Inqilab Logo

শক্রবার ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ কার্তিক ১৪৩১, ০৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নারী নির্যাতন প্রতিরোধে ধর্মীয় অনুশাসন ও আইন

মো. সাইফুদ্দীন খালেদ | প্রকাশের সময় : ২৮ জানুয়ারি, ২০২১, ১২:০১ এএম

নারীরা প্রতিদিনই নির্যাতিত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে থাকছে না বয়স, স্থান, কাল, পাত্রের ভেদ। রাত-বিরাতে নয় শুধু, দিন-দুপুরে প্রকাশ্যে ধর্ষণের ঘটনাও ঘটছে। ঘরে-বাইরে, রাস্তাঘাটে, যানবাহনে, কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। শুধু ধর্ষণই নয়, রীতিমতো গণধর্ষণ হচ্ছে। অনেক সময় ধর্ষণ করার ঘটনা ধর্ষক বা তার সহযোগী মোবাইলে ভিডিও করে রাখে। পরবর্তীতে ইন্টারনেটে ছেড়ে দেওয়ার ভয়ভীতি দেখিয়ে পুনরায় ধর্ষণ কিংবা টাকা দাবি করে। সভ্য সমাজে এমনটা দেখা যায় না। প্রত্যেক নারী পুরুষের স্বাধীনভাবে চলা ফেরা করা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। নারীর সেই মুক্তি, নারীর মর্যাদা, নারীর অধিকার, নারী শিক্ষার কথা বলেছে ইসলাম আজ থেকে বহু বছর বছর আগে। কিন্তু বিশ্ববাসী তা শুনতে পেয়েছে কি? শুনলেও নজর দেয়ার সময় পায়নি। এমনকি সমাজেও বিষয়টা হৃদয় দিয়ে অনুধাবন করেনি। আধুনিক সমাজে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেরই মৌলিক অধিকার সমান ও অভিন্ন। একুশ শতকে পদার্পন করে বর্তমান বিশ্ব যে সমাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক পালাবদলে অংশ নিচ্ছে নারী সেখানে এক অপরিহার্য অংশীদার, জীবনযুদ্ধেও অন্যতম শরীক ও সাথী। আর নারীকে মুক্তি দেওয়ার জন্য, নারীর উন্নয়নের জন্যে, এক কথায় নারীর ক্ষমতায়নের জন্যে দরকার সব ধরনের প্রতিবন্ধকতার অবসান। প্রয়োজন শিক্ষার প্রসার ও সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি। বর্তমান সভ্য সমাজে শিক্ষা ছাড়া সবই অচল। তাছাড়া কোনো স্বাধীন জাতির পক্ষে নিরক্ষর ও মূর্খ থাকা এবং বিশ্বজগৎ, জীবন ও পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে অজ্ঞান থাকা জাতীয় মর্যাদার পক্ষে হানিকর। যদিওবা দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতীয় জীবনে নতুন উদ্দীপনার সৃষ্টি হয় এবং সমাজে নারী পুরুষের সমান মৌলিক অধিকার স্বীকৃতি পায়।

মানবাধিকার ও অগ্রগতির এই একুশ শতকে সামাজিক কুসংস্কার কাটিয়ে নারীরা এগিয়ে আসছিল মানুষের ভূমিকায়, আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে। কিন্তু তাদের অগ্রযাত্রায় যৌন নির্যাতন, ইভটিজিং কিংবা ধর্ষণ বিশাল প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে যা নারী শিক্ষা ও তাদের জীবন যাত্রায় প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। নারী নির্যাতন কিংবা ধর্ষণের সংখ্যা দ্রুত হারে যেন বেড়ে যাচ্ছে। ঘরের বাইরে নারীদের নিরাপত্তাহীন অবস্থায় থাকতে হচ্ছে। মাঝে মধ্যে খবরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়নের মত ঘটনাও আসে। পবিত্র শিক্ষাঙ্গনকে অপবিত্র করতে চাচ্ছে এক শ্রেণীর নিপীড়ক, কিছু কুচক্রিলোক। আমাদের দেশে আইন আছে, শাস্তির ব্যবস্থা আছে। তবু এ ধরণের অপরাধ কেন বৃদ্ধি পাচ্ছে? আমাদের দেশের মতো দেশের বেকারত্ব, হতাশা, উপযুক্ত বিনোদনের অভাব, নৈতিক অবক্ষয়, পারিবারিক শিক্ষার অভাব, আইনের সঠিক প্রয়োগ না করা, সর্বোপরি প্রত্যেক ধর্মের নিজ নিজ ধর্মীয় অনুশাসনগুলো সঠিকভাবে পালন না করার জন্য এ ধরণের অপরাধ ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে যাচ্ছে। যথার্থ উদ্দেশ্য থেকে মানবমন বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে অবক্ষয়ের সৃষ্টি হচ্ছে। এ ব্যাপারে সচেতন হওয়া দরকার।

দেশীয় ও আন্তর্জাতিক যে কোন আইনে নারীর ওপর অত্যাচারের বিচার করা সরকারের দায়িত্ব। সিডো সনদের ১ অনুচ্ছেদের ৬ ধারায় বলা হয়েছে, ‘শরিক রাষ্টগুলো নারীকে সব ধরণের অবৈধ ব্যবসায় এবং দেহ ব্যবসায়ের আকারে নারীর শোষণ দমন করার লক্ষে আইন প্রণয়নসহ সব উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে’। দেশীয় আইনেও এমন অনৈতিক কাজের বিচারের ব্যবস্থা রয়েছে। বাংলাদেশ সংবিধানের ১৮(২) ও ৩৪(১) অনুযায়ী গণিকাবৃত্তি ও জুয়াখেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা নেবে এবং সব ধরনের জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধ ও আইনত দন্ডনীয়। ইভটিজিং দন্ডবিধি ১৮৬০ এর ৫০৯ ধারায় দন্ডনীয় অপরাধ এবং দন্ডবিধির ৩৭৫ ধারায় ধর্ষণের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধনী ২০০৩) এ শাস্তির বিধান রয়েছে। এ আইনের ১০ ধারায় যৌনপীড়ন এর শাস্তি হিসেবে অনধিক ১০ বছর কিন্তু অন্যূন ৩ বছর সশ্রম কারাদন্ডের বিধান রয়েছে এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থ দন্ডও রয়েছে। আর যদি নারীর শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে বা অশোভন অঙ্গভঙ্গি করে তাহলে অনধিক ৭ বছর অন্যূন ২ বছর সশ্রম কারাদন্ড এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদন্ড। সম্প্রতি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে সংশোধন আনা হয়েছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৩(১) এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ প্রণয়ন ও জারি করেন। এ অধ্যাদেশ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২০ নামে অভিহিত হয়।

ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি বাড়িয়ে মৃত্যুদন্ডের বিধান রেখে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের খসড়া মন্ত্রিসভায় চূড়ান্ত অনুমোদন পেয়েছে, তা রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের পর অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হয়েছে। ধারা ৯(১)এ যাবজ্জীবন শাস্তির পরিবর্তে করা হচ্ছে ‘যাবজ্জীবন অথবা মৃত্যুদন্ড’। আইনে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড রাখার পাশাপাশি আরও সংশোধনী আনা হয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো যৌতুকের ঘটনায় মারধরের ক্ষেত্রে (ধারা ১১-এর গ) সাধারণ জখম হলে তা আপসযোগ্য হবে। এ ছাড়া এই আইনের চিলড্রেন অ্যাক্ট-১৯৭৪-এর (ধারা ২০-এর ৭) পরিবর্তে শিশু আইন ২০১৩ প্রতিস্থাপিত হবে। অধ্যাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ৮নং আইনের ধারা ৭, ধারা ৯ এর উপধারা (১), (৪), ১৯ এর উপধারা (১), ধারা ২০ ও ধারা ৩২ এ সংশোধনী আনা হয়েছে।

আমরা মনে করি, প্রথমে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে হবে। আর সবচেয়ে যে দিকটা আমাদের বর্জন করা উচিত তা হলো, বিদেশি সংস্কৃতি, যাতে মেয়েদের উত্যক্ত করার মতো অনেক উপাদান আমাদের চোখে পড়ে। এ সব বর্জন করা উচিত। আমাদের দেশে আগত বিদেশি সংস্কৃতিনিয়ন্ত্রণ করতে হবে সমাজের সচেতন মানুষকে এবং সরকারকে। বিদেশী সংস্কৃতির যে অংশটুকু ইতিবাচক তাই আমাদের গ্রহণ করতে হবে। নেতিবাচক অংশটুকু বর্জন করা আবশ্যক। শাসনব্যবস্থাকে আরো শক্তিশালী করে তুলতে হবে। কেননা, দুর্বল শাসনব্যবস্থা দেশের পরিবেশ কলুষিত করে। মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে। স্কুল, কলেজ, ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা আবশ্যক। সৎ, আদর্শ ও ন্যায়পরায়ণ মানুষে সমাজ পরিপূর্ণ করে তুলতে পারলেই জাতির প্রকৃত উন্নতি ঘটবে, এই ব্যাপারে সকলকে সচেতন হতে হবে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সঠিক ও যথাযথভাবে প্রয়োগ নিশ্চিত এবং বিচার দ্রুত সম্পন্ন করতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। শাস্তির বিষয়গুলোও প্রচার করা দরকার গণমাধ্যমে যাতে কেউ এই ধরনের হীন কাজ করার সাহস না দেখায়।
লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।



 

Show all comments
  • Jack+Ali ২৮ জানুয়ারি, ২০২১, ১১:৫২ এএম says : 0
    Only Qur'an is the answer for all the problem we are facing on a daily basis. Qur'aan teaches us absolute morality.. without morality a human become Dumb, Deft and Blind as such he become worse than lowly animal pig, pig also worship Allah 100%.
    Total Reply(0) Reply
  • Jack+Ali ২৮ জানুয়ারি, ২০২১, ১২:১৯ পিএম says : 0
    Our Beloved Prophet [SAW] mentioned that when 5 bad things happened to my Ummah before Qiyamah: 1. Sexual obscenity will become wide spread from among Muslim. They publicize Zina [Illegal sexual intercourse]. New terminal illness will become wide spread with in the Ummah. 2. Muslim will cheat in their business. Poverty will be pandemic and Dictators and oppressors will rule Ummah. They will use their religion for worldly gain. 3. Muslim will stop paying Zakat. 4. Muslim will betray their promise and loyalty to Allah [SWT] and enemy of Islam will control the money of Muslim. 5. So called Muslim Leader will not apply the Laws of Allah’s Book, except which suits them. O’Misguided Muslim turn back to Allah before it’s too late.
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ধর্মীয়-অনুশাসন-আইন
আরও পড়ুন