Inqilab Logo

শক্রবার ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ কার্তিক ১৪৩১, ০৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ঢাকার পরিবেশ উন্নয়নে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে

| প্রকাশের সময় : ১২ জানুয়ারি, ২০২১, ১২:০১ এএম

রাজধানী ঢাকার সামগ্রিক পরিবেশ মারাত্মক রূপ পরিগ্রহ করেছে। পরিবেশের এমন কোনো দিক নেই, যার ক্রমাবনতি না ঘটছে। সড়কে তারের জঞ্জাল দৃষ্টিকটুই শুধু নয়, সুষ্ঠু-সুন্দুর পরিবেশেরও খেলাপ। এছাড়া এ থেকে বিপদাপদ হওয়ার আশংকাও বিদ্যমান। তারের জঞ্জাল সময় বেঁধে দিয়েও অপসারণ করা সম্ভব হয়নি। কবে সম্ভব হবে, সেটাও অনিশ্চিত। ঢাকার বায়ুদূষণ চরম অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় পৌঁছেছে। অতীতের রেকর্ড ভেঙ্গে বায়ুদূষণের মাত্রা ৫০২ পিএম’এ উপনীত হয়েছে। বায়ুদূষণের একটি বড় কারণ ধুলা। ঢাকা কার্যত ধুলায় ধূসরিত। এই সঙ্গে যানবাহন ও কলকারখানা এবং আশপাশের ইটভাটার কালো ধূয়া তো আছেই। বায়ু দূষণের কারণে সর্দি-কাশি ও শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত রোগব্যাধি ব্যাপক আকার নিয়েছে। ঢাকার শব্দদূষণও ভয়ংকর। মানুষের শব্দ গ্রহণের স্বাভাবিক মাত্রা ৪০-৫০ ডেসিবেল। এর বেশি হলে শ্রবণশক্তি কমতে কমতে এক সময় পুরোপুরি লোপ পেতে পারে। সচিবালয়সহ কয়েকটি এলাকাকে নিরব এলাকা ঘোষণা করা হলেও সাম্প্রতিক এক গবেষণাতথ্যে দেখা গেছে, নিরব এলাকায় শব্দের মাত্রা ৬০ ডেসিবেলের বেশি, এমন কি ১২৯ ডেসিবেলও ছাড়িয়ে যায়। শব্দদূষণের প্রধান কারণ, যানবাহনের হাইড্রোলিক হর্ন। দেখা গেছে, জিরো পয়েন্ট এলাকায় ১০ মিনিটে অন্তত ৩৩২ বার হর্ন বাজে। নিরব এলাকাতেই যদি পরিস্থিতি এরকম হয়, তবে অন্যান্য এলাকায় তা কীরূপ হতে পারে, সহজেই আন্দাজ করা যায়। ঢাকা একটি অপরিচ্ছন্ন নগর। যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনার স্তুপ লক্ষ্য করা যায়। রাস্তাঘাট, ফুটপাত, উন্মুক্তস্থান এবং বিভিন্ন স্থাপনা ও বাড়িঘরের আঙিনা নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয় না। সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাবে গোটা নগর ময়লা-আবর্জনার ভাগাড় হয়ে থাকে। ঢাকাকে বলা হয়, যানজটের নগর। রাতদিন ২৪ ঘণ্টার অন্তত ১৬ ঘণ্টা যানজটের শিকার হয় নাগরিকজীবন। এতে পরিবেশের ক্ষতি ছাড়াও প্রতিদিন প্রায় ২ কোটি কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। আর্থিক ক্ষতি হয় ১৩৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা। সাম্প্রতিক এক গবেষণার এ তথ্য জানা গেছে। ঢাকার খাল-বিল-জলাশয় এবং আশপাশের নদীগুলে। ভয়াবহ দূষণে দূষিত। খাল-বিল-জলাশয় ও নদীগুলো একই সঙ্গে কঠিন ও তরল বর্জ্যরে স্থায়ী ঠিকানায় পরিণত হয়েছে। এক খবরে জানা গেছে, ঢাকার চার পাশের ৫ নদীতে অন্তত ৩০০ স্থান থেকে প্রতিদিন ৩ লাখ কেজি বর্জ্য পতিত হয়। বলাবাহুল্য এটা তরল বর্জ্য। কঠিন বর্জ্যরে হিসাব এর বাইরে। ঢাকা বস্তির নগরের পরিচয় পেয়েছে অনেক আগেই। বস্তি মনুষ্য বসবাসের একেবারেই উপযুক্ত নয়। ঢাকা বিগত কয়েক বছর ধরে বিশ্বের বসবাসের অযোগ্য নগরের তালিকায় শীর্ষ অবস্থান করছে।

ঢাকাকে ময়লা-আবর্জনা ও সব ধরনের জঞ্জাল মুক্ত করা, বায়ু, শব্দ ও অন্যান্য দূষণ কমানো, খাল-বিল-জলাশয় ও নদীগুলো থেকে কঠিন ও তরল বর্জ্য অপসারণের সঙ্গে সঙ্গে বর্জ্যপতন নিরোধ করা এবং সর্বোপরি তাকে পরিচ্ছন্ন, সুশৃংখল ও বাসযোগ্য করা আপাত কঠিন মনে হলেও অসম্ভব নয়। উপযুক্ত পরিকল্পনা, উদ্যোগ ও কার্যব্যবস্থা গ্রহণ করলে একে সুন্দর, মনোরম এবং উত্তম বসবাসযোগ্য নগরে রূপান্তরিত করা খুবই সম্ভব। রাজধানী হিসাবে ঢাকার অবস্থান, উপযুক্ততা ও পরিবেশিক বৈশিষ্ট্য বিশ্বের অন্য যে কোনো রাজধানী নগরের চেয়ে শ্রেয়। নদীবেষ্টিত উচ্চভূমি, যার অভ্যন্তর গাছপালা, খাল-বিল-জলাশয়ে শোভিত। একই সঙ্গে আবহাওয়া স্বাস্থ্যকর ও মনোহর এবং সম্পূর্ণ সুরক্ষিত ও নিরাপদ। একদা এইসব কারণেই একে রাজধানী হিসাবে নির্বাচন করা হয়েছিল। ঐতিহাসিকদের অনেকেই বলে থাকেন, রাজধানী যদি ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে সরিয়ে না নেয়া হতো তবে বাংলার স্বাধীনতা হরণ করা ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কেন, কোনো শক্তির পক্ষেই সম্ভব হতো না। তারা যখন এটা বলেন তখন অবশ্যই তাদের মনে থাকে ঢাকার রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য ও ভৌগোলিক অবস্থানের কথা। সেই ঢাকা এখন রাজধানীর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত থাকলেও তার অবস্থানগত পরিবেশের ব্যাপক অবনতি ঘটেছে। ইতোমধ্যেই তার পরিবেশ-প্রতিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। বাসযোগ্যতার অবনতি ঘটেছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে এমন এক সময় আসতে পারে, যখন বাসযোগ্যতা সম্পূর্ণ লোপ পেতে পারে। তখন ঢাকাবাসীদের দলে দলে স্বেচ্ছায় এ নগর ছেড়ে চলে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। পরিবেশ বিপর্যয় ও বাসযোগ্যতা হারানোর ফলে অতীতে বিশ্বের বহু বিখ্যাত ও সমৃদ্ধ রাজধানী বিরান ও পরিত্যক্ত হয়েছে। অনুরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টির আশংকা রয়েছে এখনো বিশ্বের কিছু রাজধানীর। ঢাকা কিংবা দিল্লী সেই আশংকার পর্যায়ে রয়েছে।

তার আগেই আমাদের প্রিয় রাজধানী ঢাকাকে সুরক্ষার পর্যাপ্ত ও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। সব ধরনের জঞ্জাল ও বর্জ্য দূর করতে হবে। বায়দূষণ, শব্দদূষণ, মাটিদূষণ, পানিদূষণ ডেডস্টপ করতে হবে। খাল-বিল-জলাশয় ও নদী দখলমুক্ত করতে এবং দূষণ রুখতে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। যাতায়াত ও চলাচল বাধা ও যানজটমুক্ত করতে হবে। এসব ব্যাপারে আমরা অতীতে অনেক আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতির কথা শুনেছি। ঢাকাকে তিলোত্তমা করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। কিন্তু ঘোষণার বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। নানাক্ষেত্রে প্রকল্প গৃহীত হয়েছে; তাদের বেশির ভাগের বাস্তবায়ন হয়নি। যেমন তারের জঞ্জাল আলটিমেটাম দিয়েও সরানো যায়নি। অনুরূপভাবে সুচারু বর্জ্যব্যবস্থাপনার কথা বলা হলেও তা হয়নি। দখল থেকে খাল ও নদী উদ্ধার এবং সেগুলো দূষণমুক্ত করার কথা রক্ষিত হয়নি। নদীর সীমানা পিলার বসানোর অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। বুড়িগঙ্গা থেকে বর্জ্য অপসারণের প্রকল্প সম্পন্ন হয়নি। মাঝখান থেকে কোটি কোটি টাকা গচ্ছা গেছে। ঢাকার পরিবেশসহ অন্যান্য উন্নয়নে যত অর্থ ব্যয় করা হয়েছে তার একটা বড় অংশই লুটপাট হয়ে গেছে। এই প্রেক্ষাপটে ঢাকাকে উন্নত, পরিবেশবান্ধব, বাসযোগ্য ও নিরাপদ করতে হলে সরকারকে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দেখা গেছে, সব ধরনের অনাচার, দুষ্কর্ম, দখল, লুটপাট ইত্যাদির সঙ্গে সরকারি দলের এক শ্রেণির নেতাকর্মীর সম্পৃক্ততা রয়েছে। কাজের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা রহিত করা না গেলে কোনো কাজই সুষ্ঠুভাবে সম্পূর্ণভাবে সম্পন্ন হবে না। বিষয়টি আমলে নিয়ে সরকারকে যথাযোগ্য পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রকল্প গ্রহণই যথোষ্ট নয়, তার বাস্তবায়নই আসল। কাজেই গৃহীত সব প্রকল্পের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ঢাকার-পরিবেশ
আরও পড়ুন