পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বৈদেশিক কর্মসংস্থান বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান খাত। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করার লক্ষ্যে কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও কর্মী প্রেরণ বিষয়ে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশসমূহের সাথে সমঝোতা সৃষ্টি হয়। তারই ধারাবাহিকতায় সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহে বাংলাদেশি কর্মী গমন শুরু হয়। শ্রম-অভিবাসনের প্রবণতা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে এবং প্রবাসী বাংলাদেশী ও অভিবাসী কর্মীদের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ শ্রম-অভিবাসন ব্যবস্থাপনা, পরিচালনা ও কল্যাণ সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে সরকার ২০০১ সালে ‘প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়’ নামে একটি পৃথক মন্ত্রণালয় গঠন করে। এ মন্ত্রণালয় ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘বিএমইটি’, ১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ ওভারসীজ এমপ্লয়মেন্ট এন্ড সার্ভিসেস লিমিটিড (বোয়েসেল), ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘ওয়েজ আনার্স কল্যাণ তহবিল’ এবং অভিবাসী কর্মীদের কম সুদে জামানতবিহীন ঋণ প্রদানের লক্ষ্যে ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক’ এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সরকারি সংস্থাসমূহের কার্যক্রম তত্ত্বাবধান ও সমন্বয় করে।
অভিবাসী কর্মীদের অধিকারের সুরক্ষা আন্তর্জাতিক মহলে সর্বাধিক গুরুত্বপ্রাপ্ত একটি বিষয়। এমন প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশ ২০১১ সালে জাতিসংঘের ১৯৯০ সালের অভিবাসী কর্মীসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদ অনুসমর্থন করে। আন্তর্জাতিক সনদটির অনুসমর্থনের পর শ্রম অভিবাসন ব্যবস্থাপনা, অভিবাসী কর্মীর অধিকার ও সুরক্ষা এবং অভিবাসী কর্মী ও তাদের পরিবারের কল্যাণের বিষয়টি প্রাধান্য পায় এবং সে পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যমান আইন-বিধিমালা ও নীতিমালা পরিবর্তন ও সংশোধনের আবশ্যকতা ও বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়। বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, নিরাপদ ও ন্যায়সংগত শ্রম অভিবাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন, সকল অভিবাসী কর্মী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের অধিকার ও কল্যাণ নিশ্চিত এবং বাংলাদেশ কর্তৃক অনুসমর্থিত ওঈজগড এবং শ্রম ও মানবাধিকার বিষয়ক অন্যান্য সনদের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করার উদ্দেশ্যে ইতোমধ্যে Immigration Ordinance, ১৯৮২ রহিত করে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন, ২০১৩ প্রণয়ন করেছে। এছাড়াও নতুন গৃহীত আইন বাস্তবায়নে বিদ্যমান বিধিমালা পরিমার্জন ও নুতন বিধিমালা প্রণয়নের কাজ প্রায় সমাপ্তির পথে। নতুন গৃহীত আইনের সংগে সামঞ্জস্য রেখে বিদ্যমান নীতিমালা সংশোধনের বিষয়টিও তাই অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। ২০১৫ সালে জাতিসংঘে গৃহীত টৈকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় জাতীয় ও বৈশ্বিক উন্নয়নে অভিবাসনের গুরুত্ব ও ভূমিকার কথা তুলে ধরা হয়েছে এবং এর স্বীকৃতিস্বরূপ অভিবাসন সংক্রান্ত এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ইতোপূর্বে জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত এমডিজি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ করে। সে ধারাবাহিকতায় এসডিজি লক্ষ্যপূরণে বিদ্যমান কর্মকৌশল ও নীতিমালা পরিবর্তনের আবশ্যকতা দেখা দেয়। ৬ষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় শ্রম অভিবাসন খাত সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য, অভিবাসী কর্মীদের সুরক্ষা ও কল্যাণ নিশ্চিতে এবং দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।
সেবাখাতে বাণিজ্য এখন প্রতিষ্ঠিত এক বৈশ্বিক বিষয়। এখাতের প্রসারের কারণে বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সুযোগ অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অপরদিকে তৈমন দক্ষ শ্রমের চাহিদার কাঠামোগত পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জের মোকাবেলায় বাংলাদেশী অভিবাসী কর্মীদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতায় বৈচিত্র্য আনা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে নিজের স্বার্থ রক্ষায় বাংলাদেশকে অন্যান্য দেশের সাথে একযোগে কাজ করে যেতে হবে। নতুন বৈদেশিক কর্মসংস্থান নীতিতে সকল নাগরিকের স্বাধীনভাবে পেশা নির্বাচনের অধিকার রক্ষায় সরকারের দৃঢ় অঙ্গীকার এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় কর্তৃক সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গৃহীত বিভিন্ন উদ্যোগের ধারাবাহিকতা স্থান পায়।
সংবিধানের ১৯, ২০ ও ৪০ অনুচ্ছেদসমূহে প্রণীত বিধানাবলী অনুযায়ী মানব-সম্পদ উন্নয়ন, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ ও পেশা নির্বাচনের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ, এবং যোগ্যতা অনুসারে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়তা প্রদান রাষ্ট্রের দায়িত্ব। বর্তমান নীতির প্রধান লক্ষ্য হল নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ অভিবাসনের মাধ্যমে স্বনির্বাচিত বৈদেশিক কর্মসংস্থান উৎসাহিত ও নিশ্চিতকরণ। যা জাতীয় প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে, অভিবাসী কর্মী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি ও সার্বিক সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে এবং নারীর ক্ষমতায়নসহ বেকারত্ব ও দারিদ্র্য দূরীকরণে সহায়তা করবে। অভিবাসী কর্মীরা জাতীয় অর্থনীতিতে এবং তাঁদের পরিবারের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে যে অসামান্য অবদান রেখে চলেছে তার স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে তাঁদের জন্য একটি অধিকার-ভিত্তিক সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা প্রবর্তন করা এই নীতির অন্যতম লক্ষ্য। এই লক্ষ্যে সরকার ‘প্রবাসকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান নীতি ২০১৬’ এর মাধ্যমে এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টিতে অঙ্গীকার ব্যক্ত করছে, যা প্রত্যেক কর্মীর সম্মান ও মর্যাদাকে স্বীকৃতি দেয়, অভিবাসী কর্মীদের প্রতি সহনশীলতা, সহানুভূতি ও সম্মানবোধ জাগ্রত করে এবং দায়িত্বশীল ও সংশ্লিষ্ট সকলকে শোভন কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করতে উৎসাহ যোগায়।
অভিবাসী কর্মীরা, বিশেষ করে স্বল্প দক্ষ কর্মীরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিগ্রস্ত। অভিবাসী কর্মীরা স্বদেশ ও প্রবাসে শোষণ, নিপীড়ন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হন। এই বাস্তবতার নিরিখে রাষ্ট্র তাদের সুরক্ষা প্রদানে আইনি ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ অব্যাহত রৈখেছে। তবে এক্ষেত্রে আইনের যথাযথ প্রয়োগই হলো মূল চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশ হতে বহির্মুখী শ্রম অভিবাসন বৃদ্ধির অব্যাহত ধারার কারণে শ্রম অভিবাসন ব্যবস্থাপনার ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে। সম্প্রতি বর্হিগামী কর্মীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় অভিবাসী কর্মীদের শোষণ, নিপীড়ন ও তাদের নিয়োগ-চুক্তি লঙ্গনের ঘটনাও বৃদ্ধি পেয়েছে। সে বিবেচনায় বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি এবং অভিবাসীদের সুরক্ষা এ দুই লক্ষ্যের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করাই হবে ভবিষ্যত শ্রম অভিবাসন সংক্রান্ত নীতিমালা গ্রহণ ও কর্মসূচি পরিকল্পনা করার মূল চ্যালেঞ্জ।
বৈশ্বিক প্রেক্ষিত এবং বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সামাজিক উন্নয়নে অভিবাসনের অনন্য অবদানের যথাযথ মূল্যায়ন ও স্বীকৃতির জন্য শ্রম অভিবাসন বিষয়ক নীতি’কে সামগ্রিক অর্থনীতি কিংবা খাতভিত্তিক ও অন্যান্য সামাজিক ও শ্রম সংশ্লিষ্ট নীতিকাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করা একান্ত আবশ্যক। তবে জাতীয় পর্যায়ে দারিদ্রতা হ্রাস, সামাজিক ব্যয় হ্রাস, বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভ আহরণ, দেশের আমদানি-ক্ষমতা বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক ঘাটতি হ্রাস, দেশের বেকারত্বের হার হ্রাস এবং কৃষি-আবাসন-শিল্প ও যৌথ মালিকানা-ভিত্তিক ব্যবসা স্থাপনে শ্রম অভিবাসন ও রেমিটেন্সের ভূমিকা বিষয়ে আরো পদ্ধতিগত গবেষণা প্রয়োজন। প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্সের অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনায় এর প্রবাহকে নিয়মিত বা আইনানুগ প্রক্রিয়াভুক্ত রাখার স্বার্থে রেমিটেন্স প্রেরণকারীদের জন্য বিভিন্ন প্রণোদনামূলক সহায়তা ও সেবামূলক ব্যবস্থা প্রণয়নের প্রয়োজন রয়েছে। সুপরিকল্পিত বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে বিদেশ থেকে রেমিটেন্স প্রেরণের ব্যয়ও হ্রাস করা সম্ভব।
লেখক: সহকারী কর্মকর্তা, ক্যারিয়ার অ্যান্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।