Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সমুদ্রসম্পদ কাজে লাগাতে হবে

মশি শ্রাবন | প্রকাশের সময় : ১৮ জানুয়ারি, ২০২১, ১২:০১ এএম

সমুদ্রসীমা নিয়ে ভারত ও মিয়ানমারের চার দশকের বিরোধে ২০১২ সালে আন্তর্জাতিক শালিসি আদালতের রায় বাংলাদেশের পক্ষে আসে। দুই প্রতিবেশী দেশ সে রায় মেনেও নিয়েছে। রায় বাংলাদেশের জন্য উন্মুক্ত করেছে অপার সম্ভাবনা। ব্লু-ইকোনমির মাধ্যমে ভাগ্য গড়ার সম্ভাবনাকে গত আট বছর কতটুকু কাজে লাগানো সম্ভব হয়েছে তা বড় মাপের প্রশ্ন। তবে ব্লু-ইকোনমি থেকে লাভবান হওয়ার বিষয়টি এতটাই প্রযুক্তিনির্ভর যে এ ক্ষেত্রে যথাযথ প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশ গত আট বছর সে প্রস্তুতিতেই সময় কাটিয়েছে। এ জন্য দক্ষ লোকবল সৃষ্টিতে গড়ে তোলা হয়েছে বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়। নৌবাহিনীর পক্ষ থেকে গড়ে তোলা হয়েছে উচ্চতর গবেষণা প্রতিষ্ঠান। এখন সময় ব্লু-ইকোনমির ক্ষেত্রে জোর কদমে এগিয়ে যাওয়া। বিশ্ব অর্থনীতিতে সমুদ্রসংশ্লিষ্ট অবদান এক কথায় বিশাল। ৪৩০ কোটির বেশি মানুষের ১৫ শতাংশ প্রোটিনের জোগান দেয় সামুদ্রিক মাছ, উদ্ভিদ ও জীবজন্তু। পৃথিবীর ৩০ শতাংশ গ্যাস ও জ্বালানি সরবরাহ হয় সমুদ্রতলের বিভিন্ন গ্যাস ও তেল ক্ষেত্র থেকে। ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় অর্থনীতির সিংহভাগ সমুদ্রনির্ভর।

অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়া সমুদ্রসম্পদ থেকে বর্তমানে প্রায় ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করে। ২০২৫ সালে এ খাত থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলার আয় করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করছে সে দেশের সরকার। এ ছাড়া চীন, জাপান, ফিলিপাইনসহ বেশ কিছু দেশ কয়েক শতাব্দী ধরে সমুদ্রকেন্দ্রিক অর্থনীতির দিকে মনোনিবেশ করেছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রায় ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের কর্মকান্ড হচ্ছে সমুদ্রকে ঘিরে। দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্লু ইকোনমির সম্ভাবনা পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগাতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা চেয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা খুবই সমৃদ্ধ। মাছের খনি বলা হয় এ সমুদ্রসীমাকে। সমুদ্রসীমায় গ্যাস ও তেলের সন্ধান পাওয়ার ব্যাপারে দেশের সমুদ্র বিশেষজ্ঞরা বেশ আশাবাদী।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন তার লেখায় লিখেছেন, বাংলাদেশের মোট সমুদ্রসীমার আয়তন প্রায় এক লাখ ২১ হাজার ১১০ বর্গকিলোমিটার। সাম্প্রতিক সময়ে সেন্টমার্টিনের দক্ষিণ-পূর্ব থেকে শুরু করে সুন্দরবনের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের দিকে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা ৭১০ কিলোমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বিস্তৃত সমুদ্রাঞ্চল বিভিন্ন প্রজাতি ও প্রকারের সমুদ্রসম্পদের উৎস। সামুদ্রিক কচ্ছপের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রজনন এলাকা হলো সমুদ্রের পূর্ব উপকূল। বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল অঞ্চলও এই পূর্ব উপকূলেই অবস্থিত। পূর্ব এশিয়া-অস্ট্রেলেশিয়ান এবং মধ্য এশিয়ান অঞ্চলের প্রায় ১০০ প্রজাতির অতিথি পাখির আবাসস্থল, বিচরণ কেন্দ্র এবং তাদের শীতকালীন অবকাশযাপন কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে কেন্দ্রীয় উপকূল এলাকাকে। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল বিশ্বের বিলুপ্তপ্রায় ১০ প্রজাতির উপকূলীয় পাখির আশ্রয়স্থল। পশ্চিম উপকূলীয় এলাকায় স্তন্যপায়ী প্রাণী, যেমন- রয়েল বেঙ্গল টাইগার এবং বিভিন্ন সরীসৃপ লোনা পানির কুমিরের আশ্রয়স্থল।

সাম্প্রতিক এফএওর (ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অরগানাইজেশন) প্রতিবেদন অনুযায়ী, অভ্যন্তরীণ প্রাকৃতিক উৎস থেকে মৎস্য আহরণে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়, সামুদ্রিক মৎস্য আহরণে ২৫তম এবং সামগ্রিক মৎস্যচাষে পঞ্চম। বর্তমান প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পারলে ২০২২ সালের মধ্যেই বাংলাদেশের দখলে চলে আসবে মৎস্য আহরণের শীর্ষস্থান। বিভিন্ন প্রজাতির মৎস্যসম্পদ ছাড়াও বাংলাদেশ সমুদ্র-তীরবর্তী এলাকা তেল ও গ্যাসের একটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র। যদিও এখনও পর্যন্ত সমুদ্র এলাকায় তেল ও গ্যাস খননে খুব বেশি সাফল্য আসেনি। সমুদ্র এলাকায় তেল ও গ্যাসক্ষেত্র হিসেবে এখন পর্যন্ত মিয়ানমারের নিকটবর্তী অগভীর সমুদ্রাঞ্চলকেই বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। কারণ এরই মধ্যে মিয়ানমারের আরাকান উপকূলীয় এলাকায় অনেক বড় গ্যাসক্ষেত্র (শিও, ফু, মিয়া) আবিষ্কৃত হয়েছে। বাংলাদেশ অংশেও রয়েছে এর সম্ভাবনা। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে এরই মধ্যে বিভিন্ন পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ। সমুদ্রসম্পদ সংরক্ষণে নিয়েছে বিভিন্ন উদ্যোগ।

বঙ্গোপসাগরে মাছ ছাড়াও বিভিন্ন রকমের মূল্যবান সম্পদ রয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য সমুদ্র দেশের মতো আমাদের দৃষ্টিও তাই বঙ্গোপসাগরের দিকে হওয়ার কথা। সমুদ্রসীমানা নিয়ে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে যে বিরোধ ছিল তার অবসান হয়েছে। এখন আমাদের সমুদ্র এলাকার মধ্যে অবস্থিত সম্পদ রক্ষা ও আহরণের উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

বিশ্বের মহাসাগর, সাগর ও উপসাগরগুলো নানা প্রকার দূষণের প্রতিক্রিয়ার শিকার। ডলফিনসহ জীববৈচিত্র্য ধ্বংস, মৎস্য ও মৎস্যক্ষেত্র বিনাশ, অক্সিজেনশূন্য এলাকা সৃষ্টি এমনকি সাগর শুকিয়ে যাওয়ার মতো বেনজির প্রতিক্রিয়াও লক্ষ করা যাচ্ছে। আমাদের নদীগুলো শেষ হয়ে গেছে। নদীতে আর এখন আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না। এমন নদীও কম নেই, দখল-দূষণে যাদের পানিতে মাছের অস্তিত্ব নির্মূল হয়ে গেছে। এখন সমুদ্রও হুমকির মুখে। আগামীর মৎস্যচাহিদা পূরণে সমুদ্রের বৃহত্তর ভূমিকা রাখার সুযোগ সংকুচিত হয়ে পড়ার আশংকা স্পষ্ট। এ প্রেক্ষাপটে, সমুদ্রে পর্যবেক্ষণ, জরিপ ও গবেষণা জোরদার করতে হবে। সুরক্ষা বাড়াতে হবে। জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থেই সমুদ্রকে বাঁচাতে হবে।

লেখক: প্রকাশক ও ব্যবস্থাপনা সম্পাদক দৈনিক মাতৃভূমি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আন্তর্জাতিক-শালিসি-আদালত
আরও পড়ুন