Inqilab Logo

শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের দাবির ওপর প্রশ্নচিহ্ন

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ১০ জানুয়ারি, ২০২১, ১২:০১ এএম

এ পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ প্রজাতির প্রাণীর বাসস্থান। মানুষ তার মধ্যে শ্রেষ্টতম। তবে মানুষ এ পৃথিবীর আদি বাসিন্দা নয়। মানুষ নামক প্রাণীর আবির্ভাবের বহু কোটি বছর পূর্ব থেকে উল্লেখযোগ্য অনেক প্রজাতির প্রাণী এ পৃথিবীতে ছিল, আবার অনেকে লুপ্ত হয়ে গেছে। কাজেই পৃথিবীর প্রাণীকুলের মধ্যে মানুষ তেমন প্রাচীন নয়, আর সে হিসাবে বোধহয় মানুষকে ভূমিপুত্র বলাও সঙ্গত নয়। মানুষ একদিকে নিজেকে সর্বোৎকৃষ্ট বলে জাহির করে, অপরদিকে অন্য প্রাণীকে নিকৃষ্ট হিসাবে গণ্য করে। তাই ঘৃণ্য নৃশংস অপরাধকর্মে লিপ্ত ব্যক্তির তুলনা পশুর সঙ্গে করা হয়। ধর্ষক, খুনি, অপরাধীদের নরপশু বলে আখ্যায়িত করা হয়। ঘৃণ্য অপরাধীর গায়ে নরপশু তকমা সেঁটে পক্ষান্তরে এটি বোঝানো হয় যে, পশুরাই ঘৃণ্য কাজ করে থাকে, তাই তারা নিকৃষ্ট ও নিন্দনীয়।

অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় মানুষ সামগ্রিকভাবে সর্বোৎকৃষ্ট এমন দাবির তেমন সুদৃঢ় ও যুক্তিসঙ্গত ভিত নেই। পক্ষান্তরে অপরাধ-প্রবণতার মাত্রা ও তীব্রতার তুলনামূলক আধিক্য মানুষের মধ্যে লক্ষিত হয়। ধর্ষক, খুনি, অপরাধীর তুলনা পশুর সঙ্গে করাটা যেহেতু প্রথায় পরিণত হয়েছে তাই ধর্ষণ ও খুন বিষয় দু’টির মধ্যে আলোচনাকে সীমিত রেখে সভ্য মানুষ ও অসভ্য পশুর তুলনামূলক শ্রেষ্ঠত্বের বিচার করা যেতে পারে। কোনো মানুষ ধর্ষণ বা খুনের মতো ঘৃণ্য অপরাধ করলে কঠোর ভাষায় নিন্দিত হয়, কৃত অপরাধের জন্য তার তুলনা করা হয়। খুনি-ধর্ষককে নরপশু বলাটা এখন রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি যেন সবচেয়ে যথাযথ তুলনা তার অপরাধের মাত্রা ও ভয়াবহতা বোঝানোর জন্য যথেষ্ট। অর্থাৎ খুন ও ধর্ষণ নামক ঘৃণ্য নিন্দনীয় আচার যেন পশুর মধ্যে সর্বাধিক প্রচলিত। অবাক হতে হয়, এ ধরনের এক ডাহা মিথ্যা ধারণার কবে ও কীভাবে উৎপত্তি ঘটে এবং তার সত্যতা ও তাৎপর্য বিচার না করে কেন এ ধরনের ভিত্তিহীন ধারনাকে চিরায়িত সত্য হিসাবে মেনে নেওয়া হচ্ছে? বাস্তবে খুন ও ধর্ষণ সংক্রান্ত ব্যাপারে পশুর সঙ্গে মানুষের তুলনা যুক্তিহীন শুধু নয়, ভিত্তিহীনও বটে।

খুন বা হত্যা দিয়ে তার ব্যাখ্যা শুরু করা যেতে পারে। প্রাকৃতিক নিয়মে প্রাণীকুলের মধ্যে হত্যার প্রচলন বিদ্যমান। প্রাণীকূলের অস্তিত্ব বজায় রাখতে এ হত্যার প্রচলন প্রয়োজন। পরিবেশ বিজ্ঞানে আহারধারা বা আহার-শৃঙ্খল বলে একটা ব্যাপার আছে যেখানে অতিশয় ক্ষুদ্র প্রাণী থেকে শুরু করে অতিকায় প্রাণী অবধি একে অন্যের খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রাকৃতিক নিয়মে ও প্রয়োজনে একের অন্যকে হত্যা করে খাদ্যভাব মেটাতে হয়। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার্থে তথা সৃষ্টির স্থায়িত্ব প্রদানার্থে এটি আবশ্যক। মানুষ সভ্য প্রাণী হলেও নিজের খাদ্যের প্রয়োজন মেটাতে অন্যান্যদের মতো প্রাণী হত্যা করে থাকে। সভ্য জগতের মানুষ গরু, মহিষ, ছাগল, হাঁস, মুরগি, মাছ ইত্যাদি সবই হত্যা করে খাদ্যের জন্য। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, অন্যান্য পশু শুধু খাদ্যের প্রয়োজন মেটাতে হত্যা করে, প্রতিহিংসা বা নিছক সখের বশবর্তী হয়ে তারা কখনো অহেতুক হত্যায় লিপ্ত হয় না। তৃপ্তউদর শিকারী পশুর পাশ দিয়ে তার প্রিয় শিকার আনাগোনা করতে থাকলেও নির্লিপ্ত ভূমিকা পালন করে।কিন্তু সভ্য মানুষের আচরণ অতি বিচিত্র। মানুষ প্রয়োজন ব্যতিরেকেও হত্যায় লিপ্ত হয়। মানুষ বিভিন্নভাবে প্রাণীবধ করে, নিজের শখ মেটাতে পশু হত্যা করে, অন্য প্রাণী থেকে ক্ষতির অমূলক আশঙ্কায় তাকে হত্যা করে। বন্য প্রাণী অন্তত নিজ প্রজাতির সদস্যদের হত্যা করে না, কিন্তু সভ্য মানুষ বর্তমানে নিজ প্রজাতির প্রাণীকে সবচেয়ে বেশি হত্যা করে যাচ্ছে। বছর কয়েক পূর্বে ভারতের ধেমাজি ও রাশিয়ায় স্কুল-পড়–য়া নিষ্পাপ শিশুদের স্বজাতি কর্তৃক হত্যা কেবল মানুষ নামক প্রাণী করতে পারে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নির্মমভাবে যে নরহত্যা করা হচ্ছে তা তো হচ্ছে মানুষের দ্বারাই। এ ধরনের ঘটনা অন্য কোনো প্রজাতির প্রাণীর মধ্যে কস্মিনকালেও ঘটেছে বলে নিশ্চয়ই কোনো জীববিজ্ঞানীর গোচরে নেই। এটি পরিষ্কার যে, বন্যপ্রাণী কর্তৃক হত্যার পেছনে যুক্তিঙ্গত কারণ থাকে। এ হত্যা আবশ্যকীয় হত্যা, প্রকৃতি নির্ধারিত নিয়মানুগ হত্যা। কিন্তু সভ্য মানুষ অনাবশ্যক হত্যাকান্ডে প্রতিনিয়ত লিপ্ত হয়। তাই ‘সভ্য’ মানব খুনিকে ‘অসভ্য’পশুর সঙ্গে তুলনা করাটা অযৌক্তিক ও হাস্যকর মনে হয়।
এবার আসা যাক ধর্ষণের কথায়। ইদানিং ধর্ষণ নামক অতি ঘৃণ্য সামাজিক ব্যাধির আত্যন্তিক সংক্রমণ শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের কাছে আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধর্ষণ সম্বন্ধীয় খবর পত্র-পত্রিকায় নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আর এ ক্ষেত্রে ধর্ষণকারীকে কেবলমাত্র পশুর সঙ্গে তুলনা করলে যেন তার অপরাধের মাত্রার সঠিক প্রকাশ ঘটে। তাই বলা হয়, ধর্ষক-নরপশু, সে মানুষ নামের অযোগ্য। অথচ একটু মর্মানুসন্ধানী হলে অনুভূত হবে ধর্ষক মানুষ নামের যোগ্য, মানুষ নামই এদের শোভা দেয়; পশুর সঙ্গে এদের তুলনা একেবারেই বেমানান। কারণ ধর্ষণ নামক ক্রিয়া মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণীর মধ্যে প্রকৃত অর্থে একেবারেই লক্ষিত হয় না। যারা প্রাকৃতিক জীবন সম্বন্ধে কিছুটা জ্ঞাত, তাদের অবশ্যই বন্যপ্রাণীর যৌনাচার সম্বন্ধে ধারণা আছে। বন্যপ্রাণীর যৌনাচার অত্যন্ত শৃঙ্খলাবদ্ধ ও নিয়মানুগত। গরিষ্টসংখ্যক বন্যপ্রাণীর মধ্যে যৌনক্রিয়ার একটা সুনির্দিষ্ট সময় ঋতু থাকে। মানুষের মত যত্রতত্র, যখন তখন তারা যৌনক্রিয়ায় লিপ্ত হয় না। বন্যপশুরা সাধারণত একটি নির্দিষ্ট সময়-কালে যৌনক্রিয়ায় প্রবৃত্ত হয়, তা-ও আবার নর-নারী উভয়ের সম্মতিক্রমে। পারস্পরিক সম্মতিবহির্ভূত বলপূর্বক একতরফা যৌনক্রিয়ায় লিপ্ত হওয়ার নামই ধর্ষণ। এ ধর্ষণ মূলত মানুষ নামক সভ্য পশুর মধ্যে পরিলক্ষিত হয়, বন্যপশুর মধ্যে এর প্রচলন নেই। বন্যপশুর মধ্যে যৌনক্রিয়া আছে, ধর্ষণ নেই। অধিকন্তু তাদের যৌনক্রিয়া নির্দিষ্ট বয়সে ও নির্দিষ্ট সময়ে সংঘটিত হয়ে থাকে। শিশু-নাবালিকার সঙ্গে যৌনক্রিয়া বা ধর্ষণে লিপ্ত হওয়ার মত অতি ঘৃণ্য মনোবৃত্তি বন্যপশুর মধ্যে একেবারেই অনুপস্থিত। এ হিসাবে পশুর রুচিবোধ, যৌনাচার এই সভ্য মানুষের চেয়ে অনেক উন্নত।
প্রাকৃতিক নিয়মে খাদ্য ও যৌনক্রিয়া দুটো অত্যাবশ্যক। সৃষ্টি তথা প্রাণীজগতের অস্থিত্ব ও ধারাবাহিকতা এ দুটোই মূল স্তম্ভের উপর নির্ভরশীল। যৌনক্রিয়ার মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম সৃষ্টি হয় আর খাদ্যের মাধ্যমে তা টিকে থাকে। এভাবে জীবনচক্র চলতে থাকে। তাই খাদ্যের জন্য ‘হত্যা’ আর সৃষ্টির জন্য ‘যৌনক্রিয়া’-এটি প্রকৃতির নিয়ম। বন্যপশু হত্যা ও যৌনক্রিয়া দু’টোই প্রকৃতি নির্ধারিত নিয়মে সম্পন্ন হয়। সভ্য মানুষকে কারণ-অকারণে, প্রয়োজন-অপ্রয়োজন দু’ক্ষেত্রে হত্যা (খুন) ও যৌনক্রিয়া (ধর্ষণ) করতে দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে পশুর চেয়ে মানুষ অবশ্যই নিকৃষ্ট।

প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা, বিশেষ করে বন্যপ্রাণীর আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষার্থে সংঘবদ্ধ জীবন তথা মানব সভ্যতার সূত্রপাত। বর্তমানে অন্য প্রাণী থেকে নিজেদের প্রাণশংকা একেবারে ন্যূনতম হলেও আজ আমরা স্বজাতি নিধনে লিপ্ত হয়েছি। ইরাক, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ফিলিস্তিন, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিদিন মানুষ কর্তৃক মানুষ হত্যার শত শত ঘটনা ঘটে চলেছে। এই কি আমাদের সভ্যতা ও শ্রেষ্ঠত্বের নমুনা? রাজপথে প্রকাশ্য দিবালোকে বিবস্ত্র নারীকে খুন করতে ধাবমান যে মানুষ, সদ্যজাত সন্তানকে ডাস্টবিনে মৃত্যুমুখে ফেলে যায় যে মানুষ, নিজ পিতা বা মাতাকে বৃদ্ধ বা অসুস্থ অবস্থায় রাস্তার পাশে বা ডাস্টবিনে যে রেখে যায়, সেই তারা কি মানুষ?
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট



 

Show all comments
  • Leo Prodip Majhi ১০ জানুয়ারি, ২০২১, ৮:২৭ এএম says : 0
    দারুণ লিখন। এভাবে কখনও ভাবা হয়নি। কারণ ভাবনা চিন্তার ওপশনগুলো এখন বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা এখন দায়ছাড়াভাবে জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এখন ভালোকে ভালো বলার সাহস নেই কারণ নিজে ছোট হয়ে যাবো বলে। মন্দকে খারাপ বলার সাহস নেই কারণ পাছে লোকে কিছু বলে। এখন দেখেও না দেখার ও শুনেও না শোর ফ্যাশনে চলছি।
    Total Reply(0) Reply
  • Jack+Ali ১০ জানুয়ারি, ২০২১, ৪:৪৮ পিএম says : 0
    Qur'ranic rule is the only solution. Our countries majority people are Muslim but they never fight to established the Law of Allah.. Allah will ask us in the Qiyammah that why don't you fight for my right because I have created you as a Khalifa and your duty is to rule the whole world by My Law [QUR'AN]. In Qiyamah what answer we will give???????????
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মানুষ-শ্রেষ্ঠ
আরও পড়ুন