Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

৪২ বিশিষ্ট নাগরিকের বিবৃতি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ : অতঃপর কী?

মোবায়েদুর রহমান | প্রকাশের সময় : ২৯ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:০২ এএম

আমাদের দেশের পলিটিক্যাল কালচার নষ্ট এবং বিকৃত হয়ে গেছে। কেউ যদি রাজনীতি, প্রশাসন বা সমাজ সম্পর্কে কোনো ভালো বক্তব্যও দেন, তাহলে প্রথমে দেখা হয়, সেই বক্তব্য সরকারের পক্ষে গেছে নাকি বিপক্ষে গেছে। যদি সরকারের পক্ষে বা বিপক্ষে নাও হয়, কিন্তু কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত হয়, তাহলেও দেখা হবে, সেটি সরকারের পক্ষে যাচ্ছে, নাকি বিপক্ষে যাচ্ছে। যেগুলিকে ঠিক সরকারি না বলে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান বলা হয়, সেগুলির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। বক্তব্য যদি সঠিক হয় তাহলে বলা হবে, ওরা তো বিএনপি-জামায়াতের লোক। ওরা তো এসব কথা বলবেই। ক্ষেত্র বিশেষে বিএনপি-জামায়াতের লোক বলেই ক্ষান্ত হয় না, বরং এক ডিগ্রি ওপরে উঠে বলা হয়, ওরা তো বিএনপি-জামায়াতের ‘দালাল’। বিরোধী দলের ক্ষেত্রেও কম বেশি একই কথা প্রযোজ্য। তারা বলবে, ওরা আওয়ামী লীগের লোক। প্রায় ক্ষেত্রেই বক্তব্য বা বিবৃতিকে ব্রাকেটভুক্ত করে তার সারবত্তাকেই পচিয়ে ফেলা হয়। যদি সেই বক্তব্য বা বিবৃতিকে পচিয়ে আবর্জনাতুল্য করাই হয় উদ্দেশ্য, তাহলে বলা হবে, পাকিস্তানের দালাল, রাজাকার বা মৌলবাদী। আর বিরোধী দল বলবে ইন্ডিয়ার দালাল।

সচেতন পাঠক এবং জনগণ হয়তো লক্ষ করেছে যে, বিগত বেশ কয়েক বছর হলো, ‘ইন্ডিয়ার দালাল’ এই কথাটি খুব কম বলা হয়। যে দলটি এই কথাটি সবচেয়ে বেশি বলতো সেই বিএনপি এখন ভারত সম্পর্কে ঠোঁট সেলাই করেছে। কারণটি কী? কারণটি আর কিছুই নয়। কারণটি হলো, ক্ষমতায় যাওয়া অথবা ক্ষমতায় টিকে থাকা।

এই কথাটি এখন পলিটিক্যাল সার্কেলে ওপেন সিক্রেট যে, ইন্ডিয়াকে চটিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া যাবে না। আর ভোটে মেজরিটি পেয়ে যদি কোনো দল ক্ষমতায় যেতেও পারে, তাহলেও ইন্ডিয়াকে খোশ মেজাজে না রাখলে ক্ষমতায় টিকে থাকা যাবে না। এসব কোনো এক্সক্লুসিভ খবর নয়। এসব খবর বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। বলা হচ্ছে যে, বিএনপি ইন্ডিয়ার নেক নজরে নাই। তাই তাদের নেক নজর আকর্ষণ করার জন্য সাম্প্রতিক অতীতে একাধিকবার বিএনপি দিল্লিতে ‘দূত’ পাঠায়। দিল্লিতে যে লোক পাঠিয়েছিল সেই খবর তো পত্রপত্রিকায় এসেছিল। তিন সদস্য বিশিষ্ট বিএনপি টিমের নেতৃত্বে ছিলেন আমীর খসরু মাহ্মুদ চৌধুরী। আমীর খসরুর মিশনটি ব্যর্থ। হয়তো লবিংটি জোরদার ছিল না। অথবা নেপথ্যে আরো কিছু কথা আছে। কিন্তু নিট কথা হলো এই যে, ভারতের ক্ষমতার করিডোরে বিএনপি ‘ডেন্ট’ করতে পারেনি। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পূর্বাহ্নে ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং যে তাসটি খেলেছিলেন, সেই গেমের হারজিত যাই বলুন, এখনও তার রেশ বজায় আছে।

দুই
আমরা ফিরে যাচ্ছি আগের কথায়। কয়েক দিন আগে দেশের ৪২ জন বিশিষ্ট নাগরিক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ এনেছেন। এসব অভিযোগ ঐ ৪২ জন বিশিষ্ট নাগরিক প্রেসিডেন্টকে অ্যাড্রেস করে লিখেছেন। অভিযোগসমূহ তদন্ত করার জন্য তারা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করার জন্য প্রেসিডেন্টের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। তারা সরাসরি প্রেসিডেন্টের সাথে সরাসরি কথা বলার জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট চেয়েছেন। রবিবার সকালে যখন এই লেখাটি শুরু করি তখন পর্যন্ত ৪২ জন বিশিষ্ট নাগরিক প্রেসিডেন্টের অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেয়েছেন বলে শোনা যায়নি। অথবা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের কথাও মিডিয়াতে আসেনি। ঐ দিকে মাহবুব তালুকদার ছাড়া অন্যান্য সদস্যসহ সিইসি একটি সংবাদ সম্মেলন করে সবগুলো অভিযোগ নাকচ করেছেন।

৪২ জন নাগরিকের অভিযোগপত্রের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো এই যে, অতীতে যতগুলো নির্বাচন কমিশন এসেছে তার প্রায় সবগুলির বিরুদ্ধেই সরকারের প্রতি ‘জি হুজুর’ হওয়ার অভিযোগ এসেছে। সবগুলির বিরুদ্ধেই সরকারের পক্ষে নির্বাচনে কারচুপিকে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু কোনো কমিশনের বিরুদ্ধেই আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ ওঠেনি। অভিযোগে রয়েছে, নির্বাচনের নিয়মনীতির উপর বক্তৃতার নামে সিইসি এবং অন্যান্য সদস্য কয়েক কোটি টাকা নিয়েছেন। অপর অভিযোগ হলো, নির্বাচন কমিশন সদস্যরা দুটি করে সরকারি গাড়ি ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু নূরুল হুদা কমিশনের সদস্যরা ৩টি করে গাড়ি ব্যবহার করছেন। ইভিএম কেনাতেও দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। বলা হয়েছে, ভারতে ইভিএম যে দামে কেনা হয়েছে, বাংলাদেশে সেই ইভিএম ১১ গুণ বেশি দামে কেনা হয়েছে।

৪২ নাগরিকের এই অভিযোগপত্রের ব্যাপারে পরবর্তী করণীয় প্রেসিডেন্টের। তিনি অবশ্যই এই চিঠি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনা করেছেন, সেটি ধারণা করা যায়। দুই সপ্তাহ হয়ে গেলো। এর মধ্যে প্রেসিডেন্ট জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করেননি, অথবা ৪২ জনকে ইন্টারভিউও দেননি। তাই বলে কি তাদের অভিযোগপত্র উপেক্ষিত থেকে যাবে? আরো কিছু দিন অপেক্ষা করি। দেখা যাক, কী হয়।

প্রেসিডেন্ট কী করেন, সেটি দেখার জন্য না হয় আরো কিছুদিন অপেক্ষা করা যেতে পারে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট কী করবেন সেটি দেখার আগেই আওয়ামী লীগের এক শ্রেণির মন্ত্রী এবং নেতা যে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন সেটি স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক রীতিনীতি এবং শিষ্টাচারবিরুদ্ধ। যদি বলা হয় যে, তাদের বক্তব্য প্রেসিডেন্টকে প্রভাবিত করার একটি কৌশল তাহলে সম্ভবত ভুল বলা হবে না। সকলেই জানেন, হাসান মাহ্মুদ সরকারের মুখপাত্র এবং তথ্যমন্ত্রী। মাহ্বুবুল আলম হানিফ একজন জাতীয় সংসদ সদস্য এবং আওয়ামী লীগের সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব। দলীয় অবস্থানের দিক দিয়ে ওবায়দুল কাদেরের পরেই তার স্থান।

তিন
প্রগতিশীল ন্যাপের এক আলোচনা সভায় তথ্যমন্ত্রী হাসান মাহমুদ বলেন যে, ৪২ জন নাগরিকের ঐ বিবৃতির খসড়া প্রণীত হয়েছে বিএনপি অফিসে। ৪২ জন নাগরিকের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখে আমি বলতে চাই, ওরা সকলেই বিএনপিপন্থী হিসাবে পরিচিত। তাদের কেউ কেউ বিএনপি চেয়ারপার্সনের অ্যাডভাইজার (উপদেষ্টা)। তিনি বলেন, এখানে ব্যতিক্রম হলো এই যে, এইসব ব্যক্তি একসাথে জড়ো হয়েছেন। আসল ব্যাপারটি হলো, বিবৃতিটির খসড়া বিএনপি অফিসে প্রণীত হয়েছে। তাই তারা বিএনপির কণ্ঠের প্রতিধ্বনি করেছেন। যে ভাষায় বিবৃতিটি তৈরি করা হয়েছে এবং জনগণের দৃষ্টিকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, সেটি বুদ্ধিজীবীদের কাছে বোধগম্য নয়।

আওয়ামী লীগের মহাসচিব এবং সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, সব ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়ে বিএনপি এখন নির্বাচন কমিশনকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টা করছে। ভোটের দিনে নির্বাচন বয়কট করে বিএনপি জনগণের রায়কেই অস্বীকার করছে। এখন নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি এবং অসদাচারণের অভিযোগ করে নির্বাচন কমিশনকেই বিতর্কিত করার অপচেষ্টা করছে। নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার বিএনপির সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। তাই জনগণের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য বিএনপি সন্ত্রাস এবং অগ্নি সংযোগের পথ বেছে নিয়েছে।

অভিযোগসমূহ সঠিক, না বেঠিক আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা এবং মন্ত্রীরা সেদিকে যাননি। তাদের কথা, এরা সব বিএনপির লোক। এরা সকলেই বিএনপির লোক কিনা তারা নিজেরাই সেটা ভালো বলতে পারবেন। তবে এরা এতটা বিখ্যাত লোক যে, এদেশের রাজনীতি সচেতন মানুষ এবং সাংবাদিকরা ঠিকই সেটা জানেন। ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সুলতানা কামাল, রাশেদা কে চৌধুরী, খুশী কবির, অ্যাডভোকেট শাহ্দীন মালিক, স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন, শিক্ষাবিদ সিআর আবরার, পরিবেশবিদ সৈয়দা রিজওয়ানা হোসেন, ব্যারিস্টার সারা হোসেন, অধ্যাপক স্বপন আদনান, শারমিন মুরশীদ, গীতি আরা নাসরিন, সাংবাদিক আবু সাইদ, গোলাম মোর্তজা, অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস প্রমুখের সাথে বিএনপির সংশ্রব নাই। ড. আকবর আলী খান এবং সুলতানা কামাল ড. ইয়াজউদ্দিনের উপদেষ্টা পরিষদে সদস্য ছিলেন। তারা উপদেষ্টা পরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন। তাতে ষোল আনা লাভ হয়েছিল আওয়ামী লীগের। এদেরকেও বিএনপি বানিয়ে ছাড়লেন আওয়ামী লীগের ঐসব সিনিয়র নেতা। ঐ ৪২ জনের প্রত্যেকের রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড বা পরিচিতি, যদি কিছু থাকে, তাহলে সেটা সচেতন জনগণ জানেন।

চার
আসল কথা হলো সেই প্রবাদ। এরাব ঃযব ফড়ম ধ নধফ হধসব ধহফ যধহম রঃ. কাউকে যদি মারতে চাও তাহলে তার নামে বদনাম ছড়াও এবং তাকে মেরে ফেলো। আওয়ামী লীগের এই বদনাম বা ইলজামের পর ঐ ৪২ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি কী বলেন বা কী করেন তাই এখন দেখার বিষয়। ওরা অভিযোগ করলেন আর নূরুল হুদা গং সেটি সরাসরি নাকচ করে দিলেন। তাহলে এখানেই কি ব্যাপারটা শেষ হয়ে গেল? নাকি এভাবে কোনো ব্যাপার শেষ হয়? তাহলে আর অভিযোগ পাল্টা অভিযোগের মূল্য থাকলো কোথায়?

৪২ জন বিশিষ্ট নাগরিকের বিবৃতি সম্পর্কেও আরো অনেক কিছু বলার ছিল। আগামী সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষা করা যাক। দেখা যাক, কোথাকার পানি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়। একটি বিষয় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। সেটি হলো, বর্তমান সিইসির মেয়াদ শেষ হবে ২০২২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। সুতরাং পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন অর্থাৎ ২০২৩ সালের নির্বাচন তার বা তার কমিশনের অধীনে হচ্ছে না। এদের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। তাই ৪২ জনের বিবৃতি ইস্যুটি শেষ হয়ে গেছে বলে মনে হয় না।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন