পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
করোনাকারণে দেশের সব খাতেই ধস নেমেছে। ব্যতিক্রম একমাত্র কৃষি। কৃষিতে করোনা কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলতে পারে নি। উপরন্তু তা চাঙ্গা হয়েছে। উৎপাদন বেড়েছে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি। বন্যায় ধানের প্রার্থিত উৎপাদন কিছুটা কম হলেও অন্যান্য ফসলের উৎপাদন অনেক বেড়েছে। করোনায় উন্নত দেশের অর্থনীতিও যেখানে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশের অর্থনীতির তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। শিল্পকারখানা বন্ধ হয়েছে। অনেক শ্রমিক বা কর্মী কাজ হারিয়েছে। গার্মেন্ট, বস্ত্র, চামড়া ইত্যাদি শিল্পে উৎপাদন কমেছে। রফতানিও কমেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও দোকান-পাট বন্ধ থাকায় বহুলোক নানারকম সমস্যায় পড়েছে। কিন্তু এসব ক্ষতি বা সমস্যা সামগ্রিকভাবে মানুষের জীবনযাপনে যতটা প্রভাব ফেলার কথা ছিল, ততটা ফেলেনি। কারণ, কৃষি। কৃষিখাত সচল থাকায় খাদ্য উৎপাদন যেমন স্বাভাবিক থেকেছে, তেমনি এ খাতে বহু লোকের কর্মসংস্থানও হয়েছে। শহর ও বিদেশ থেকে বেকার লোকজন গ্রামে এসে কৃষিতে নিজেদের নিয়োজিত করেছে। কেউ মাছ চাষে হাত লাগিয়েছে। কেউ শাক-সবজি, তরিতরকারির আবাদে মেতেছে। কেউ হাঁস-মুরগীর খামার করেছে। কেউ গবাদি পশু পালনে নেমেছে। কেউবা ফল চাষে মনোনিবেশ করেছে। গ্রামের বেকার তরুণরাও এসব কাজে নিজেদের ব্যস্ত রেখেছে। অবশ্যই তারা সবাই লাভবান হয়েছে। আর দেশ লাভ করেছে বাড়তি উৎপাদন।
কৃষিই যে দেশের ও দেশের অর্থনীতির, প্রাণ, সেটা করোনাকালে আবারো প্রমাণিত হয়েছে। কৃষিই একমাত্র খাত, যার ধারাবাহিক উন্নতির রেকর্ড রয়েছে। ফলে দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। মাছ, গোশত, ডিম, দুধ, শাক-সবজি, তরিতরকারি, ফল-ফুল উৎপাদনেও ব্যাপক সাফল্য এসেছে। দুর্মূল্য বিদেশি ফল, যা এক সময় আমদানি করতে হতো, এখন অনেকটাই দেশে উৎপাদিত হচ্ছে। এসব ফল চাষের বিপুল সম্ভাবনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, ভবিষ্যতে ফল আমদানির প্রয়োজন হবে না। এমন কি, আমরা দেশী-বিদেশী ফল রফতানি করতে পারবো। করোনাকালে একটা বিশেষ প্রবণতা এই লক্ষ্য করা গেছে যে, কৃষি কাজকে একদা যারা গুরুত্ব ও মূল্য দিতো না, হেলা ও হেয় করতো, তারা এবং বিশেষ করে শিক্ষিত লোকেরা কৃষিকে গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানজনক কাজ হিসাবেই দেখতে শুরু করেছে। শিক্ষিত যুবক, বিদেশী ডিগ্রীধারী পর্যন্ত, কৃষির বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজেদের সম্পৃক্ত করে কৃষির প্রতি তাদের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির প্রমাণ দিয়েছে। ব্যাপক সাফল্যও দেখিয়েছে। এটি শুভ লক্ষণ। কথায় বলে, একজন শিক্ষিত কর্মীর উৎপাদনশীলতা কয়েকজন অশিক্ষিত কর্মীর সমান। শিক্ষিতরা যখন ব্যাপক সংখ্যায় কৃষিতে সংযুক্ত হবে, তখন উৎপাদন এখনকার চেয়ে আরো বেশি হবে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। দেশ খাদ্য রফতানিকারক দেশে পরিণত হবে। বাংলাদেশের মাটি আল্লাহপাকের একটা বিশেষ নিয়ামত। বিশ্বে এমন কোনো ফল-ফসল নেই, যা এখানে উৎপাদিত না হয়। ধান উৎপাদন তো বলাই বাহুল্য। ফলন প্রায় অন্যান্য দেশের মত। সেরা পাট উৎপাদনে শীর্ষে। উৎপাদিত তুলা মিসরের তুলার সমান। গম-ভুট্টা উৎপাদনে এদেশের মাটি সর্বোৎকৃষ্ট বলে প্রমাণিত। সয়াবিনের উৎপাদন ও মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ের। সমতল ভূমিতে চা চাষে রীতিমত বিপ্লব ঘটেছে। খাদ্য শুধুই খাদ্যশস্য নয়, মাছ, গোশত, ডিম, দুধ, ডাল, ফল-ফলাদী, শাক-সবজি তরিতরকারি ইত্যাদিও খাদ্যের অংশ। আর এই সবকিছু মিলেই কৃষি বা কৃষিখাত। কৃষি আমাদের সবচেয়ে বড় খাত। জিডিপিতে এখাতের অবস্থান তৃতীয় হলেও কর্মসংস্থানে ৫০ শতাংশের বেশি। কৃষিতে সাফল্যের মূলে আছে, দেশের পরিশ্রমী কৃষক। সরকারের ভূমিকা সহযোগীর। সরকার বীজ, সার, সেচ, বিদ্যুৎ, কীটনাশক এবং কৃষিযন্ত্রপাতির যোগান দিয়ে থাকে। কৃষি এখন সব দেশেই যন্ত্রনির্ভর। বাংলাদেশও কৃষিযন্ত্রপাতির ব্যবহার ক্রমাগত বাড়ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কৃষির পুরোটা যান্ত্রিকীকরণ হলে এখনকার চেয়ে উৎপাদন কয়েকগুণ বেশি হবে। সরকার কৃষির যান্ত্রিকীকরণে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে।
কৃষির উন্নতি-সমৃদ্ধির ওপর দেশের উন্নতি-সমৃদ্ধি নির্ভরশীল। কৃষির রয়েছে অপার সম্ভাবনা। এ সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে জাতীয় উন্নয়ন ও বিকাশ তরান্বিত করতে হলে একে প্রতিযোগিতা সক্ষম করে তুলতে হবে। বিশ্বের অন্যান্য কৃষিপ্রধান দেশের সঙ্গে পণ্যমূল্যের ক্ষেত্রে সফলভাবে প্রতিযোগিতা করতে হবে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকাই হলো প্রতিযোগিতা সক্ষমতা অর্জন। আমরা প্রতিযোগিতা সক্ষমতার দিক থেকে অনেকেরই পেছনে আছি। যেমন, ভারতে ধানের উৎপাদন খরচ যত, বাংলাদেশে তার চেয়ে বেশি। ফলে, চালের দামও এখানে ভারতের চেয়ে বেশি। প্রতিযোগিতাসক্ষমতা অর্জন এ জন্য প্রয়োজন যে, এর ফলে প্রতিযোগিতামূলক দামে ক্রেতা-ভোক্তার কাছে কাঙ্খিত পণ্য পৌঁছে দেয়া সম্ভব হয়। একে উৎপাদকের ক্ষতি নেই; কিন্তু ক্রেতার বিস্তর লাভ। আমাদের দেশে কৃষিপণ্যের উৎপাদন ব্যয়ে অন্যান্য দেশের চেয়ে বেশি। এখনো পুরোটা যান্ত্রিককৃষি হয়ে না ওঠা, তদুপরি কৃষি উপকরণের উচ্চমূল্য, ঋণের উচ্চসুদ, কৃষি শ্রমিকের উচ্চ-পারিশ্রমিক ইত্যাদি উৎপাদনব্যয় বাড়িয়ে দেয়। উৎপাদনব্যয় বেশি হওয়ার কারণে প্রায়ই কৃষক পণ্যের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়। এটা একটা বড় সমস্যা। এ সমস্যা কৃষককে পণ্যউৎপাদনে অনুৎসাহী করে তোলে। ফসল ফেলে দেয়া বা পুড়িয়ে ফেলার ঘটনা অতীতে ঘটতে দেখা গেছে। অন্যদিকে এও দেখা গেছে, দালাল, ফড়িয়া, মজুদদার ও সিন্ডিকেটবাজরা মাঝখান থেকে লাভবান হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উৎপাদক ও ভোক্তা। এই মধ্যসত্ত্বভোগীদের বিদায় করতে হবে। সরকারকেই সে দায়িত্ব নিতে হবে। কৃষিবিকাশ তখনই পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করবে, যখন কৃষক ন্যায্যমূল্য পাবে এবং ভোক্তা ন্যায়সঙ্গত মূল্যে পণ্য কিনতে পারবে। কৃষিতে যে নতুন প্রাণাবেগ সঞ্চায়িত হয়েছে তা ধরে রাখতে হবে, জোরদার করতে হবে। আর সেটা করতে হলে পণ্যের মূল্য কৃষক ও ভোক্তার কাছে গ্রহণযোগ্য করতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।