পবিত্র লাইলাতুল বরাত
![img_img-1720479160](https://old.dailyinqilab.com/resources/images/cache/169x169x3_1678112525_editorial-inq.jpg)
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
মূর্তিপূজার অসারতা ও কুফল সম্পর্কে নবী-রসূলগণ শুরু থেকেই মানুষকে সতর্ক করে আসছেন। মূর্তি তথা প্রতিমা শির্ক-মহাপাপ আল্লাহর একত্ববাদের (তওহীদ) সম্পূর্ণ পরিপন্থী। কোরআন ও হাদিসে মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে অসংখ্য স্থানে বলা হয়েছে। খোদ রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমি মূর্তি ধ্বংসের জন্য প্রেরিত হয়েছি।’ মক্কা বিজয়ের পর তিনি খানা-ই কাবাকে প্রতিমা মুক্ত করেন, যা প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ঘটনা। এমন কি, অদৃশ্য শক্তি পর্যন্ত মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে মহানবী (সা.)-এর আগমনের ভবিষ্যত-বাণী করেছে। এ সম্পর্কে জি¦নদের বহু ঘটনা জানা যায়। হুজুর (সা.)-এর নিকট বহু জি¦ন ইসলাম গ্রহণ করেছিল, কোরআনে যার বিবরণ রয়েছে। হাদিস হতেও জানা যায়, রসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট বিভিন্ন সময় জি¦ন প্রতিনিধি দল এসে মুসলমান হয়ে ইসলামের শিক্ষা গ্রহণ করেছিল।
সবচেয়ে মজার কথা এই যে, জি¦নের কণ্ঠে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আবির্ভাবের বার্তা এবং ভূত-মূর্তির নিন্দা শুনে বেশ কিছু লোক মুসলমান হয়ে যায় এবং হুজুর (সা.)-এর সাহাবী হওয়ার গৌরব অর্জন করে। জি¦ন সম্প্রদায়ের মধ্যে যারা মুসলমান ছিল, তারাও মূর্তিপূজার বিরোধী ছিল এবং তাদের কণ্ঠে মূর্তিপূজার নিন্দা শুনে ইসলাম গ্রহণকারীদের বিবরণ সীরাত গ্রন্থগুলোতে লিপিবদ্ধ রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ তাদের কয়েকজনের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।
হজরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা.) বলেন, যখন হুজুর (সা.) জন্ম লাভ করেন তখন এক জ্বিন ‘হাজুন’ নামক পর্বতে এবং অপর জ্বিন আবু কুবাইস নামক পর্বতে উঠে উচ্চ কণ্ঠে হুজুর (সা.)-এর প্রশস্তিমূলক বাক্য পাঠ করে। হাজুন পর্বতের জ্বিন বলে: (১) আমি শপথ করে বলছি, আজ পর্যন্ত দুনিয়ায় কোনো নারী এমন শিশু জন্ম দেয়নি, (২) যেভাবে এ বনি জোহরার নারী শিশু জন্ম দিয়েছে, যে গৌরবের অধিকারী গোত্রগুলোর নিন্দা থেকে দূরে অবস্থানকারী এবং মর্যাদাবান ও (৩) সে (নারী) গোত্রগুলোর মধ্যে সর্বোত্তম শিশু আহমদকে জন্ম দিয়েছে। তাই কি শানের অধিকারী জন্ম লাভ করা শিশু এবং কি মর্যাদাবান জননী।
এসব কবিতায় রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মহিয়সী জননী, বনি জোহরা গোত্রের রমণী হজরত আমেনার প্রশংসাকীর্তণ করা হয়েছে। ‘আবু কুবাইস’ পর্বতের জ্বিনের কণ্ঠে উচ্চারিত কবিতাগুলোতে হজরত আমেনার বংশ মর্যাদার কথা বলা হয়েছে।
জ্বিনের কণ্ঠে হুজুর (সা.)-এর আগমন বার্তা শুনে ইসলাম গ্রহণকারী কয়েকজনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
আব্বাস ইবনে মেরদাস (রা.):
হজরত আব্বাস ইবনে মেরদাস (রা.), যিনি জাহেলী যুগেও মদকে হারাম মনে করতেন এবং মুসলমান হওয়ার পর ‘মোয়াল্লেফাতুল কুলুবে’র অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তারা সে সব লোক, যারা বিভিন্ন গোত্রে ও দলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে তাদের অনেকেই ছিলেন ইসলামের ঘোর শত্রু এবং রসুলুল্লাহ (সা.) এর বিরোধী। তাদের মধ্যে এমন অনেক লোক ছিল, যারা প্রকাশ্যে মুসলমান বলে দাবি করলেও গোপনে (অন্তরে) ছিল ইসলাম বিরোধী। হজরত আব্বাস ইবনে মেরদাস (রা.) এর কাছ থেকে তাঁর পুত্র কেনানা হাদিস বর্ণনা করেন। হোনায়ন যুদ্ধের গণিমত (যুদ্ধলব্ধ মাল) বণ্টন কালে রসূলুল্লাহ (সা.) আব্বাস ইবনে মেরদাসকে ‘মোওয়াল্লেফাতুল কুলুব’ হিসেবে একটা অংশ প্রদান করেন। উল্লেখ্য হুজুর (সা.) তাকে চল্লিশটি উট দিয়েছিলেন। এতে তিনি খুবই রাগান্বিত হন এবং একটি কাসীদায় তার ক্ষোভ প্রকাশ করেন। হুজুর (সা.) সাহাবিদেরকে বললেন: ‘যাও যেভাবে হোক, আমার পক্ষ হতে তার জবান কর্তন কর।’ সাহাবা গমন করেন এবং তার চাহিদা অনুযায়ী তাকে রাজি করেন। হুজুর (সা.) জবান কর্তন করার কথা বলেছিলেন। এর অর্থ ছিল, তাকে রাজি করানো। (অর্থাৎ ইসলাম গ্রহণের প্রতি আকৃষ্ট ও উৎসাহিত করা)
আব্বাস ইবনে মেরদাসের বর্ণনা অনুযায়ী মৃত্যুর সময় আমার পিতা ওসিয়ত করেছিলেন, ‘যিমার’ ভূত সর্ম্পকে। পিতার মৃত্যুর পর ভ‚তটি আমি ঘরে রেখে দেই এবং তার পূজা করতে থাকি। যখন হুজুর (সা.) এর আবির্ভাব হয় তখন সে ভূতের পেট হতে আওয়াজ শুনা যায়। অপর বর্ণনা অনুযায়ী, আমি একদিন একটি খেজুর গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ছিলাম, তখন একটি সাদা উট পাখির ওপর সোওয়ার, পোশাক পরিহিত অচেনা ব্যক্তি আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। সে বলল, ‘আব্বাস! তুমি কি দেখছ না, আসমানে পাহারা নিয়োগ করা হয়েছে।’ জি¦নরা বিচলিত হয়ে পড়ে। ঘোড়াগুলো ওদের সোয়ার নামিয়ে দিয়েছে এবং যে বরকতময় সত্ত্বা সোমবারে বা মঙ্গলবার রাতে নেকি ও তাকওয়ার সাথে জন্ম গ্রহণ করেছেন, তা ‘কুছওয়া’ নামে উটনির মালিক। আমি এসব কথা শুনে খুব ভীত ও বিচলিত হয়ে পড়ি। আমি গৃহ হতে বের হই। ‘যি যিমার’ নামক স্থানে আমাদের একটি ভূত ছিল, আমি তার পূজারী ছিলাম। আমরা তার ভেতর থেকে বিভিন্ন আওয়াজ শুনতাম। আমি যিমার ভূতের কাছে গমন করি, তার আশে পাশে ঝাড়ু দেই, তাকে হাত লাগিয়ে চুম্বন করি। তখন তার ভেতর থেকে আওয়াজ আসে,
‘কুল লিল কাবায়িলি মিনসুলাইমিন কুল্লেহা
হালাকায যিমারু অ-ফাজা আহলুল মাসজিদি।’
বনু সুলায়মের সকল গোত্রকে বলে দাও, যিমার নামক ভূত ধ্বংস হয়ে গেছে এবং মসজিদবাসীরা (ইসলাম) কামিয়াব হয়েছে।
‘হালাকায যিমারু অ-কানা ইউবাদু মাররাতান
কাবলাল কিতাবে ইলান নবীয়্যী মোহাম্মাদি।’
অর্থাৎ- যিমার ধংস হয়েছে, হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর প্রতি কিতার নাযিল হওয়া পর্যন্ত যার পূজা হতো।
‘ইন্নাল্লাজি ওয়ারাসান নব্যুয়তা ওয়াল হুদা
বাদা ইবনে মারয়েমা মীন কুরাইশিন মোহতাদী।’
হজরত ঈসা ইবনে মারয়ামের পর নবুওয়াত ও হেদায়েতের উত্তরাধিকারী এই সত্ত্বার নিকট স্থানান্তরিত হয়েছে। যিনি হেদায়েতের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং কোরাইশ গোত্রের।
হজরত আব্বাস ইবনে মেরদাস (রা.) বলেন যে, ‘আমি ভ‚তের ভেতর থেকে আগত আওয়াজে ভীত হয়ে পড়ি। সেখান থেকে বের হয়ে নিজের কওমের নিকট আসি, তাদেরকে ঘটনা অবহিত করি এবং সম্প্রদায়ের তিনশ লোককে সঙ্গে নিয়ে রসূলুল্লাহ (সা.) এর খেদমতে মদীনায় হাজির হই। তিনি আমাকে দেখে বলেন: ‘আব্বাস তুমি কীভাবে মুসলমান হলে?’ আমি নিজের ঘটনা বর্ণনা করি। তখন তিনি বললেন: ‘হ্যাঁ, সত্য বলেছ।’ অতঃপর আমি ও আমার গোত্রের সবাই মুসলমান হয়ে যাই। ভূতের পেটের আওয়াজ ও উট পাখি সোওয়ার জি¦ন ছিল, রসূলুল্লাহ (সা.)ও তা সত্য বলে মন্তব্য করেন।
অপর একটি বর্ণনা অনুযায়ী আব্বাস (রা.) বলেন, আমি এ ঘটনা গোপন রাখি, কারো কাছে প্রকাশ করিনি। যখন লোকেরা আহজাব (খন্দক) যুদ্ধ হতে প্রত্যাবর্তন করে, তখন আমি ‘আকীক’ নামক স্থানে একটি গর্জন শুনি। মাথা উঠিয়ে দেখি, উট পাখি সোওয়ার এক লোক এসে বলতে লাগল, আরবি বাক্যে নূরের আত্মপ্রকাশের দ্বীনের কথা বলা হয়। এ সময় উত্তর দিক থেকে গায়েবি আওয়াজ আসে, সুসংবাদ দাও জি¦নকে এবং তাদের হতাশ লোকদেরকে যে, সোওয়ারী তার ‘হাওদা’ রেখে দিয়েছে এবং আসমান তার রক্ষকদের প্রকাশ করে দিয়েছে।
আব্বাস (রা.) বলেন, ‘আমি এ কথা শুনা মাত্র ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে লাফিয়ে পড়ি এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস হয় যে, বাস্তবিকই মোহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রসূল।’ জ্বীনের এ গায়েবি বাক্য শুনে আব্বাস ইবনে মেরদাস ইসলাম গ্রহণ করে তার জীবনকে ধন্য করেন। আরবিতে জ্বিনের যে বাক্যগুলো উদ্ধৃত হয়েছে সেগুলোকে উচ্চাঙ্গের সাহিত্যের অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়। এতে প্রমাণিত হয় যে, জ্বিনদের মধ্যেও মানুষের মতো বড় ও উঁচু মানের সাহিত্যিক রয়েছেন। তাদের কণ্ঠে মহানবী (সা.) এর আবির্ভাবের বার্তা শুনে অনেক মানুষ মুসলমান হন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।