পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বিদায় ২০২০। স্বাগত ২০২১। ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ আর টুইটারে হ্যাপি নিউ ইয়ার-শুভ নববর্ষ মেসেজসহ মন ছুঁয়ে যাওয়া নানারকম বার্তার ছড়াছড়ি। ‘পুরনো কষ্ট, করে ফেলো নষ্ট। নববর্ষের আনন্দ, মনে জাগুক বসন্ত। স্বপ্ন হোক জীবন্ত, ২০২১ এর আনন্দ হোক অফুরন্ত। আমি আছি বহুদূর, তোমার জীবন থাকুক আনন্দে ভরপুর। ’২১ এর সকালের আলো, বাঙালির জন্য হোক ভালো। মিটে যাক পঙ্কিলতা, ধুয়ে যাক সব মলিনতা। ফুল ফুটুক বসন্তের, শুভ হোক সকলের! হ্যাপি নিউ ইয়ার ২০২১! May this new bring you much joy and fun. May you find peace, love and success. Happy new year 2021! ইত্যাদি নতুন বছরের শুভেচ্ছা ভার্চুয়াল মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ল প্রান্ত থেকে প্রান্তরে আর দেশ থেকে দেশান্তরে। এতসব আয়োজনের মধ্যেই নতুন ৬ হাজার ৭০ জন আগন্তুকের আগমন ঘটল বাংলাদেশে। আগের দিন জিরো আওয়ার থেকে পরেরদিন জিরো আওয়ার পর্যন্ত অর্থাৎ ৩০ ডিসেম্বর রাত ১২টা থেকে ৩১ ডিসেম্বর রাত ১২টা-এ ২৪ ঘণ্টায় বাংলাদেশের জনগণের সাথে যুক্ত হলো ৬ হাজার ৭০ জন নতুন শিশু। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রতি ২৪ ঘণ্টায় ৬ হাজার ৭০ জন শিশু জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু এ নতুন শিশুদের জন্য রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে কোন বাজেট বরাদ্দ থাকে না। প্রতিবছরই নতুন বর্ষবরণে বিদায়ী বছরের গ্লানিকে ধুয়েমুছে সোনালি রবির সকালের প্রত্যাশা কামনা করে অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে থার্টি ফার্স্ট নাইট পালিত হয়ে থাকে।
বছর যায়, বছর আসে কিন্তু এই শিশুদের জন্য কোন সোনালি সকাল আসে না। সমাজ ও রাষ্ট্রকে তাদের জন্য বাস্তবধর্মী ও কার্যকর কোন পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। তাদের জন্য কোন রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক বরাদ্দ আজও পর্যন্ত লিপিবদ্ধ হয়নি। শিক্ষা, খাদ্য, চিকিৎসা, বাসস্থান, বস্ত্র ইত্যাদি মৌলিক চাহিদা ও অধিকারগুলো উন্নত রাষ্ট্রে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে শিশুরা পূর্ণমাত্রায় ভোগ করতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে শিশুরা এসব চাহিদা ও অধিকার থেকে সম্পূর্ণভাবে বঞ্চিত। উইকিপিডিয়ার ভাষ্যমতে, বাংলাদেশে বর্তমানে মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৪৬ লাখ। তন্মধ্যে তরুণ-তরুণীর সংখ্যা প্রায় ৮ কোটি এবং এদের প্রত্যেকের বয়স ২৪ বছরের নিচে। আর মোট জনসংখ্যার ৪৫ ভাগ তথা প্রায় ৭ কোটি শিশু এবং তাদের সকলের বয়স ১৮ বছরের নিচে। লোকাল এডুকেশন এন্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্টের হিসেব মতে, বাংলাদেশে প্রায় ২০ থেকে ২৫ লাখ শিশু আছে যাদের পথশিশু বলা হয়। এসব শিশু অভাবের তাড়নায় এবং ভেঙ্গে যাওয়া পরিবার থেকে বেরিয়ে আসা। এছাড়া নদীভাঙ্গনের কারণে গৃহহীন হয়ে চলে আসা অনেক শিশুদের ঠিকানা হচ্ছে পথ। ওদের কোন বাড়িঘর নেই। নির্দিষ্ট জায়গা জমি নেই। এরা রাত কাটায় বাস স্টেশন, রেল স্টেশন অথবা পার্ক, রাস্তা কিংবা খোলা জায়গায়। এরা পথেই থাকে। পথেই জীবিকা নির্বাহ করে। এদের সকলের বয়স ৫ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। এদের মধ্যে অনেকে বিনা চিকিৎসায় রাস্তায় পড়ে মারা যায়। কেউ মাদকাসক্ত হয়ে মারা যায়। কেউ পাচার চক্রের মাধ্যমে বিদেশে পাচার হয়ে যায়। কারো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে নেয়া হয় এবং সেটা দুষ্টচক্র বিক্রি করে টাকা উপার্জন করে। মেয়ে শিশুরা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। কখনো কখনো যৌনকর্মী হতে বাধ্য করা হয়। এভাবে তাদের নানা নির্যাতনের শিকার হতে হয়।
সোশাল এন্ড ইকনোমিক অ্যানহ্যান্সমেন্টের তথ্যমতে, এই পথ শিশুদের শতকরা ৪৫ ভাগ মাদকাসক্ত, ৪১ ভাগ শিশুর ঘুমানোর কোনো বিছানা নেই, ৪০ শতাংশ শিশুর গোসলের ব্যবস্থা নাই। যে কারণে তারা গোসল করতে পারে না। ৪৫ শতাংশ শিশুর টয়লেট ব্যবস্থা নেই। তাই তারা খোলা জায়গায় মলত্যাগ করে। প্রায় ৫৫ শতাংশ শিশু অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকলেও তাদের দেখার কেউ নেই। আর ৭৫ শতাংশ শিশু অসুস্থ হলে ডাক্তারের সাথে কোন ধরনের যোগাযোগই করতে পারে না। ৫১ ভাগ শিশু অশ্লীল বাক্যবানের শিকার হয়। ৪৬ ভাগ মেয়ে শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। ১৯ শতাংশ শিশু হিরোইন আসক্ত। ৪০ শতাংশ ধূমপায়ী। ২৮ শতাংশ শিশু ট্যাবলেটে আসক্ত এবং ৮ শতাংশ শিশু ইনজেকশন আসক্ত। এই যখন অবস্থা ঠিক তখন এ বছর বাংলাদেশ উদযাপন করবে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী, যেখানে উপস্থিত থাকবেন বিশ্ব নেতাদের কেউ কেউ। প্রথমেই এসব পথশিশুর সাক্ষাৎ মিলবে বিমানবন্দরে। হোটেল শেরাটনে শিশু অধিকার বিষয়ক আলোচনা চলবে। আর এসব শিশু আমন্ত্রিত অতিথিদের কাছে ভিক্ষার হাত বাড়িয়ে দিবে। দেশের সম্মানের সাথে এটা বড়ই অসম্মানের, অপমানের আর লজ্জার।
বাংলাদেশের বর্তমান লক্ষ্য মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে নিজেকে প্রতিিিষ্টত করা এবং ধাপে ধাপে উন্নত রাষ্ট্রে উন্নীত করা। তবে নতুনদের পর্যবেক্ষণ হল, দেশের প্রাণশক্তি হচ্ছে এই অবহেলিত তরুণ ও নতুন শিশু। এশক্তিই দেশের ভবিষ্যৎ। সুতরাং এ শক্তিকে অবহেলিত আর বঞ্চিত রেখে কোনভাবেই দেশকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করা সম্ভব নয়। এ অবস্থা চলমান থাকা অবস্থায় যদি বাংলাদেশ কখনও উন্নত রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পায়ও; তবে সেটা হবে এ নতুনদের সাথে প্রহসন। তাই নতুন বছরে নতুনদের চাওয়া হলো, রাষ্ট্র তাদের জন্য তাদের মৌলিক চাহিদা ও অধিকারগুলো সাংবিধানিকভাবে লিপিবদ্ধ করুক, তা বাস্তবায়ন করুক এবং ক্রমান্বয়ে তাদের পুনর্বাসন করুক! এ বিশাল জনশক্তিকে যদি জনসম্পদে পরিণত না করা হয় তাহলে এটা উন্নত রাষ্ট্র ব্যবস্থার বড় অন্তরায় হিসেবে দেখা দেবে।
১৭ মার্চ ২০২০ থেকে অদ্যাবধি বাংলাদেশের স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। বন্ধের এ দীর্ঘসূত্রিতা প্রলম্বিত হবে নিশ্চিত করে বলা যায়। আর এর মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এ শিশুরা। এতে তাদের শিক্ষাজীবন এক অনিশ্চিত গন্তব্যের পথে ধাবিত হচ্ছে। ২০২০ চলে গেছে।
করোনার বিষ চলে যাবার সাথে সাথেই স্কুল, মাদ্রাসা, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয়ে উঠবে তরুণ-তরুণীদের মিলন মেলা। কোলাহলপূর্ণ উচ্ছ¡াসে মেতে উঠবে এসব নতুন, তরুণ-তরুণী আর কিশোর কিশোরীরা। তবে এ উচ্ছ¡াস মোটেই দীর্ঘ হবে না। কারণ করোনার বিষে জীবন থেকে চলে গেছে অনেক মূল্যবান সময়। সুতরাং উচ্ছ¡াসের সময় কই? তাই শুরু হবে আবার সেই তোতাপাখির মতো মুখস্তকরনের সীমাহীন অসুস্থ প্রতিযোগিতা। গলধঃকরণ করতে হবে অসংখ্য উত্তরমালা। নোট আর কোচিংয়ের চাপে নতুনেরা হয়ে পড়বে আবার দিশেহারা। পড়তে যেতে হবে ব্যাচে। কারণ শ্রেণিতে হতে হবে প্রথম। পেতে হবে গোল্ডেন এ প্লাস। ডাক্তার হবার চাপ, ইঞ্জিনিয়ার হবার চাপ কিংবা বিসিএস ক্যাডার হওয়ার চাপ। এছাড়া আরো কত যে অসুস্থ প্রতিযোগিতার চাপ মাথায় নিয়ে নতুন, তরুণ-তরুণী আর কিশোর-কিশোরীরা আবার মত্ত হবে নিরানন্দময় পাঠে! আনন্দের জন্য পড়া, দেশকে ভালোবাসার জন্য পড়া, ভালোলাগার জন্য পড়া, জ্ঞান অর্জনের জন্য পড়া, নৈতিক মানুষ হওয়ার জন্য পড়া ইত্যাদিতো দেশ থেকে অনেক আগেই হারিয়ে গেছে। অথচ নতুন প্রজন্ম পড়তে চায় আনন্দের জন্য। পড়তে চায় ভালোলাগার জন্য, শেখার জন্য, পড়তে চায় জানার জন্য। কিন্তু দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় এসুযোগ এখন একেবারেই নেই।
নতুন শিশুরা এখন তোতাপাখিতে পরিণত হয়েছে। বাজারের চাহিদা অনুযায়ী তারা দক্ষ কর্মী হিসেবে গড়ে উঠছে না। যা উন্নত রাষ্ট্রগঠনে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। যদ্দরুন দেশে বিপুল জনশক্তি থাকার পরও বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন করতে বিদেশ থেকে শ্রমিক আমদানি করতে হচ্ছে। দেশের এই বিপুল এবং ব্যাপক জনশক্তি নৈতিক, গবেষক, আবিষ্কারক, সৃজনশীল, মননশীল ইত্যাদি তেরি না হয়ে, তৈরি হচ্ছে স্বার্থপর, টাকা উপার্জনকারী, লোভী, ব্যক্তিত্বহীন, তোষামোদকারী আর দলবাজ নিষ্ঠুর অমানুষ। দেশে মেধার পরিচর্যা নাই, স্বীকৃতি নাই, কর্মসংস্থান নাই। আর এ কারণে দেশ থেকে মেধা পাচার হয়ে যাচ্ছে। দেশ হয়ে পড়ছে মেধাশূন্য। উন্নত বিশ্বে প্রাথমিকের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকগণ শিশুদের নিবিড় পরিচর্যা আর প্রশিক্ষণ প্রদাানের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত দেন যে, শিশুরা ভবিষ্যতে কে কী হবে-ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, গবেষক, লেখক, সাংবাদিক, প্রশাসক নাকি অন্য কোন কিছু। আর আমাদের দেশে সেই সিদ্ধান্ত দেন আমাদের অনভিজ্ঞ এবং ক্ষেত্রবিশেষে অশিক্ষিত অভিভাবকরাই। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে। দেশের উন্নতি অগ্রগতিতে তাদের যে ভূমিকা রাখার কথা ছিল তার সবকিছুই ভেস্তে যাচ্ছে। নতুনদের এই ভাবনাগুলো কর্তৃপক্ষের কর্ণকুহরে হয়তো প্রবেশ করবে না। কারণ তাদের ছেলেমেয়েরা এদেশে পড়ে না। তারা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের মালিক। কোটি কোটি টাকা খরচ করে তারা পড়াশোনা করছে উন্নত দেশে। গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আর অবদান রাখছে তারা সে সমস্ত দেশ গড়তে। সুতরাং তারা এদেশের উন্নতি অগ্রগতি নিয়ে কেনইবা আর ভাববে? তবে সত্যিকারের দেশপ্রেমিক এ নতুন আর কিশোররাই এদেশকে প্রকৃত অর্থে ভালোবাসে। তারা এদেশের মাটি, পানি, বাতাস ও মানুষকে আপন জানে ও আপন ভাবে। এখানেই তারা বাস করতে চায় স্থায়ীভাবে। এ দেশটাকে গড়তে চায় তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর ধর্মীয় মূল্যবোধকে সাথে নিয়ে। কিন্তু নতুন এ তরুণ-তরুণীরা বর্ণিত অসঙ্গতিগুলোকে উন্নত রাষ্ট্র ব্যবস্থার বড় অন্তরায় হিসেবে মনে করে। তাই দেশটাকে উন্নত রাষ্ট্রে পৌঁছতে নতুনরা কী ভাবছে, কীভাবে ভাবছে তা বিবেচনায় নিতে হবে।
লেখক: অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।