ্রাসী থাবা। শুধু নদীর দুই পাড় দখল করেই ক্ষান্ত হয়নি দখলবাজরা, তারা প্রবহমান নদীর পানিতেও বাঁশ-কাঠের মাচান তুলে বানিয়েছে ঘরবাড়ি, দোকানপাট ও বালুমহাল। বিষাক্ত তরল বর্জ্যে বিপন্ন হয়েছে পরিবেশ; নাগরিক জীবনেও নেমে এসেছে নানা বিপর্যয়।

রাজধানীতেই যখন এমন অবস্থা, তখন সারা দেশের নদ-নদীর অবস্থা কেমন তা সহজেই বোঝা যায়।
নদীর সাথে পরিবেশের সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। নদী যেমন তার প্রবাহের সাথে জনপদের বর্জ্য সরিয়ে নিয়ে যায়, তেমনি নদীর পানির কারণে আশপাশের পরিবেশ থাকে অপেক্ষাকৃত শীতল। নদী থেকেই উৎসারিত হয় জলীয়বাষ্প এবং তা আবার বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে। নদী না থাকলে এ প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াটি ব্যাহত হবে, যার আলামত এরই মধ্যে অনেকটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দেশে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমছে এবং খরাপ্রবণতা বাড়ছে। উষ্ণ হয়ে উঠছে আবহাওয়া। নদীর সাথে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের যে সম্পর্ক নিবিড়ভাবে জুড়ে আছে যেমন, ফসল ফলানো, যাতায়াত, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদির প্রসঙ্গ বাদ দিলেও পরিবেশের বিষয়টি কোনোভাবেই উপেক্ষা করার মতো নয়। নদী না থাকা এবং নদীদূষণের সাথে মানুষের স্বাস্থ্যগত ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও রয়েছে।

সত্যিকার অর্থে নদীর অস্তিত্ব বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের অতি আলোচিত বিষয়ের সাথে জড়িত। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের এক বড় শিকার। বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশের বিরাট এলাকা সমুদ্রে তলিয়ে যাবে। এ পরিস্থিতি মোকাবেলার সক্ষমতা এককভাবে আমাদের নেই। কিন্তু দেশের নদ-নদী রক্ষার মাধ্যমে আমরা সম্ভবত পরিস্থিতির অবনতির মাত্রা কমিয়ে আনতে পারি। আন্তর্জাতিক নদীর ওপর একের পর এক বাঁধ দিয়ে এগুলোর পানিপ্রবাহে প্রতিবেশী বৃহৎ দেশের বাধা সৃষ্টি করা আমাদের জন্য মৃত্যুর চেয়েও কঠিন।

লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, উপদেষ্টা, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, সদস্য এফবিসিসিআই, মহান মুক্তিযুদ্ধে ২ ও ৩ নং সেক্টরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নদী-রক্ষা

৩০ জানুয়ারি, ২০২১
আরও পড়ুন