Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ঢাকাকে বাসযোগ্য করে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে

রিন্টু আনোয়ার | প্রকাশের সময় : ৩১ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:০২ এএম

ঢাকাকে বলা হয় মেগাসিটি। সাধারণত যে শহরের লোকসংখ্যা এক কোটি ছাড়িয়ে যায়, সেই শহরকে মেগাসিটি বলা হয়। ঢাকার লোকসংখ্যা যেভাবে বাড়ছে, তাতে আগামী কয়েক বছরে এর জনসংখ্যা দুই কোটি ছাড়িয়ে যাবে। ডাবল মেগাসিটিতে পরিণত হবে। এই বিপুল সংখ্যক রাজধানীবাসীর ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা কীভাবে নিশ্চিত করা হবে, এ নিয়ে কোনো পরিকল্পনার কথা আমরা শুনিনা। পরিকল্পনা আছে কিনা, তাও জানি না। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, ঢাকায় যারা থাকেন এবং আসেন, তারা নিজেরাই নিজেদের বসবাসের জায়গা করে নেন। এতে পরিকল্পনার প্রয়োজন পড়ছে না। অথচ যে কোনো রাজধানী গড়ে তোলা হয় পরিকল্পিতভাবে। এজন্য কর্তৃপক্ষ আছে। যে কেউ চাইলেই ইচ্ছামতো ঘর-বাড়ি বা ছাপড়া তুলে বসবাস করতে পারে না। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ পরিকল্পিতভাবে সম্প্রসারণের কাজটি করে। ঢাকাকে দেখলে মনে হবে, এর সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। যে যেভাবে যেদিকে পারছে ঢাকাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এই সম্প্রসারণ কাজ করতে গিয়ে নগরীর প্রাকৃতিক যে বৈশিষ্ট্য থাকা অপরিহার্য, তা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ঢাকা পরিণত হচ্ছে ইট, কাঠ, পাথরের নগরীতে। বলা হয়, ঢাকার মতো প্রাকৃতিক সুষমামন্ডিত রাজধানী বিশ্বে খুব কম আছে। এটি এমন এক শহর, যার ভেতর দিয়ে এক সময় স্বচ্ছ প্রস্রবণ বহমান ছিল। জালের মতো খাল আর চতুর্দিকে নদী। ঘর-বাড়ি, অফিস-আদালতের পাশ দিয়ে স্বচ্ছ বারিধারা বয়ে যেত। এসব এখন কল্পনায় পরিণত হয়েছে। এই ঢাকায় একসময় ছোট-বড় প্রায় ৪২টি খাল ছিল। এ প্রজন্মের অনেকেই হয়তো তা জানে না। তারা কেবল শুনছে, এই সুউচ্চ ভবনটি যেখানে দাঁড়িয়ে আছে বা এই সড়কটি যেখান দিয়ে গিয়েছে, এসবই খালের উপর গড়ে উঠেছে। আজকের যে সুরম্য বসুন্ধরা সিটি মার্কেট, এ জায়গাটি ছিল বিশাল একটি ঝিল। এখন ঢাকা শহরে যেসব লেক দেখা যায়, এগুলো মূলত সেসব খাল বা নদীর ক্ষয়িষ্ণু অংশ মাত্র। এগুলো কৃত্রিমভাবে গড়ে তোলা হয়নি। প্রাকৃতিকভাবেই গড়ে উঠেছিল। শহরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষা ও বালু নদীতে গিয়ে মিশেছিল। দখলদারিত্বের কবলে পড়ে এগুলো এখন জলাভূমিতে পরিণত হয়েছে। বায়ু দূষণে ঢাকা বিশ্বের শীর্ষ নগরী। বায়ু দূষণের কারণে মানুষ এখন বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। মানুষকে শীষা, কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোঅক্সাইড মিশ্রিত বিষাক্ত বায়ু সেবন করে হৃদরোগ, শ্বাস কষ্ট, ডায়বেটিসসহ জীবন বিনাশক মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হতে হচ্ছে। এছাড়া পয়োনিষ্কাশন ও বর্জ্যব্যবস্থাপনার দুর্দশা পরিবেশকে বিষময় করে তুলেছে। এসব সমস্যা সমাধানে যেধরনের কর্তৃপক্ষ এবং তার সুষম পরিকল্পনা থাকা দরকার, তা ঢাকা শহরে নেই। যারা আছেন, তারা তাদের সক্ষমতার পরিচয় দিতে পারেননি। তাদের অজুহাতের শেষ নেই। সক্ষমতার অভাব এবং অজুহাত দিয়েই বছরের পর বছর তারা পার করে দিচ্ছে। সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলো যদি তাদের কাজটুকু যথাযথভাবে করত, তাহলেও অনেক সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হতো। বিশেষ করে দুই সিটি করপোরেশন, যাদের উপর ঢাকার অধিকাংশ সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব, তারা যদি একটু তৎপর ও পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করত, তবে ঢাকা যে দুরবস্থার দিকে ধাবিত, তার গতি কিছুটা হলেও টেনে ধরা যেত। একটি আধুনিক রাজধানীর কি সুযোগ-সুবিধা থাকে, তা নগরবাসীর অজানা। সমস্যাকে নিত্যসঙ্গী করেই তাদের বসবাস করতে হচ্ছে।

ঢাকার অসংখ্য সমস্যার মধ্যে যেটি প্রধান হয়ে উঠেছে, তা হচ্ছে যানজট। প্রতিমুহূর্তে এ সমস্যায় পড়ছে না, এমন মানুষ নেই। মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ কাজ করতে গিয়ে প্রধান প্রধান সড়ক এখন দখল হয়ে গেছে। এতে যানজটের ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। আবার এগুলো চালু হলেই যে যানজট কমে যাবে, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। কারণ, ঢাকার সড়কে যান চলাচলের কোনো সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনাই নেই। অদূর ভবিষ্যতে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে, এমন মনে করার কারণও দেখা যাচ্ছে না। যানজটে মানুষের কী পরিমাণ ক্ষতি হয়, তার হিসাব বিভিন্ন সংস্থা বিভিন্ন সময়ে দিয়েছে। বুয়েটের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, যানজটের কারণে বছরে ২২ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়, বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পিপিআরসি বলেছে ২০ হাজার কোটি টাকার কথা। সর্বশেষ জাতিসংঘের ইউএনডিপি এক গবেষণায় বলেছে, যানজটে বছরে ক্ষতি হয় ৩৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা। ইউএনডিপি এ হিসাবের মধ্যে দেখিয়েছে, যানজটের কারণে দৈনিক ৪০ লাখ কর্মঘন্টা নষ্ট হওয়ায় আর্থিক ক্ষতি হয় ৩০০ কোটি টাকা। এর সাথে যুক্ত হয়েছে যানবাহনের পুড়ে যাওয়া বাড়তি জ্বালানির মূল্য (যানজটে বাসে ৩ গুণ তেল পোড়ে) এবং নগরবাসীর স্বাস্থ্যহানির আর্থিক মূল্য। যানজটে বছরে যে ক্ষতি হয় তাতে দেখা যাচ্ছে, প্রতি বছর একটি করে পদ্মাসেতু নির্মাণ করেও অতিরিক্ত অর্থ উদ্বৃত্ত থেকে যাবে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, যানজটের ক্ষতি অর্ধেকে নামিয়ে আনা গেলে, চার বছরের মধ্যে ঘাটতি বিহীন একটি বাজেট ঘোষণা দেয়া সম্ভব হতো। যাই হোক, যানজটের ক্ষতির মাত্রা বলে শেষ করা যাবে না। এর ক্ষতি বহুমাত্রিক। যানজটে পড়ার ভয়ে কর্মজীবী মানুষ থেকে শুরু করে প্রত্যেকের স্বাভাবিক জীবন ও কর্মকান্ড প্রতিদিনই ব্যাহত হচ্ছে। ঢাকায় যারা বসবাস করেন, তারা জীবনযাত্রা পরিবর্তন করে এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। যানজটের কারণ মোটামুটি সবারই জানা। তবে পুলিশের পক্ষ থেকে ১৯টি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, ট্র্যাফিক আইন না মানা ও সঠিকভাবে প্রতিপালন না করা, যত্রতত্র কার পার্কিং এবং কার পার্কিংয়ের জায়গায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, যেখানে সেখানে গাড়ি থামিয়ে যাত্রী উঠানামা করা, রাস্তা ও ফুটপাথ দখল, ট্র্যাফিক পুলিশের যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাব ইত্যাদি। এর বাইরে মূল যে সমস্যা তা হচ্ছে, রাজধানীর রাস্তার তুলনায় অধিক সংখ্যক গাড়ি চলাচল। একটি আদর্শ শহরে ২৫ ভাগ সড়ক থাকে। এ তুলনায় ঢাকা শহরে রয়েছে মাত্র ৭ ভাগ। এই ৭ ভাগের মধ্যে কার্যকর রাস্তা হচ্ছে আড়াই ভাগ। এই রাস্তা দিয়ে সোয়া দুই লাখ গাড়ি চলাচল করতে পারলেও এখানে চলছে ৯ লাখের উপরে। তার উপর প্রতিদিন কয়েকশ’ গাড়ি রাস্তায় নামছে। নগরীতে লোকসংখ্যার অনুপাতে যে পরিমাণ গণপরিবহণ থাকার কথা তা একেবারেই নেই। অথচ যানজট সহনীয় পর্যায়ে রাখার জন্য এবং লোকজনের যাতায়াতে পর্যাপ্ত গণপরিবহণের বিকল্প নেই। সারা বিশ্বেই গণপরিবহণের উপর বেশি জোর দেয়া হয়। বাংলাদেশই কেবল ব্যতিক্রম। এক গবেষণায় দেখানো হয়েছে, নগরীতে ৬০ ভাগ মানুষ হেঁটে চলেন। রিকশায় চলেন ১৯ ভাগ। বাস ও অটোরিকশায় চলেন ১৬ ভাগ। আর প্রাইভেট কারে চড়েন মাত্র ৫ ভাগ। এসব গাড়ি রাস্তার উপর পার্কিং করার কারণেও যানজট সৃষ্টি করে চলেছে। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে যানজট কোনো দিনই কমবে না। ঢাকার যানজট কমাতে হলে প্রাইভেট কারের অনুমোদনের সংখ্যা কমাতে হবে। গণপিরবহনের সংখ্যা বাড়াতে হবে। একবার সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছিলেন, এক পরিবারের এক প্রাইভেট কার নীতির। এ ঘোষণা ঘোষণার বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। নীতিটি খুবই ভালো ছিল। বাস্তবায়ন করা গেলে যানজট কিছুটা হলেও সহনীয় পর্যায়ে আসত। সরকার যানজট কমাতে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ফ্লাইওভার নির্মাণ করেছে। অথচ যানজট কমেনি। বরং যানজট এখন নিচ থেকে উপরে উঠে গেছে। ফ্লাইওভারগুলোতে যানজট লেগে থাকে। তাহলে, হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে কি লাভ হলো?

ঢাকাকে বাসযোগ্য করার জন্য নগরবিদরা বহুদিন ধরেই বলছেন। তারা বহু পরামর্শ ও পরিকল্পনা দিয়েছেন। তাদের এ পরামর্শ কেবল শোনা যায়, শুনতে ভাল লাগে। তবে যাদের শোনার কথা এবং বাস্তবায়ন করার কথা, তারা শোনে না। যানজট নিরসন এবং সৌন্দর্য বর্ধনে এক ফুটপাত দখলমুক্ত করা নিয়ে কত কী ঘটে গেল, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। ফুটপাত দখলমুক্ত করা নিয়ে এক ধরনের ইঁদুর বেড়াল খেলা আমরা প্রায় সময়ই দেখি। ফুটপাত আর দখলমুক্ত হয় না। দখলকারীরা কত শক্তিশালী যে সিটি করপোরেশনও তাদের কাছে অসহায় হয়ে পড়ে। আমরা মনে করি, ঢাকাকে ভারমুক্ত এবং ঢাকাগামী মানুষের স্রোত ঠেকাতে বিচার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যাংকিং সেবাসহ প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। ঢাকাকে ভারমুক্ত এবং আধুনিকভাবে গড়ে তুলতে হলে সরকারকে বিকেন্দ্রীকরণের কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অন্যান্য বিভাগীয় শহর ও প্রধান প্রধান জেলা শহরগুলোতে ঢাকার মতো সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টির উদ্যোগ নিতে হবে যাতে মানুষ তার প্রয়োজনীয় কাজ সেখানেই সারতে পারে। এ ব্যবস্থা করা গেলে তাদের ঢাকামুখী হতে হবে না। এতে ঢাকার উপর থেকেও চাপ কমবে। এ ব্যবস্থা করা সরকারের সিদ্ধান্তের ব্যাপার। সরকার দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়ে অনেক কিছুই করেছে। ঢাকায় আর কোনো কলকারখানা স্থাপনের অনুমোদন দেয়া যাবে না। বিভিন্ন আঞ্চলিক শহলে শিল্পকারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ করতে হবে, যাতে ঢাকার বাইরে কর্মসংস্থান সৃর্ষ্টি হয় এবং জীবিকার সন্ধানে মানুষকে ঢাকামুখী না হতে হয়। এজন্য ব্যাপক পরিকল্পনা করতে হবে এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী দ্রুত কাজ শুরু করতে হবে। তা নাহলে, আমরা যে উন্নতি করছি, ঢাকার দুরবস্থা দেখে তা মনে করার কোনো কারণ থাকবে না।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মেগাসিটি
আরও পড়ুন