Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

হাজার হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠন ও পাচারের আংশিক কাহিনী

মোবায়েদুর রহমান | প্রকাশের সময় : ৫ জানুয়ারি, ২০২১, ১২:০৩ এএম

আজ থেকে অর্ধ শতাব্দী আগেও অর্থাৎ ৫০ বছর আগেও যদি শুনতাম যে, অমুক লোকটি লক্ষ টাকার মালিক তাহলে চক্ষু হতো চড়কগাছ! বগুড়া জেলায় একজন ডাক্তার ছিলেন। লোকে বলতো, তিনি টাকার কুমির। আমরা প্রশ্ন করতাম, টাকার কুমির মানে তিনি কত টাকার মালিক? যখন বলা হতো যে, উনি লক্ষ টাকার মালিক। শুনে চোখ কপালে উঠতো। এরমধ্যে এসে গেল এক সিনেমা। নাম ‘লাখপতি কা পেয়ার’। লাখপতিরা কেমন প্রেম করেন সেটি জানার এবং বোঝার জন্য সেই সিনেমা দেখে ফেললাম। তখন এই বাংলাদেশে একজন খুব ধনী ব্যক্তি ছিলেন। শুনতাম, তিনি নাকি কোটিপতি। নাম জহুরুল ইসলাম। তাঁর কোম্পানীর নাম ছিল সম্ভবত বেঙ্গল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন। তাঁর আরেকটি কোম্পানী হলো নাভানা গ্রুপ। যখন শুনতাম যে তিনি কোটিপতি, তখন রীতিমত ভিরমী খাওয়ার জোগাড়। ১০০ লাখে এক কোটি! সোজা কথা?

আর এখন? কোটি টাকা তো হাতের ময়লা। এক দুই কোটি নয়, শত কোটি টাকার মালিকের ছড়াছড়ি। রাম-শ্যাম-যদু-মধুরাও এখন শত কোটি টাকার মালিক। বাংলাদেশের পত্রপত্রিকার শিরোনাম, ড্রাইভার থেকে কোটিপতি! এমন নয় যে, ঐ ড্রাইভার ব্যবসা করে কোটিপতি হয়েছে। সে ড্রাইভারই রয়ে গেছে। কিন্তু তারপরেও কোটিপতি। কিভাবে সম্ভব? ছোটকালে দেখতাম ফুটপাতে ভেল্কিবাজি খেলা। লাগ ভেল্কি লাগ চোখে মুখে লাগ। যখন পত্রিকায় দেখি যে, একজন স্বল্প পরিচিত ব্যক্তি ৩ হাজার ৫ শত কোটি টাকা বিদেশে পাচার করছে, তখন মনে হয়, এগুলো তখনই সম্ভব যখন আলিবাবা এসে সঙ্কেত দেয়, ‘খুল যা সিম সিম’। তারপর লুণ্ঠিত মালামাল রেখে বেরিয়ে এসে বলে, ‘বন্ধ হো যা সিম সিম।’ তবে বাস্তবে কিন্তু একটি কোম্পানীর সন্ধান পাওয়া গেছে। নাম আলিবাবা। মালিক জ্যাক্ মা। চীনের শ্রেষ্ঠ ধনকুবের। তবে ফোর্বস ম্যাগাজিনের সর্বশেষ সংখ্যার মতে, চীনের শীর্ষ ধনীর তালিকায় আলিবাবার মালিক জ্যাক্ মা একধাপ নীচে নেমে গেছেন।

ওপরে যে গৌরচন্দ্রিকা দিলাম সেটি একটি ইংরেজী পত্রিকায় প্রকাশিত প্রথম পৃষ্ঠার একটি শিরোনাম দেখে। গত ১৮ ডিসেম্বর প্রকাশিত খবরটির শিরোনামের বাংলা অনুবাদ, ‘টাকা পাচার / ওরা কারা? / ওরা কোথায়? / যারা বিদেশে বাড়ি কিনেছে তাদের সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য দেওয়ার জন্য সরকার ও দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রতি হাইকোর্টের নির্দেশ’। খবরে বলা হয়, কানাডা, সিঙ্গাপুর এবং মালয়েশিয়াসহ বিদেশী রাষ্ট্রে যেসব বাংলাদেশী নাগরিক টাকা পাচার করে বাড়ি কিনেছেন, সুনির্দিষ্টভাবে তাদের নাম এবং ঠিকানা হাইকোর্টকে জানাতে বলা হয়েছে। হাইকোর্ট আরও জানতে চেয়েছেন যে, তাদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে এসব তথ্য দেওয়ার জন্য সরকার ও দুদককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

দুই
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, গত ২২ অক্টোবর হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিতভাবে (স্যুয়োমোটো) এ সম্পর্কে একটি রুল জারী করেন। দুদকের তরফ থেকে জানানো হয় যে, ইতোমধ্যেই ক্যাসিনো কান্ডের রথী মহারথী, যথা সেলিম প্রধান, ইসমাইল হোসেন সম্রাট এবং খালেদ মাহমুদসহ ১০০ ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। দুদকের আইনজীবি আরো জানান যে, বিএনপির প্রাক্তন মন্ত্রী বৃন্দ, যথা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মোরশেদ খান, মোসাদ্দেক আলী ফালু, গিয়াসউদ্দিন আল মামুন প্রমুখের বিরুদ্ধে আইনী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে (ডেইলি স্টার, ২২/১২/২০২০)। আরো রয়েছে তারেক রহমান এবং ক্যাসিনো মোমিনুল হকের নাম (দৈনিক যুগান্তর, ১৮/১২/২০২০)।

অপর একটি নির্দেশে হাইকোর্ট সেই সব ব্যক্তির একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা চেয়েছে, যাদের দ্বৈত পাসপোর্ট এবং দ্বৈত নাগরিকত্ব রয়েছে, যারা বিদেশে টাকা পাচার করছে এবং বিদেশে পাচারকৃত টাকা দিয়ে গাড়ি বাড়ি কিনেছে। এই পূর্ণাঙ্গ তালিকা ২৮ ফেব্রুয়ারী হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের কাছে দাখিল করার জন্য পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের ইমিগ্রেশন শাখাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ঢাকার হযরত শাহ্জালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর, চট্টগ্রাম শাহ্পরান আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর এবং সিলেট এম এ জি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের রেকর্ড থেকে তথ্য সংগ্রহ করে হাইকোর্টকে দেওয়ার জন্য এসবির ইমিগ্রেশন শাখার প্রধানকে নিদের্শ দেওয়া হয়েছে। হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, যাদের দ্বৈত নাগরিকত্ব এবং দ্বৈত পাসপোর্ট রয়েছে তারা বিদেশে যাওয়া আসার জন্য এই তিনটি আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর ব্যবহার করে। তাই এসব বিমান বন্দরে টাকা পাচারকারীদের যাতায়াতের রেকর্ড অবশ্যই আছে।

এ প্রসঙ্গে একটা কথা না বললেই নয়। বেশ কিছুদিন হলো দেখছি, কোনো একটি খবর সম্পূর্ণ পেতে হলে, অর্থাৎ কমপ্লিট নিউজ পেতে হলে একটি মাত্র পত্রিকা পড়ে সেটি পাওয়া যায় না। কোনো পত্রিকা সংবাদটির প্রথমাংশ দেয়, কেউ মাঝের অংশ, আবার কেউ বা শেষের অংশ। সে জন্য সম্পূর্ণ নিউজ পেতে গেলে ৫/৬ টি পত্রিকা পড়তে হয়। উদাহরণ হিসাবে হাইকোর্টের এই নিউজটার কথা বলতে পারি। ওপরে যা লিখলাম, তারপর ‘যুগান্তর’ পত্রিকা পড়লাম। দেখলাম, সেখানে মানি লন্ডারিং এর ব্যাপারে হাইকোর্টের তীব্র অসন্তোষের কথা বলা হয়েছে। ১৮ ডিসেম্বর যুগান্তরের প্রধান সংবাদের শিরোনাম, ‘মানি লন্ডারিং এর অপর্যাপ্ত তথ্য / হাইকোর্টের তীব্র অসন্তোষ।’ সংবাদের এক স্থানে বলা হয়েছে, ‘বিদেশে অর্থ পাচারের বিষয়ে দুদক, সিআইডি, বিএফআইইউডি এবং এনবিআরের তথ্য পর্যাপ্ত নয় বলে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট। সংস্থাগুলো সম্পূর্ণ তথ্য দিতে পারেনি। শতাধিক ব্যক্তির নামে প্রায় ২৫ কোটি টাকা মানি লন্ডারিং এর তথ্য দেয় দুদক। এতে সন্তুষ্ট হননি আদালত।’

মাননীয় হাইকোর্ট আরো বলেন, ‘২২ অক্টোবর যে তথ্য আপনারা দিয়েছিলেন, তারপরে আর কোনো আপডেট নাই। সম্রাট তো কারাগারেই আছেন। নতুন নাম বলুন। হাজার কোটি টাকা পাচার হলেও দুদক মাত্র ৪১ কোটি টাকা আদায় করতে পেরেছে।’ আমরা অর্থ পাচারকারীদের নাম ঠিকানা জানতে চাই। দুদকের রিপোর্টে ২২ জনের নাম টাকা পাচারকারী হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। দুদকের রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, প্রায় ১০০ ব্যক্তি ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পাচার করেছেন।
তিন

দুদকের এই তথ্য মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। ২০১৬ থেকে ২০২০ পর্যন্ত তারা মাত্র আড়াই হাজার কোটি টাকার হদিস পেয়েছে। তাদের কাছে কি গ্লােবাল ফিনান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি ওয়াশিংটনের রিপোর্ট নাই? তাদের কাছে কি পানামা পের্পাস নাই? মাত্র এক ব্যক্তি অর্থাৎ পিকে হালদারই তো বিদেশে পাচার করেছেন সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। আরো টাকা পাঠিয়েছেন তার ৭০/৮০ জন গার্লফ্রেন্ডের মাধ্যমে। ২০১২ সাল থেকে শুরু করে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়ের পেপার ক্লিপিং বিশ্লেষণ করলে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার দুর্নীতি, লুণ্ঠন এবং টাকা পাচারের হিসাব পাওয়া যাবে। এই যে লক্ষ কোটি টাকা লুটপাট, এগুলো কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী নয়? এসব ব্যাপারে দুদক সোচ্চার নয় কেন?

শহীদ ইসলাম পাপুল, তদীয় স্ত্রী সেলিনা ইসলাম এবং তাদের দুই পুত্র- এই ৪ জনের নামে ৬১৩ টি ব্যাংক এ্যাকাউন্ট- এগুলো রূপকথাকেও হার মানায়। কুমিল্লা এবং সিলেটে তাদের ৩০ একর জমি। অর্থাৎ ৯০ বিঘা জমি। এছাড়া গুলশানে একটি ফ্ল্যাটের সন্ধান পাওয়া গেছে। ‘দৈনিক ইনকিলাবের’ সম্মানিত পাঠক পাঠিকা ভাই-বোনেরা, আমি গভীর দুঃখের সাথে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের সাধের প্রিয় বাংলাদেশ যেন এক শ্রেণীর লুটেরার বেপরোয়া লুণ্ঠনের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। তাই যদি না হবে তাহলে ফারমার্স ব্যাংকের (বর্তমান পদ্মা ব্যাংক) একজন সিনিয়র অফিসার বাবুল চিশতি কিভাবে ১০০০ কোটি (এক হাজার কোটি) টাকার সম্পদ বানান? পত্রিকান্তরের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ব্যাংকে থাকাকালে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। এত টাকার সম্পদ তো এক জনের নামে রাখা যায় না। তাই এই সম্পদ বাবুলের স্ত্রী রোজি চিশতি, ছেলে রাশেদুল হক চিশতি, মেয়ে রিমি চিশতি, পুত্রবধু ফারহানা আহমেদ, শালা মোস্তফা কামাল প্রমুখের নামে করা হয়েছে।

এক দিনে বা এক কিস্তিতে এই ভয়ঙ্কর দুর্নীতি, লুণ্ঠন এবং টাকা পাচারের অবিশ্বাস্য কাহিনী শেষ হবে না। আমি এই দস্যুবৃত্তির নাম দিয়েছি ‘পাতাল অর্থনীতি’। পাতাল অর্থনীতির টাকা শুধুমাত্র কানাডা, মালয়েশিয়াতেই যাচ্ছে না। বাংলাদেশ ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এবং দুদকের রিপোর্ট মোতাবেক অন্তত: ১০ টি দেশে পাতাল অর্থনীতির টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। এই ১০ টি দেশ হলো, থাইল্যান্ড, হংকং, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, আরব আমিরাত, সুইজারল্যান্ড, আমেরিকা, বৃটেন, কানাডা ও মালয়েশিয়া।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পাচার-কাহিনী
আরও পড়ুন