পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আজ পয়লা জানুয়ারি, খ্রিস্টীয় ২০২১ সালের প্রথম দিন। আরো একটি বছরকে পেছনে ফেলে কালের গর্ভে আশ্রয় নিয়েছে ২০২০ সাল। নতুন বছরের প্রথম দিনে আমরা বিগত বছরের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, সাফল্য-ব্যর্থতার হিসাব মেলাতে চেষ্টা করি। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে অগ্রগতির পথে ধাবিত হওয়ার জন্য এটা অপরিহার্য। ২০২০ সালের হিসাব-নিকাশ ও মূল্যায়নে আমরা বলতে পারি, শতাব্দীর ইতিহাসে এই বছরটি একটি মাইলফলক বছর হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। করোনাভাইরাস মহামারির বছর হিসেবে পুরো মানব জাতি ও সভ্যতা এক বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়, যার প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বব্যাপী সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে গেছে। নিউইয়র্ক-লন্ডন-রোমের রাস্তায় কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের দুর্দশা, হাসপাতালের চিকিৎসক-নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের অসহায়ত্ব তথাকথিত উন্নয়ন-অগ্রগতির মানদন্ড ও দাবিকে সভ্যতার সামনে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। শিল্পোন্নত দেশগুলোই যেখানে করোনা পেন্ডেমিক মোকাবেলায় চরম ধাক্কা খেয়েছে, সেখানে আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলোতে পরিস্থিতি কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। বিগত বছরটির সামগ্রিক বিচারে সাফল্যের চেয়ে ব্যর্থতাই বেশি। করোনভাইরাস পেন্ডেমিকের সামাজিক-অর্থনৈতিক রাজনৈতিক প্রভাবে রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনের অন্যসব প্রত্যাশা এক অনির্বচনীয় অনিশ্চয়তায় ঢাকা পড়েছে। সংকট ও সমস্যা যত আকস্মিক ও কঠিন হোক না কেন, ব্যর্থতাকে সাফল্যের আলোয় উদ্ভাসিত করার জন্য নতুন বছরে আমাদের শক্তি ও সামর্থকে পূর্ণমাত্রায় নিয়োজিত করতে হবে। এটাই আমাদের অঙ্গীকার ও শপথ হওয়া উচিৎ। সন্দেহ নেই, জাতীয় জীবনে আমাদের অনেক স্বপ্ন-প্রত্যাশাই অনর্জিত রয়ে গেছে। নতুন নতুন সংকট-সমস্যার জন্ম হয়েছে। নতুন বছরে সেগুলো প্রলম্বিত হবে, স্বাভাবিক কারণেই। মানুষের কষ্ট-দুর্ভোগ বেড়েছে। অর্থনীতি বেহাল অবস্থায় পতিত হয়েছে। বিনিয়োগ-শিল্পায়ন-কর্মসংস্থান বাড়েনি। রফতানি আয়, জনশক্তি রফতানি, রাজস্ব আদায়- সবকিছুই কমেছে। ব্যাংকিং খাত রীতিমত বিপন্ন দশায় এসে উপনীত হয়েছে। দুর্নীতি-দুষ্কৃতি ও অর্থপাচার বেড়েছে। একই সঙ্গে নাগরিক নিরাপত্তা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। খুন, গুম, অপহরণ, ছিনতাই, রাজাহানি, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। বিরোধীদলের ওপর দমন-পীড়ন, হামলা-মামলার যে অবস্থা আগের বছরে ছিল তার তেমন কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর মানুষের আস্থা বাড়ার মতো কোনো রাজনৈতিক উদ্যোগও দেখা যায়নি। সুশাসনের অভাব ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি বিস্তৃত হয়েছে। হত্যা, ধর্ষণ ও অপমৃত্যুর ঘটনা পুরো সমাজকে বিচলিত-উদ্বিঘ্ন করেছে।
বিগত বছরটিতে আমাদের অর্থনীতিতে যেমন কাক্সিক্ষত পরিবর্তনের দেখা মেলেনি, একইভাবে রাজনীতিতেও কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন সূচিত হয়নি। রাজনীতিতে শূন্যতা, স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে সবদল এবং জনগণের অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক নির্বাচনী সংস্কৃতির অনুপস্থিতি প্রকটভাবে ধরা পড়েছে। তবে কোভিড-১৯ এর প্রতিক্রিয়া বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মহামন্দার মধ্যেও বাংলাদেশ তার রেমিটেন্স প্রবাহ এবং অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সক্ষম হয়েছে। করোনাভাইরাস মহামারির পরিবর্তিত বাস্তবতা সারাবিশ্বের মানুষকে রাতারাতি তাদের পুরনো অভ্যাস ও সংস্কৃতিকে বদলে ফেলার শিক্ষা দিয়েছে। সামাজিক দূরত্ব, ব্যক্তিগত ও সামগ্রিক হাইজিন বা পরিচ্ছন্নতা, রাস্তায়, গণপরিবহন, অফিস-আদালত ও সমাবেশে মাস্ক পরার বাধ্যবাধকতা মানুষের জন্য নতুন অভিজ্ঞতা। ইউরোপ-আমেরিকাজুড়ে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ও তৃতীয় ঢেউ আঘাত হানছে। কোথাও কোথাও নতুন আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার উদ্বেগজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। সেই সাথে বিশ্বের নানা প্রান্তে চলছে করোনার ভ্যাকসিনের ট্রায়াল ও বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাওয়ার তীব্র প্রতিযোগিতা। ইতিপূর্বে আর কোনো সময় বৈশ্বিক মহামারি ও ভাইরাসজনিত রোগের এমন দ্রুততম সময়ে ভ্যাকসিন উদ্ভাবন ও বাণিজ্যিক উৎপাদনের সফল হওয়ার নজির নেই। নতুন বছরে বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে গুরুতপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে, করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন প্রাপ্তির নিশ্চয়তা এবং এর সঠিক ম্যানেজমেন্ট। বছরজুড়ে সিদ্ধান্তহীনতা ও অস্বচ্ছতার কারণে বছরের শেষ প্রান্তে এসেও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভ্যাকসিন প্রাপ্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। তবে করোনা মহামারির লকডাউন ও সামাজিক দূরত্বের প্রেক্ষাপটে সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশেও ডিজিটাল ডিভাইস ও তথ্যপ্রযুক্তির উপর নির্ভরশীলতা বহুগুণ বেড়ে গেছে। সরকারের পরিকল্পিত ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপরেখা বাস্তবায়নের পথ এ সময়ে অনেক এগিয়ে গেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ই-কমার্স এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভরতা বিশ্বে মানুষের ভৌগোলিক দূরত্ব ঘুচিয়ে দিয়েছে। করোনা মহামারিতে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড অনেকটা স্থবির হয়ে পড়লেও পদ্মাসেতুসহ বেশকিছু মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে শেখ হাসিনার সরকার বিশাল সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলেছে। তবে বিনিয়োগ, বৈদেশিক কর্মসংস্থান, ব্যাংকিং সেক্টরের দুদর্শা লাঘবে কোনো কার্যকর উদ্যোগ বা অগ্রগতি দেখা যায়নি। মানুষের প্রত্যাশিত রাজনৈতিক সমঝোতা ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নয়নে সরকারের সদিচ্ছার প্রতিফলন খুবই ক্ষীণ। করোনাভাইরাস সামলাতে গিয়ে আমাদের স্বাস্থ্যসেবা খাতের দুর্বলতা ধরা পড়লেও সাফল্য কিন্তু মোটেই কম নয়, যার স্বীকৃতি পাওয়া গেছে আন্তর্জাতিকভাবে। এ থেকে স্বাস্থ্যসেবা খাতের উন্নয়ন, স্বচ্ছতা-জবাবদিহি নিশ্চিতকরণে সরকারের আন্তরিক প্রয়াস ও প্রতিশ্রুতি দেখা গেছে। নতুন বছরে দেশের মানুষ এ খাতের কাক্সিক্ষত উন্নয়ন প্রত্যাশা করে।
গত বছরের প্রথম দিকে শুরু হওয়া করোনাভাইরাস মহামারির সামাজিক-অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে ওঠা সহজে সম্ভব নয়। ইতোমধ্যেই ভ্যাকসিন নিয়ে আশাবাদী হওয়ায় বিশ্ব অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে, এমন স্বপ্নই দেখছেন বিশ্লেষকরা। ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসে নেতৃত্বশীল সংস্থা মরগান স্টেনলির বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অর্থনীতি পুরোদমে খুলে দেয়ার প্রেক্ষাপটে জিডিপির বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬.৪ শতাংশ। যা গত বছরের তুলনায় অনেক বড় উল্লম্ফন। আর এই প্রবৃদ্ধি সম্ভব হবে চীন, ব্রাজিল, বাংলাদেশের মতো দ্রুত অগ্রসরমান অর্থনীতির সক্রিয়তার উপর নির্ভর করে। এবার নতুন বছরের শুরুতে মানুষের প্রথম প্রত্যাশাই হচ্ছে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিনের প্রাপ্যতা এবং মহামারির মোকাবেলায় সরকারের কার্যকর উদ্যোগ। সেই সাথে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং সুশাসন ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নয়ন। দেশের মানুষ শান্তি চায়, নিরাপত্তা চায়, সব রকম গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অধিকার চায়। একই সঙ্গে চায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতি। কোনো বিশৃংখলা, সংঘাত-সহিংসতা তারা দেখতে চায় না। বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মান যেমনই হোক, সরকারের কাছে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রত্যাশিত উন্নয়নের কার্যকর রাজনৈতিক পদক্ষেপ দেখতে চায় দেশের মানুষ। তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অভিজ্ঞতা, কর্মদক্ষতা ও রাজনৈতিক কমিটমেন্টের প্রতি দেশের মানুষের প্রত্যাশা আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। বিশেষত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নয়ন ও আইনের শাসন নিশ্চিত করতে দেশের মানুষ তাঁর সদিচ্ছার প্রতিফলন দেখতে চায়। বিগত বছর অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু নির্বাচন জনগণের একান্ত প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ পরবর্তীতে অনুষ্ঠিত কোনো নির্বাচনই গণপ্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। এমন নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি কেউ আর দেখতে চায় না। চলতি বছর করোনা ভ্যাকসিন প্রাপ্তি, তার ম্যানেজমেন্ট এবং রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উন্নয়ন অবশ্যই বড় চ্যালেঞ্জ। এছাড়া আগামী সংসদ নির্বাচনের ভিত্তিভূমি রচনার কাজটিও শুরু হবে এ বছর। পরিশেষে, আগামী দিনগুলো সকলের জন্য শুভ, কল্যাণময় ও নিরাপদ হোক, এই কামনা করি। খ্রিস্টীয় নববর্ষের এই দিনে আমরা পাঠক ও শুভানুধ্যায়ীসহ দেশের সর্বস্তরের মানুষকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।