Inqilab Logo

বুধবার ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ওয়াজে বিতর্কিত বক্তব্যের যে ব্যাখ্যা মুফতি কাজী ইব্রাহিমের

মাহফিল ইস্যুতে নির্দেশনা চেয়ে সরকারকে লিগ্যাল নোটিশ

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২২ জানুয়ারি, ২০২১, ১২:২৫ এএম

ওয়াজ মাহফিলে কোরান-হাদিসের বাইরে যেন বক্তব্য দেয়া না হয়, সরকারের কাছে সেই নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে লিগ্যাল নোটিশে। বাংলাদেশে ওয়াজ বা ধর্মীয় সমাবেশে কোরান এবং বিশুদ্ধ হাদিসের রেফারেন্স বাধ্যতামূলক করে বক্তব্য প্রদানের নির্দেশনা চেয়ে সরকারকে লিগ্যাল নোটিশ দিয়েছেন সুপ্রিমকোর্টের একজন আইনজীবী। তিনি বলেছেন, ওয়াজ মাহফিলে কিছু বক্তা রাষ্ট্রবিরোধী, উস্কানিমূলক এবং নানা ধরনের কাল্পনিক বক্তব্য দিয়ে সমাজে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেন।তবে ধর্মীয় বক্তাদের বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা বলেছেন, কোরান হাদিসের বাইরে ভিন্ন ধরনের বক্তব্য দেয়ার দু’একটি ঘটনা ঘটতে পারে। সেগুলোকে তারা বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসাবে দেখেন। ধর্ম প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, ওয়াজ মাহফিলে উস্তকানিমূলক বা কাল্পনিক বক্তব্য যেন দেয়া না হয়, সে ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে আগেই সতর্ক করা হয়েছে।

সমালোচিতদের একজন মুফতি ইব্রাহিম : সা¤প্রতিক সময়ে ওয়াজ মাহফিলে নানা ধরনের বক্তব্য দিয়ে অনেকে আলোচিত-সমালোচিত হয়েছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম একজন মুফতি কাজী ইব্রাহিম। তার বক্তব্যের অনেক ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে অনেক। তিনি করোনাভাইরাসের টিকা আবিষ্কারের সূত্র দেয়া থেকে শুরু করে বিজ্ঞানসহ নানা বিষয়ে ওয়াজ করেছেন। এই ধর্মীয় বক্তা এমন বক্তব্যও দিয়েছেন যে, ‘করোনাভাইরাসের টিকা দেয়ার কারণে নারীর দাঁড়ি গজাচ্ছে, পুরুষের কণ্ঠ পাল্টে নারীকন্ঠ হচ্ছে’।

তবে মুফতি কাজী ইব্রাহিম বিবিসির সাথে আলাপকালে তার বক্তব্যের সমর্থনের নানা যুক্তি দিয়েছেন। ‘সম্ভবত ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট সাহেব এটা বলেছেন যে টিকা দেয়ায় নারীর দাড়ি গজাচ্ছে এবং পুরুষের কণ্ঠ পাল্টে যাচ্ছে। মিডিয়ায় এই তথ্য এসেছে। আমি কথা কিন্তু গভীর থেকে বলি। ভ্যাকসিন নিয়েও বিতর্ক আছে’ বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি তার বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্যও টেনে এনেছেন।

‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও কিন্তু করোনাভাইরাস নিয়া, মাস্ক নিয়া বা বিভিন্ন বিষয় নিয়া অনেক কথা বলেছেন। এগুলোতো ভাইরাল হয় এবং মিডিয়া থেকে সাধারণত আমরা তথ্য কালেক্ট (সংগ্রহ) করি’ তিনি বলেন।
মুফতি কাজী ইব্রাহিম এক বক্তৃতায় করোনাভাইরাসের টিকা আবিষ্কারের গাণিতিক ‘সূত্র’ও দিয়েছিলেন। সেটি হচ্ছে ১.য়৭+৬=১৩ । তার এমন বক্তব্য নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে বহু হাস্যরস হয়েছে। এ ধরনের বক্তব্যের ভিত্তি সম্পর্কে জানতে চাইলে মুফতি ইব্রাহিম এই সূত্রের বিষয়ে একজন প্রবাসীর স্বপ্ন দেখার কথা তুলে ধরেন।

“ইতালি প্রবাসী একজন বাংলা ভাষী তার একটা স্বপ্ন আমাকে বলেছে। স্বপ্নে সে এটা দেখেছে’।
ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী স্বপ্নের কী ব্যাখ্যা আছে-তাও তিনি বিস্তারিত বলেন। ‘স্বপ্ন ইসলামে তিন প্রকারের হয়। একটা আল্লাহ’র পক্ষ থেকে হয়, এটা সত্য হয়। একটা শয়তানের পক্ষ থেকে হয়, এটা মিথ্যা হয়। আরেকটা নিজের জল্পনা কল্পনা থেকে হয়, এটাও মোটামুটি মিথ্যা হয়’।

স্বপ্ন নিয়ে ব্যাখ্যায় তিনি আরও বলেছেন, ‘যেহেতু আল্লাহ’র পক্ষ থেকে ইনফরমেশন হওয়ার একটা সম্ভাবনা অনেক সময় থাকে। এজন্য স্বপ্ন অনেক সময় সত্যও হয়। তাই একজনের স্বপ্নে দেখা ঐ সূত্র দিয়েছিলাম’। কিন্তু এ ধরনের বক্তব্যগুলো বিতর্ক বা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে কিনা-এমন প্রশ্নে মুফতি ইব্রাহিম বিতর্কের উৎস নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

‘দেখেন, বিতর্কের উৎসটা কী’? : তিনি নিজেই এর কারণ ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, কোন বিষয়ে জানার অভাব থেকে সেই বিষয় নিয়ে বিতর্ক করা হয়। ‘আপনি একটা কথা বললে সে সম্পর্কে যদি আমার জ্ঞান না থাকে, তাহলে আমি বলবো এটা কি বললো- আমাদের জানার অভাব থেকেই কিন্তু আমরা যে কোন কথাকে বিদ্রæপ করবো বা উড়িয়ে দেবো’ তিনি বলেন। তিনি আরও বলেছেন, ‘যখন জানবো যে একথা ভিত্তি আছে, তখন আর আমরা এসব করবো না’। তিনি বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীদের জীবনেও বিদ্রæপের মুখোমুখি হওয়ার বিষয়কে উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরেন।

‘বিজ্ঞানী গ্যালিলিওকেও তো অ্যারেস্ট করা হয়েছিল। ইউরোপের মধ্যযুগে বর্তমান বিজ্ঞানীদের পূর্বসূরীদের সবাই নির্যাতিত হয়েছে কমবেশি। তারা মার খেয়েছে, জেল জরিমানা হয়েছে। বিদ্রæপের দ্বারা তারা চরমভাবে জর্জরিত হয়েছে। কারণ তৎকালীন পৃথিবীর মানুষ তা জানতো না। আমার জ্ঞানহীনতার কারণে আমি বিদ্রæপ করতে পারি। কিন্তু এটাতো আমার দেখার বিষয় না’ বলে তিনি মন্তব্য করেন।

ধর্মীয় বক্তাদের অনেকে মাহফিলে কোরান হাদিসের বাইরে বক্তব্য দিচ্ছেন বলে যে অভিযোগ এখন জোরালোভাবে উঠছে, সে ব্যাপারে মুফতি কাজী ইব্রাহিম বলেছেন, কোরান হাদিসের রেফারেন্সের ভিত্তিতেই বক্তব্য দেয়া উচিত। এটা শতভাগ সত্য বলে তিনি মন্তব্য করেন।
একইসাথে তিনি বলেছেন, ‘বক্তারা ইচ্ছা করে কোরান হাদিসের বাইরে গিয়ে তথ্য দেন-বিষয়টা এমন নয়। এখন অনিচ্ছাকৃত কিছু ভুল মানুষ মাত্রই হয়’।

যে কারণে লিগ্যাল নোটিশ : ওয়াজ মাহফিলে কী ধরনের বক্তব্য আসছে, তা নিয়ে সামাজিক মাধ্যম এবং বিভিন্ন মহলের পাশাপাশি সরকারের ভিতরেও আলোচনা ছিল। এখন মাহফিলের বক্তব্য সরকারকে লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছেন সুপ্রিমকোর্টের একজন আইনজীবী মাহমুদুল হাসান। তিনি বলেছেন, মাহফিলে অনেক বক্তা কাল্পনিক বক্তব্য, গালগল্প এবং রাষ্ট্রদ্রোহ বক্তব্য দিচ্ছেন। অনেকে গানও করেছেন। যা সমাজে বিভ্রন্তি সৃষ্টি করছে বলে তিনি মনে করেন।

মি. হাসান বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ধরে মাহফিলের বক্তব্য দেয়ার ক্ষেত্রে কোরান হাদিসের রেফারেন্স বাধ্যতামূলক করে নির্দেশনা চেয়েছেন।
তিনি আরও বলেছেন, ‘এখন ওয়াজ মাহফিলের বক্তা ও আয়োজকদের পক্ষ থেকে বক্তব্যের ভিডিও ইউটিউব এবং ফেসবুক সহ সামাজিক মাধ্যমে আপলোড করা হচ্ছে এবং তা ছড়িয়ে যাচ্ছে। সে কারণে উস্কানিমূলক এবং কাল্পনিক বক্তব্যগুলো দৃশ্যমান হচ্ছে’ বলে তিনি উল্লেখ করেন।

সরকার কী বলছে? : ধর্মপ্রতিমন্ত্রী মো. ফরিদুল হক খান বলেছেন, লিগ্যাল নোটিশের বিষয়বস্ত আলোচনা করে তারা এর জবাব দেবেন। তবে তিনি বলেছেন, ওয়াজ মাহফিলে উস্কানিমূলক বা ভিন্ন ধরনের বক্তব্য যেন দেয়া না হয়, সে ব্যাপারে সরকার থেকে সংশ্লিষ্টদের অনেক আগেই বলা হয়েছে। ধর্মীয় বক্তারাও সতর্ক রয়েছেন বলে তিনি মনে করেন। ‘আমরা বলেছি, যাতে কেউ উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে কোন অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির সুযোগ না পায়’।

ওয়াজ মাহফিলে বক্তাদের একটি সংগঠনের মহাসচিব হাসান জামিল বলেছেন, দু’একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার কারণে ঢালাও অভিযোগ আনা ঠিক নয়। ‘আমরাও বলি রেফারেন্স ছাড়া কথা না বলা বা উদ্ভট কথাবার্তা না বলা। মূলধারার আলেমরা কখনও কোরান হাদিসের বাইরে কিছু বলেন না। বিচ্ছিন্ন দু’একটি ঘটনা দিয়ে সার্বিকভাবে দেখা ঠিক নয়’।

এদিকে এখন লিগ্যাল নোটিশের ব্যাপারে সরকারকে ৩০ দিনের মধ্যে জবাব দিতে হবে। আইনজীবী মাহমুদুল হাসান বলেছেন, তার লিগ্যাল নোটিশের ব্যাপারে ধর্ম মন্ত্রণালয় ৩০ দিনের মধ্যে জবাব না দিলে তারা আদালতের আশ্রয় নেবেন। সূত্র : বিবিসি বাংলা।



 

Show all comments
  • মু. ছফিউল্লাহ ২২ জানুয়ারি, ২০২১, ১:৫৬ এএম says : 0
    উদ্দেশ্য খারাপ, গভীর চক্রান্ত চলতেছে ওয়াজমাহফিল নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। তারই অংশ হিসেবে এই প্রদক্ষেপ
    Total Reply(0) Reply
  • মোঃ আকরাম হোসেন ২২ জানুয়ারি, ২০২১, ১:৫৬ এএম says : 0
    এটা শুধুমাত্র ওয়াজ মাহফিলের ক্ষেত্রে কেন প্রযোজ্য? রাজনৈতিক ব্যক্তিগণ তো প্রতিদিনই উল্টা - পাল্টা বক্তব্য দেয়
    Total Reply(0) Reply
  • রুহুল আমীন যাক্কার ২২ জানুয়ারি, ২০২১, ১:৫৯ এএম says : 0
    বাংলাদেশের সকল ধর্মপ্রাণ মানুষই চায় ক্বুরআন-হাদিসের রেফারেন্সে ওয়াজ হোক। তবে জেনে রাখা আবশ‍্যক যে, ইসলাম অন‍্যান‍্য ধর্মের মতো নিছক কিছু আরাধনার ধর্ম নয়। ইসলাম একটি সার্বজনীন জীবন ব‍্যবস্থার নাম। এই ধর্মের গ্রন্থসমূহে যেমন নামায-রোজার বিধান আছে তেমনি আছে রাষ্ট্র পরিচালনার বিধি-বিধানও। ব‍্যক্তি,পরিবার,সমাজ,লেনদেন,ব‍্যবসা-বাণিজ‍্য,অপরাধের দন্ডবিধি, রাজনীতি,সমরনীতি সবকিছুরই অমোঘ বিধান রয়েছে ইসলামে। এসব নিয়েই আলোচনা করেন হক্কানী ওয়াইজগণ। রীটকারী ভাইকে ধন‍্যবাদ। আমরাও চাই ক্বুরআন-হাদিসের সহি ওয়াজ।
    Total Reply(0) Reply
  • Moh'd Sanaullah Azad ২২ জানুয়ারি, ২০২১, ২:০১ এএম says : 0
    ‌কোন মাহ‌ফি‌লেই কোন উস্কা‌নিমুলক বক্তব্য দেয়া হয়না।বরং কুরআন-সুন্নাহর ওসব কথা দূর্ণী‌তিবাজ‌দের আতে ঘা লা‌গে ব‌লেই ওসব .........রা এখন মাহ‌ফি‌লের কন্ঠ‌রোধ কর‌তে চাই‌ছে।‌
    Total Reply(0) Reply
  • সবুজ ২২ জানুয়ারি, ২০২১, ২:০৪ এএম says : 0
    অন্য সভা সমাবেশে সবাই কত কথা বলে সেগুলো নিয়ে কারো মাথা ব্যাথা নেই!
    Total Reply(0) Reply
  • Md. Harun al-Rashid ২২ জানুয়ারি, ২০২১, ১০:২২ এএম says : 0
    ওয়াজ মাহফিলে কোরান ও হাদিসের বাইরে নৈতিকতা ও মানবিকবোধ জাগ্রত হয় এমন আদর্শিক বিষয় ছাড়াও নিপীড়নমূলক শাসন ঘুষ দূর্নীতি ধর্ষন ইত্যাদি বা ক্ষেত্র বিশেষে বিচারহীনতার বিরুদ্ধে প্রাসংঙ্গিক বক্তব্য বন্ধ করা সঠিক বলে বিবেচিত হওয়া উচিৎ নয়। পাপাচারের ভিন্ন নাম হলো অপরাধ। অপরাধ সংঘটন করা জীবনের সকল পর্যায়ে ঘৃনিত কাজ। দূর্বলের অপরাধ যেমন পাপ তেমনি ক্ষমতাবানের অপরাধও একই পাপ। ধর্মিয় দৃষ্টিকোন থেকে অপরাধ বিচার্য হলে মানুষ স্বভাবতই তা এড়িয়ে চলে। সমাজ সুন্দর হয়।
    Total Reply(0) Reply
  • আবু বক্কর ২২ জানুয়ারি, ২০২১, ২:০২ পিএম says : 0
    আমি বলি ওয়াজ মাহফিলের কণ্ঠরোধ না করে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের কণ্ঠরোধ করা দরকার
    Total Reply(0) Reply
  • আবু বক্কর ২২ জানুয়ারি, ২০২১, ২:০২ পিএম says : 0
    আমি বলি ওয়াজ মাহফিলের কণ্ঠরোধ না করে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের কণ্ঠরোধ করা দরকার
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মাহফিল


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ