পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ভরা মৌসুমেও চালের দাম নিয়ে সমানে চালবাজি চলছে। চালের দাম প্রায় প্রতিদিন বৃদ্ধি পেলেও তা নিয়ন্ত্রণে কোনো পদক্ষেপ নেই। সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে অন্তত ৫ থেকে ১০ টাকা বেড়েছে। চালের দাম কেন বাড়ছে, এর কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা নেই। এ নিয়ে খুচরা ব্যবসায়ী ও মিলারদের মধ্যে চলছে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ। এর মাঝে চিড়েচ্যাপ্টা হচ্ছে নিন্ম আয়ের মানুষ। তাদের আয়-ব্যয়ের হিসাব মিলছে না। আড়তদার, মিল মালিক কিংবা খুচরো বিক্রেতা- সবাই একবাক্যে বলছেন এ সময়ে এভাবে চালের দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। তাহলে, চালের দাম বাড়ছে কেন? গত বছর নভেম্বরেও ভরা মৌসুমে চালের দাম হুট করে বেড়ে গিয়েছিলো। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরেও চালের দাম বৃদ্ধি নিয়ে এমন চালবাজি হয়েছিল। দাম বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে তুমুল শোরগোল শুরু হলে তখনকার বাণিজ্যমন্ত্রী দুজন চালকল নেতার বিরুদ্ধে মজুতদারির অভিযোগ এনে তাদের গ্রেফতারের হুমকি দিয়ে পরিস্থিতি আরো জটিল করে দিয়েছিলেন। চাল বর্তমান সরকারের জন্য একটি ¯পর্শকাতর বিষয়। নির্বাচনের আগে ১০ টাকা কেজিতে চাল খাওয়ানো নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা এখনো তামাদি হয়ে যায়নি। আবার সরকারি তথ্য-উপাত্তে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন বিশেষ করে রেকর্ড ধান উৎপাদনে গর্ব করার বিষয় রয়েছে। এ বছরের শুরুতেই বাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির মুখ থেকে উচ্চারিত হয়েছিল কঠিন কথা। তিনি বলেছিলেন, আগুনের মধ্যে বাস করছেন তিনি। কথাটি তিনি পেঁয়াজের দামের জেরে বলে থাকলেও বাজারের আরো বেশ কিছু পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটও তাতে ছিল। মাসখানেক ধরে দেশী নতুন পেঁয়াজ বাজারে এলেও দাম কমেনি। পেঁয়াজ এবং আলুর দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে থাকা অবস্থায়ই ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে চালের দাম বেড়ে চলেছে। পরপর তিনটি মৌসুমে ধানের বা¤পার ফলন হলেও দাম কমেনি। বিদেশ থেকে চাল আমদানি প্রায় বন্ধ। গত পাঁচ বছরের মধ্যে সরকারি গুদামে সবচেয়ে বেশি চালের মজুত রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে। তারপরও কেন চালের দাম কমছে না? এর যথাযথ কারণ ও যুক্তি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আছে নানা অজুহাত। অভিযোগ রয়েছে, চালসহ অন্যান্য নিত্যপণ্যের দাম মনিটরিংয়ে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে সমন্বয়হীনতার অভাব ও ফাঁকজোক রয়েছে। একেক সংস্থা একেক তথ্য দিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। বলা হয়ে থাকে, পণ্যের সরবরাহ কমলে দাম বাড়ে। আর সরবরাহ বাড়লে দাম কমে। কিন্তু এ কথা এখন কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এর বাস্তাবায় নেই। বর্তমানে বাজারে যেসব পণ্যের দাম বেড়েছে, কোনোটিরই সরবরাহে কোনো ঘাটতি নেই। বেশ কয়েকটি ফসল উৎপাদনে রেকর্ড রয়েছে। সরবরাহে ঘাটতি নেই। ন্যায্য দাম না পেয়ে কৃষকরা দুর্দশায় রয়েছে। অথচ এসব পণ্যের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে রয়েছে। এর কোনো যথোপযুক্ত জবাব নেই। সিন্ডিকেট চক্র দাম খেয়াল-খুশি মতো দাম হাঁকিয়ে চলেছে। সরকারের তরফ থেকে দাম নিয়ন্ত্রণের কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। সিন্ডিকেটের ইশারায় পণ্যমূল্য নির্ধারিত হচ্ছে। বাজারে এক অরাজক পরিস্থিতি চলছে। বলা বাহুল্য, দেশে কোনো পণ্যের দাম একবার বাড়লে তা আর কমে না। ঈদ, বন্যা, খরা, ঝড়-বৃষ্টি, শীত গরম, কুয়াশা-দাবদাহের অজুহাত দাম বাড়ানোর প্রবণতা পুরনো। এখন আর এসব অজুহাতের প্রয়োজন পড়ে না। দাম হাঁকিয়ে দিলেই হলো। সবকিছুই চলছে সিন্ডিকেটের মর্জিমতো। মাসখানেক আগেও শাক-সবজির দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে ছিল। এখন সরবরাহ বাড়ায় দাম কিছুটা কমেছে। এই দাম কমার পেছনেও সিন্ডিকেটের হাত রয়েছে। দাম বাড়–ক-কমুক চাষীরা যাতে সরাসরি খুচরা বিক্রেতাদের কাছে সবজি বিক্রি করতে না পারে- এ ক্ষেত্রেও সিন্ডিকেট জড়িয়ে রয়েছে। তাদের চেইন গ্রামের ক্ষেত-খামার থেকে শুরু করে রাজধানী পর্যন্ত সকল মোকামে-আড়তে বিস্তৃত। এরা অধরাই থেকে যায়। ধরা যা খাওয়ার খায় কৃষক আর সাধারণ ক্রেতারা। উৎপাদিত সবজির দাম বৃদ্ধি বা কমার ক্ষেত্রে কৃষকের কোনো লাভ নেই। দাম বাড়লে যেমন তারা সে দাম পায় না, তেমনি কমলে তাদের মাথায় হাত পড়ে। এর শিকার সাধারণ ক্রেতারাও হচ্ছে। দাম কম-বেশি যাই হোক, পকেট থেকে তাদের টাকা বের হয়ে যাচ্ছে। আবার সরকারও উভয় সংকটে। দাম বাড়লে ক্রেতারা গালমন্দ যা করার সরকারকেই করে। মাঝে ফড়িয়ারা বাদ পড়ে যায়। কারণ, তারা তাদের চেনে না। সব দোষ গিয়ে পড়ে সরকারের উপর। মাঝখানে ফায়দা লুটে মধ্যস্বত্বভোগীরা। এদের দৌরাত্ম ঠেকানো যাচ্ছে না। সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও তা কার্যকর হচ্ছে না। সরকার যেন সিন্ডিকেটের কাছে অনেকটা জিম্মি হয়ে আছে। এবার ভয়াবহ বন্যা সত্তে¡ও কৃষক পরিশ্রম করে শীতের সবজির ব্যাপক আবাদ করেছে। অথচ সিন্ডিকেটের কারসাজিতে তারা উৎপাদনমূল্যও পাচ্ছে না। উদাহরণ স্বরূপ, উত্তরবঙ্গে যে মুলার দাম কেজি প্রতি দুই টাকা, রাজধানীতে তা বিশ টাকা। মুলার মতো অন্যান্য শাক-সবজির দামও রাজধানীর তুলনায় কয়েক গুণ কম। এর কারণ, প্রচুর ফলনের কারণে সরবরাহ বেশি থাকায় কৃষকদের কম দামে সবজি বিক্রি করতে বাধ্য করছে সিন্ডিকেট চক্র। এতে লোকসানে পড়ছে কৃষক। এর আগে, কয়েক মাস যে দাম চড়া ছিল তার সুবিধা তারা পায়নি। বড় অংকের লাভটা হাতিয়ে নিচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। খুচরায় সুবিধা করতে না পেরে কৃষকরা স্থানীয় আড়তদার বা দালালদের কাছে সবজি বিক্রি করে। আড়তদারদের হাতে নিয়ন্ত্রণ তেমন নেই। তারা কেবল পায় কমিশন। নিজের কমিশন বুঝে রেখে সবজি পাঠায় রাজধানীসহ বিভিন্ন মোকামের ছোট আড়তদারদের কাছে। তখন পরিবহন খরচসহ প্রতি কেজিতে ৭ থেকে ১০ টাকা বাড়তি খরচ হয়। এই আড়তদারদের কাছ থেকে আবার সবজি নেয় ফড়িয়ারা। তাদের কাছ থেকে যায় পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে। এরপরও কখনো কখনো দুই-তিন হাত ঘুরে। ফড়িয়া ও খুচরা ব্যবসায়ীর হাত ঘুরে মানুষের কাছে পৌঁছতে দাম বাড়ে দফায়-দফায়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে করোনার ঝুঁকি এড়াতে সবাইকে পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয় । প্রশ্ন হচ্ছে, নি¤œবিত্তরা পুষ্টিকর খাদ্য পাচ্ছে কি? সরকারিভাবে পুষ্টি জোগানের কোনো উদ্যোগ কি নেয়া হয়েছে? বাস্তবতা হচ্ছে, নি¤œ আয়ের মানুষ উপার্জনহীন হয়ে পড়ায় পুষ্টিকর খাবার খাওয়া দূরে থাক, স্বাভাবিক খাদ্য জোগাড় কারাই তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে। ভিটামিন এ, ডি, ই, কে এবং সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালশিয়াম ইত্যাদি খনিজ তাদের পেটে যায় না। অর্থাৎ জীবন বাঁচলেও অপুষ্টিতেই থাকছে তারা। অপুষ্টিজনিত কারণে একদিকে যেমন অ্যান্টিবডি তৈরি না হওয়ায় রোগাক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা বাড়ছে, অন্যদিকে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। অভিজ্ঞ চিকিৎসক ও পুষ্টিবিদরা বলছেন, করোনায় মৃত্যুহার কমানোর প্রধান উপায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো। সেটার জন্য খাদ্য তালিকায় ফলফলাদি বেশি যুক্ত করতে হবে। কমলালেবু, পেঁপে, আঙ্গুর, আনার, তরমুজ, বেরি, জলপাই, আনারস এবং লাল পাতা কপি, বিট, ব্রোকলি, গাজর, টমেটো, মিষ্টি আলু ও ক্যাপসিকামসহ উজ্জ্বল রঙের সবজি, ডিম, সবুজ শাক, মুরগির মাংস, কলিজা, দুধ জাতীয় খাবার, কাঠবাদাম, চিনাবাদাম, পেস্তা বাদাম, বাদাম তেল, ভেজিটেবল অয়েল, জলপাইয়ের আচার, আমলকী, লেবুসহ বিটা ক্যারোটিন, ভিটামিন এ, ই, সি সমৃদ্ধ খাবার রাখার কথা বলছেন স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা। যেখানে চাল, আলু, ডাল জোগাড়ের অবস্থা নেই, সেখানে সাধারণ মানুষের কাছে এই ম্যানু অনেকটা পরিহাসের মতো।
করোনার কারনে আতঙ্কিত হয়ে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পণ্য না কেনার আহŸান জানিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তি কোনো কাজে আসেনি। বরং বিত্তবানরা বেশি পণ্য কিনে মজুত করায় সিন্ডিকেট চক্র পণ্যমূল্য আরও বাড়িয়ে দেয়। এ প্রবণতা এখনো রয়েছে। কোনোভাবেই বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। মানুষের বেঁচে থাকার সবধরনের ভোগ্যপণ্যের মূল্য হু হু করে বাড়ছে। অনেক মানুষের পক্ষে এখন আলু ভর্তা ও ডাল দিয়েও ভাত খাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। খেলেও আধা পেট খেয়ে বা একবেলা কম খেয়ে ঘুমাতে যায়। সামনে তাদের এক অনিশ্চিত জীবন। এ অবস্থায় নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে এবং নাগালের মধ্যে না রাখতে পারলে সাধারণ মানুষের দুর্দশার অন্ত থাকবে না। বাজার নিয়ন্ত্রণে এখনই সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সাড়াশি অভিযান চালাতে হবে। সিন্ডিকেটের কাছে দেশের মানুষ জিম্মি হয়ে থাকবে, এটা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। চাল, ডাল, তেল, আলু, পেঁয়াজসহ সব ধরনের পণ্যমূল্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারকে নিয়মিত বাজার মনিটরিং করতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।