Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

প্রচারণায় আছে ভোটে নেই বিএনপি

প্রার্থী হতে মরিয়া, রিস্ক নিতে নারাজ শেষ পর্যন্ত সক্রিয় থাকা পৌরসভায় ভালো ফল

ফারুক হোসাইন | প্রকাশের সময় : ১৯ জানুয়ারি, ২০২১, ১২:০২ এএম

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে শুরু করে পরবর্তী প্রতিটি নির্বাচনেই ভূমিধস পরাজয় বরণ করছে রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। নির্বাচনের পর দলটির নেতা ও প্রার্থীরা সরকারদলীয় নেতাকর্মী, নির্বাচন কমিশন (ইসি) ও প্রশাসনকে দায়ী করছেন। স্পষ্ট জানিয়ে দিচ্ছেন বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়, হতে পারে না। আবার তফসিল ঘোষণার সাথে সাথে ঝাঁপিয়েও পড়ছেন নির্বাচনী প্রচারণায়। চালানো হচ্ছে প্রচার-প্রচারণা, কিন্তু ভোটের দিনে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খুঁজে পাওয়া যায় না বিএনপির নেতাকর্মী কিংবা এজেন্টকে। ফলও আসছে আগের মতোই। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনপরবর্তী প্রতিটি নির্বাচনেই একই রকম দৃশ্য দেখছে দলটির নেতাকর্মীরা।

প্রথম ধাপের মতো সর্বশেষ দ্বিতীয় ধাপের পৌর নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীরা বেশিরভাগই পরাজিত হয়েছেন। ভোটের আগে প্রার্থীরা নেতাকর্মীদের নিয়ে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছেন। শো-ডাউন দিয়েছেন। কেন্দ্রীয় অনেক নেতাও এসব স্থানীয় নির্বাচনে গিয়ে প্রচারণা চালিয়েছে, বিএনপিধানের শীষের প্রার্থীর পক্ষে ভোট চেয়েছেন। প্রার্থীরাও ভোটের শেষ পর্যন্ত মাঠে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু ভোটের দিন সকাল থেকেই কোথাও কোথাও প্রার্থী এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নেতাকর্মী ও এজেন্টদের খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে অভিযোগ করেছে স্থানীয় বিএনপি। কোনো কোনো পৌরসভায় আবার এজেন্ট তালিকা দিয়ে দায় সেরেছে প্রার্থীরা। কেন্দ্রে প্রবেশ করতেও আসেনি তারা। তবে যেসব পৌরসভায় শেষ পর্যন্ত বিএনপির প্রার্থীরা মাঠে ছিলেন ফলাফল তাদের পক্ষে এসেছে বলেও নির্বাচনী ফলাফল বিশ্লেষণে জানা গেছে।

অবশ্য দলের কোনো কোনো নেতা মনে করেন, বর্তমান সরকার নির্বাচনকে যে জায়গায় নিয়ে গেছে, তাতে সুষ্ঠু ভোটের ব্যাপারে কারো আস্থা নেই। তাই মরিয়া হয়ে মাঠে থাকতে চান না অনেকে। এতে হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কাই বেশি থাকে। একদিকে হামলা, অন্যদিকে আবার মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে দেয়ার ভয় থাকে। এসব কারণে নির্বাচনে টাকাপয়সাও খরচ করতে আগ্রহী হন না কোনো কোনো প্রার্থী।

যদিও জাতীয় নির্বাচন, উপ-নির্বাচন কিংবা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রার্থী হতে তুমুল প্রতিদ্ব›িদ্বতা থাকে বিএনপিতে। ভোটের মাঠে থাকা, না থাকা সেটি মূখ্য বিষয় থাকে না তাদের, বরং স্থানীয় রাজনীতিতে প্রভাব বজায় রাখা, দলে শক্ত অবস্থান এবং প্রার্থিতা নিশ্চিত করাই তাদের কাজ বলে মনে করেন নেতাকর্মীরা। বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক নেতা বলেছেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন বা জাতীয় সংসদের উপনির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেতে নেতারা যতটা মরিয়া মনোভাব দেখান, ভোটের মাঠে তাঁদের সেভাবে সক্রিয় হতে দেখা যায় না। কেবল দলে অবস্থান ধরে রাখতে অনেকে প্রার্থী হন।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, এখন নির্বাচনের নামে তামাশা করা হচ্ছে। নির্বাচনের ফলাফল শেখ হাসিনার বাসায় আগেই ঠিক করা থাকে। নির্বাচনের দিন নির্বাচন কমিশন (ইসি) সেই ফল ঘোষণা করে। প্রশাসনের সহায়তায় আওয়ামী সন্ত্রাসীরা অধিকাংশ পৌর নির্বাচনী এলাকায় তান্ডবলীলা চালাচ্ছে। সরকারের ‘হার্ড হিটিং’ ইমেজ বজায় রাখতে ভোটারসহ বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর আক্রমণ চলছে বেপরোয়াভাবে। বিএনপি’র এজেন্টদেরকে কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া, তাদের ওপর করা হয়েছে পৈশাচিক আক্রমণ। আওয়ামী সন্ত্রাসীরা কেন্দ্র দখল করলেও প্রশাসন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে।

তিনি বলেন, নিশিরাতের ভোটের সরকার ও বেহায়া নির্বাচন কমিশনের যৌথ প্রযোজনায় এখন চলছে নির্বাচনী সার্কাস। আগের রাতে ভোট হলেও, ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে না গেলেও, অথবা কোনো কেন্দ্রে শতভাগের বেশি জোরপূর্বক ভোট কাস্টিং করলেও সরকার ও কমিশনের বয়ান একই যে, ভোট সুষ্ঠু হয়েছে।

গত এক বছরে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচন, বিভিন্ন উপ-নির্বাচন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও কেন্দ্রে কেন্দ্রে এজেন্ট দিতে ব্যর্থ হয়েছে বিএনপি। যার সর্বশেষটি দেখা গেছে দ্বিতীয় ধাপের পৌরসভা নির্বাচনে। বেশ কয়েকটি পৌরসভায় হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। তবে যেসব পৌরসভায় ভোটের দিন পর্যন্ত মাঠে ছিল বিএনপি নেতাকর্মীরা তার ফলও এসেছে ধানের শীষের প্রার্থীর পক্ষে।

তৃণমূল নেতাকর্মীদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে- বিএনপি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রচার-প্রচারণায় থাকলেও ভোটের দিনে তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। অনেক স্থানে কেন্দ্রে এজেন্ট দেয়ার মতো অবস্থাও থাকে না দলটির। তাদের মতে- সরকার ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাধা, হামলা দেয়ার বিষয়টি সত্য। কিন্তু যেসব পৌরসভায় বিএনপির প্রার্থীরা প্রচারণা থেকে ভোটের দিন কেন্দ্র পর্যন্ত লেগে ছিলেন, সেসব জায়গায় তুলনামূলক ভালো ফল এসেছে। তারা মনে করেন, নির্বাচনী প্রচারে বিএনপির প্রার্থীরা যতটা তৎপর ছিলেন, ভোটের দিন কেন্দ্রে শক্ত অবস্থান নেয়া, এজেন্ট রাখা এবং কেন্দ্রে ভোটার আনার ক্ষেত্রে তাঁদের ততটা সক্রিয় দেখা যায়নি।

দ্বিতীয় ধাপের ৬০টি পৌরসভার নির্বাচনে ৫৯টিতে অংশ নিয়ে বিএনপি ভালো ফল করেনি। দুই বিদ্রোহীসহ মাত্র ছয় পৌরসভায় জিতেছে বিএনপি। প্রায় অর্ধেকসংখ্যক পৌরসভায় বিএনপির প্রার্থীরা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় ছিলেন না। জয়ী হয়েছেন- বগুড়ার সান্তাহারে তোফাজ্জল হোসেন, দিনাজপুরে সৈয়দ জাহাঙ্গীর আলম, নবীগঞ্জে ছাবির আহমদ চৌধুরী ও মাধবপুরে হাবিবুর রহমান। দলের মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন শেরপুরে জানে আলম ও জগন্নাথপুরে আক্তার হোসেন। এর মধ্যে নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগে চারটি পৌরসভায় বিএনপির মেয়র প্রার্থীরা ভোট বর্জন করেন। অধিকাংশ নির্বাচনী এলাকায় বিএনপির প্রার্থী ও দলের কর্মী-সমর্থকদের তৎপরতা ছিল ঢিলেঢালা।

দ্বিতীয় ধাপের পৌরসভা নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ ও স্থানীয়দের সূত্রে জানা যায়, রাজশাহীর কাঁকনহাট পৌরসভায় মাত্র ৪৪৭ ভোটে হেরেছেন বিএনপির প্রার্থী হাফিজুর রহমান। কিশোরগঞ্জ পৌরসভায় বিএনপির মেয়রপ্রার্থী ইসরাইল মিঞা ভোটের মাঠে শেষ পর্যন্ত লড়ে তীব্র প্রতিদ্ব›িদ্বতা গড়েছেন। শরীয়তপুরে পৌরসভার নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীর কোনো তৎপরতা ছিল না। বিএনপি এজেন্টদের তালিকা রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে জমা দিলেও বেশিরভাগ কেন্দ্রে এজেন্ট দেখা যায়নি। তাদের কোনো অভিযোগও ছিল না। বিএনপির প্রার্থী লুৎফর রহমান ঢালীর গদবাঁধা অভিযোগ, ‘আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা আমাদের প্রচারণা চালাতে দেননি। তাঁদের বাধার কারণে অনেকে ভোটকেন্দ্রে যেতে পারেননি।’

গাইবান্ধা পৌরসভায় বিএনপির মেয়রপ্রার্থী শহিদুজ্জামান বলেন, অনেকটা শান্তিপূর্ণভাবে ভোট হয়েছে। ভোটারদের উপস্থিতি ভালো ছিল। পুলিশ ও প্রশাসনের ভূমিকা বেশ সন্তোষজনক ছিল। তবে কিছু কিছু কেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতির চেয়ে ভোট বেশি পড়েছে বলে দাবি করেন তিনি। তাঁর ভাষায়, এটা রহস্যজনক।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা ভোটের দিন সকাল থেকেই কেন্দ্র দখল করে রাখে। আমাদের এজেন্টদের সেন্টারে যেতে দেয় হয় না, বের করে দেয় এবং বিএনপি সমর্থকদের ভোট কেন্দ্রের কাছেও যেতে দেয়া হয় না।

তিনি বলেন, ভোটে এখন শুধু ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগই বিএনপির প্রতিদ্ব›দ্বী নয়, তাদেরকে সমর্থন দিচ্ছে পুলিশ ও প্রশাসন। এদের সমর্থন নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা গায়ের জোরে কেন্দ্র দখল করে রাখে। নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচন করতে একদিকে যেমন ব্যর্থ, অন্যদিকে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, জাতীয় নির্বাচন গেছে। এখন স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো একইভাবে তারা লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের প্রার্থী-কর্মীদের নির্যাতন, নিপীড়ন করা হচ্ছে। তিনি বলেন, নির্বাচনে ভোট ডাকাতি করে ক্ষমতাসীনরা পৌরসভা দখল করেছে। আপনারা দেখছেন যে, নির্বাচনগুলো কি হচ্ছে? পৌরসভা নির্বাচন শনিবার হয়ে গেল। প্রত্যেকটি নির্বাচনে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা দখল করে নিয়ে গেল, ডাকাতি করে নিয়ে গেল। এমনকি খুন পর্যন্ত হয়েছে সিরাজগঞ্জে একজন কমিশনার তিনি প্রায় ৮৫ ভাগ ভোট পেয়ে জিতেছেন তাকে হত্যা করা হয়েছে।



 

Show all comments
  • Md Jamal ১৮ জানুয়ারি, ২০২১, ১:৪০ এএম says : 0
    হিমত হে তো রাজ পথে নামোন আর কত টি ভি দেখবেন
    Total Reply(0) Reply
  • Abu Taher ১৮ জানুয়ারি, ২০২১, ১:৪১ এএম says : 0
    নৌকা ছাড়া কিছুইতো বর্তমান বাংলাদেশে দেখতে পাওয়া যায় না
    Total Reply(0) Reply
  • পায়েল ১৮ জানুয়ারি, ২০২১, ১:৪২ এএম says : 0
    নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচন করতে ব্যর্থ
    Total Reply(0) Reply
  • মাহমুদ ১৮ জানুয়ারি, ২০২১, ১:৪৩ এএম says : 0
    বিএনপিকে দিয়ে আর কিছু হবে বলে মনে হচ্ছে না
    Total Reply(0) Reply
  • ডালিম ১৮ জানুয়ারি, ২০২১, ১:৪৪ এএম says : 0
    দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা পুরোটা নষ্ট হয়ে গেছে
    Total Reply(0) Reply
  • সাদ্দাম ১৮ জানুয়ারি, ২০২১, ১:৪৫ এএম says : 0
    নির্বাচনী ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে
    Total Reply(0) Reply
  • yousuf ali ১৮ জানুয়ারি, ২০২১, ১:৫৫ এএম says : 0
    দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বিএনপি


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ