পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিজহাতে গড়া ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। সংগঠনটির দীর্ঘ পথচলায় রয়েছে দেশ ও জাতির জন্য গৌরবময় অসংখ্য অর্জন। সমৃদ্ধ সেসব অর্জন জাতিকে দিয়েছে নতুন পথের ঠিকানা। স্বাধীনতা প্রাপ্তিতে সংগঠনটির অবদান ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল হয়ে আছে। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন সময়ের দাবি ও প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার দাবিতেই মূলত সাংগঠনিক প্রয়োজনীয়তা ও সংঘবদ্ধভাবে সফল আন্দোলন করার লক্ষ্যেই তিনি ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে ছাত্রলীগের সরব উপস্থিতি এবং সরকারের প্রতি চাপসৃষ্টি করে দাবি আদায়ে তার ভূমিকা জাতির পিতা তাঁর লেখনীতে তুলে ধরেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন ‘আওয়ামী লীগ গড়ে ওঠার পূর্ব পর্যন্ত একমাত্র ছাত্রলীগই সরকারের অত্যাচার-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করত এবং জনগণ ও ছাত্রদের দাবি দাওয়া তুলে ধরতো। ছাত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে তাদের নেতা ও কর্মীদের অনেক অসুবিধা ভোগ করতে হয়েছে। মুসলিম লীগ সরকার ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠানকে খতম করার জন্য চেষ্টার ত্রুটি করে নাই’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী পৃষ্ঠা: ২৩৬)।
বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন সময়ে কোনো কাজ করতে চাইলে অধিকাংশ সময় ছাত্রলীগকে দিয়ে শুরু করতেন। বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকাকালীন ছাত্রনেতাদের চিঠি লিখে আন্দোলনের গতিকে বেগবান করতে দিক নির্দেশনা দিতেন। বলা যায়, ছাত্রদের রাজনৈতিক সক্রিয়তা এবং তাদের সংগঠিত করার প্লাটফর্ম হিসেবে তিনি ছাত্রলীগকে প্রাধান্য দিতেন।
দেশের বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিপুল অবদান রয়েছে এই সংগঠনের। পরবর্তীতে ১৯৯০ সালের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, তথাকথিত ১/১১ সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন ইত্যাদিতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে।
স্বৈরশাসক মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতিতে অস্ত্রের প্রবর্তন করেন। তিনি ছাত্রদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে এ দেশের মেধাবী শ্রেণীকে বিপথগামী করে তোলেন। সেখান থেকে ছাত্রবান্ধব নেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৪ সালে ২৮ ডিসেম্বর মতিঝিল শাপলা চত্বরে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের পুনর্মিলনীতে তৎকালীন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি এ কে এম এনামুল হক শামীম এবং সাধারণ সম্পাদক ইসহাক আলী খান পান্নার হাতে বই, খাতা ও কলম তুলে দিয়ে আবারো ইতিবাচক ধারায় ছাত্র সমাজকে ছাত্রলীগের পতাকাতলে নিয়ে আসেন। ছাত্ররাজনীতিতে বলা যায়, এক নবযুগের সূচনা এবং মেধাবী ধারা প্রবর্তন করেন দেশরত্ন শেখ হাসিনা। জননেত্রী শেখ হাসিনার ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সময় দিক নির্দেশনা ও উপদেশ দিয়ে থাকেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘শুধু ভালো কর্মী হলে চলবে না, ভালো ছাত্র হতে হবে’, যা প্রমাণ করে ছাত্রলীগকে ইতিবাচক এবং মেধাবী রাজনীতির পথ দেখিয়েছেন তিনি। অস্ত্র নয়, কলমের শক্তির প্রতি তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন সবসময়।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বক্তৃতায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগের অবদানের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাস ছাত্রলীগের ইতিহাস’, ‘দেশ গড়ার জন্য সোনার ছেলে চাই, সেই সোনার ছেলে গড়ার কারিগর ছাত্রলীগ’।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নাম। জেল-জুলুম আর অত্যাচার-নির্যাতনে তাঁর জীবন ছিল জর্জরিত। যার যৌবনের ১৩টি বছর কেটেছে পাকিস্তানের কারাগারে। ১৯৬৯ সালে ২১ দফা আন্দোলনের ভিত্তিতে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ২২ ফেব্রুয়ারি জেল থেকে মুক্তি পান তিনি। ২৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন ছাত্রলীগের সভাপতি তোফায়েল আহমেদ জাতির পক্ষ থেকে বক্তৃতার করে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেন। বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের সাথে তাই ছাত্রলীগ ওতপ্রোতভাবে জড়িত, এটি চিরন্তন সত্য।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজের প্রচেষ্টায় ছাত্রলীগকে ছাত্রদের মাঝে একটি জনপ্রিয় সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, ঠিক তেমনিভাবে তারই সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাও বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের ছাত্রসমজের কাছে একটি জনপ্রিয় সাংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগকে প্রতিষ্ঠিত করে তুলেছেন। বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতির ইতিবাচক ধারণা বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে এসেছে। ছাত্ররাই ছাত্র রাজনীতির নেতৃত্ব দেবে, এই উপলব্ধি থেকেই জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতৃত্বে আসার বয়স সীমা ২৭ বছর নির্ধারণ করে দেন, যা সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য ও প্রশংসিত হয়েছে। বর্তমান সময়ে জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ছাত্র সমাজের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছাত্র সংগঠন। শেখ হাসিনার নির্দেশনায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ পরিচালিত হয়ে থাকে। ২০০১ সালের ১৭ মে পল্টন ময়দানে ছাত্র সংবর্ধনায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তৎকালীন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি বাহাদুর বেপারী ও সাধারণ সম্পাদক অজয় কর খোকন ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে ‘দেশরত্ন’ উপাধিতে ভূষিত করেন। এটি প্রমাণ করে ছাত্রলীগ সময়ের প্রয়োজনে তার অভিভাবকে মূল্যায়ন করতে ভুলে যায়নি।
ইতিহাস বলে প্রয়োজনে দেশের যেকোন সংকটকালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ তার সর্বোচ্চ দিয়ে দেশমাতৃকাকে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে এসেছে। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিল অনবদ্য। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের অপশাসনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে ছাত্রদল ও শিবিরের অস্ত্রের ঝনঝনানিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছিল। তখন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ অছাত্রদের সংগঠন ছাত্রদল ও রগকাটাবাহিনী ছাত্রশিবিরকে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয় আনে। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনাসমর্থিত তত্ত¡াবধায়ক সরকার অবৈধভাবে সরকার গঠন করে, সেই অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিল।এ সময় বাংলাদেশ ছাত্রলীগের অসংখ্য নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়। জেল-জুলুম, হুলিয়া দিয়ে ছাত্রলীগের অসংখ্য নেতাকর্মীকে হয়রানি করা হয়। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ১৪ জানুয়ারি ২০০৭ সালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী রোটনকে বিনা কারণে গ্রেফতার করে কারাগারে অন্তরীণ করে রাখে। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছ থেকে গণতান্ত্রিক ধারায় দেশকে ফিরিয়ে আনার জন্য ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ছাত্রদের তীব্র আন্দোলনের মুখে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদককে সরকার মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
২৭ জুলাই ২০০৭ দিনটি ছিল বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের জন্য এক কালো দিন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য বাংলা ও বাঙালির প্রিয় নেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে সুধাসদন থেকে যৌথবাহিনী দ্বারা গ্রেপ্তার করে। নেত্রীর মুক্তির দাবি করে সর্বপ্রথম বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মিছিল ও সমাবেশ করে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে মিছিল বের করে কোর্টের সামনের রাস্তা অবরোধ করে। সেদিনের মিছিল আলোড়ন সৃষ্টি ও শাসকগোষ্ঠীর মাঝে ভীতির সঞ্চার করতে সক্ষম হয়। বাংলার গণতান্ত্রিকামী মানুষের প্রবল চাপে ও আন্দোলনের মুখে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় ফখরুদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার, যার অবদান নিশ্চয় ছাত্রলীগকে দিতে হয়।এছাড়া সে সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে নিরপেক্ষতা নিশ্চিতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
২০১৪ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের পরামর্শে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি এইচ এম বদিউজ্জামান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম সারাদেশে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘সেভ ক্যাম্পাস ক্লিন ক্যাম্পাস’ কর্মসূচি ঘোষণা করে। ‘সেভ ক্যাম্পাস ক্লিন ক্যম্পাস’ কর্মসূচির মাধ্যমে ছাত্রলীগকে ইতিবাচক কর্মসূচিতে যুক্ত করেন সজিব ওয়াজেদ জয়, যা নতুন করে ছাত্রসমাজ ও সাধারণ মানুষের মাঝে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। সে ধারাবাহিকতায় বর্তমান বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য ছাত্রলীগকে নিয়েছেন সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায়। বিশেষ করে, বৈশ্বিক এই করোনাকালীন সময়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের অসংখ্য নেতাকর্মী হ্যান্ডসেনিটাইজার তৈরি করে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। কর্মহীন ও অসহায় হয়ে পড়া দিনমজুর, খেটে খাওয়া মানুষের মাঝে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দিয়েছে। শুধুমাত্র ত্রাণ কার্যক্রমে সীমাবদ্ধ নয়, করোনায় মৃতদের লাশ দাফনের মতো মহান কাজ করেছে ছাত্রলীগ। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের এমন মানবিক আচরণ সর্বমহলে প্রশংসা কুড়িয়েছে। ইতিহাস ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক বাংলাদেশ ছাত্রলীগের গৌরবময় ৭৩তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে ছাত্রলীগের শুভাকাক্সক্ষী এবং অসংখ্য নেতাকর্মীদের প্রতি রইল সশ্রদ্ধ সালাম ও শুভেচ্ছা।
লেখক: বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।