Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

স্বাধীন বাংলাদেশের ঐতিহাসিক পটভূমি

মোহাম্মদ আবদুল গফুর | প্রকাশের সময় : ২২ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:০১ এএম

এখন চলছে ডিসেম্বর মাস। ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয়ের মাস। এই ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে, ১৬ ডিসেম্বর তারিখে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বিজয় লাভের মধ্যদিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়। সেই থেকে এই দিনটি বিজয় দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

এই বিজয় দিবস হঠাৎ করে বা রাতারাতি আসেনি। এর একটা সুদীর্ঘ ইতিহাস আছে। আছে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পর্ব ও স্তর। সে সময়ের তাৎপর্য ও সাফল্য সঠিকভাবে জানতে ও উপলব্ধি করতে না পারলে মহান বিজয় দিবসের তাৎপর্য ও গুরুত্ব সঠিকভাবে উপলব্ধি করা কিছুতেই সম্ভব হবে না।

একারণে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিভিন্ন স্তরের ইতিহাস যেমন আমাদের জানতে হবে, তেমনি জানতে হবে সাফল্য ও ব্যর্থতার কথা।

সুদীর্ঘ এ সংগ্রামের সাফল্য-ব্যর্থতাসহ সকল বিষয় জানার আগে আমাদের জানতে হবে, আমরা স্বাধীনতা হারাই কবে এবং কোন্ পটভূমিতে। একথা সকল ঐতিহাসিক স্বীকার করে নিয়েছেন যে, আমরা প্রথম স্বাধীনতা হারাই ১৯৫৭ সালে, পলাশী যুদ্ধে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলাহর পরাজয় বরণের মাধ্যমে।
পলাশী যুদ্ধে নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলাহ পরাজয় বরণ করেন সাত সমুদ্র তের নদীর ওপার থেকে আসা ইংরেজদের কাছে। ইংরেজরা এদেশে আসে বাণিজ্য করার জন্য। এসে তারা প্রথম প্রথম নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলাহর দরবারের অমুসলিম সদস্যদের সাথে গোপনে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করে। মুসলিম নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলাহকে সিংহাসন থেকে সরিয়ে সেখানে অমুসলিম আমলাদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় তারা। এলক্ষ্যে সফল হওয়ার জন্য তারা নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলাহর প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খানকে নবাব বানানোর ওয়াদা দিয়ে তাকে হাত করে।

ইতোমধ্যে ইংরেজরা কলিকাতা শহরে গোপনে বাণিজ্যের নামে এসে সৈন্য জড়ো করতে থাকে। নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলাহ এ খবর জানতে পেরে কলিকাতায় অভিযান চালিয়ে ইংরেজদের পরাজয় বরণে বাধ্য করেন এবং বাণিজ্যের বাইরে কোনো রাজনৈতিক শক্তি অর্জনের চেষ্টা করবে না বলে তাদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করেন। ওদিকে নবাব দরবারের অমুসলিম সদস্যদের সাথে ইংরেজদের গোপন যোগাযোগ চলতে থাকে। এসব অমুসলিম সদস্যের মধ্যে ছিলেন উর্মিচাঁদ, রাজবল্লভ, রায়দুর্লভ প্রমুখ। আর ছিলেন নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলাহর প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খাঁ, ইয়ার লতিফ প্রমুখ নবাব দরবারের বিশ্বাসঘাতক মুসলিম সদস্যরা।

এই পটভূমিতে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীতে যে যুদ্ধ শুরু হয়, তাতে সকলকে অবাক করে দিয়ে নবাব বাহিনীর প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খাঁ যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করেন। নবাব সিরাজ-উ-দৌলাহ এতে অবাক হয়ে মীর জাফরের কাছে এর কারণ জানতে চাইলে মীর জাফর জবাব দেন, আমি যুদ্ধ বিরতির ঘোষণা দিয়েছি। এর কেউ বিরোধিতা করলে পরিণতির জন্য আমাকে দায়ী করা যাবে না।

অগত্যা নবাব বাহিনীর সদস্যরা তাকে বিশ্বাস করে যার যার তাঁবুতে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর নবাব সৈন্যরা যখন বিশ্রামরত তখন পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক তাদের উপর আক্রমণ চালানো হয়। অপ্রস্তুত নবাব সৈন্যরা এ অবস্থায় নিজেদের জীবন বাঁচাতে বিশৃংখলভাবে যুুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলাহও এই অবস্থায় যুদ্ধ ক্ষেত্র ত্যাগ করে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। তিনি এই আশা নিয়ে পালিয়ে যান যে, গোপনভাবে নতুন করে সৈন্য সংগ্রহ করে তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফের যুদ্ধে অবতীর্ণ হবেন। কিন্তু তার এই আশা সফল হয়নি। পলায়নরত অবস্থায় তিনি ইংরেজদের গুপ্তচরের হাতে ধরা পড়ে ৩ জুলাই করুণভাবে নিহত হন।

এদিকে নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলার প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খাঁকে সিরাজ-উ-দৌলাহর সিংহাসনে বসানো হয়। কিন্তু সিংহাসনে বসেই তিনি টের পান তাঁকে নবাব করা হলেও মূল শক্তির মালিক হয়ে গেছে ইংরেজ এবং তাদের এদেশি হিন্দু সমর্থকরা। পরে তিনি সিংহাসনচ্যুত হন। তার স্থলে নবাব হন মীর জাফর আলী খাঁর জামাতা মীর কাশেম। মীর কাশেম ছিলেন অন্য ধাতুর মানুষ। তিনি ইংরেজদের শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধ চালাতে গিয়ে ব্যর্থ হন এবং রহস্যজনকভাবে মৃত্যুবরণ করেন।

এভাবেই বাংলার শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় ইংরেজরা। তবে প্রথম দিকে ইংরেজরাও প্রচুর বাধার সম্মুখীন হয়। এসব বাধার মধ্যে রয়েছে মজনু শাহর নেতৃত্বে ফকির বিদ্রোহ, বিভিন্ন কৃষক বিদ্রোহসহ সর্বশেষে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ। তখন শুধু বাংলাতেই নয়, সমগ্র ভারতবর্ষেই ছড়িয়ে পড়ে এইসব বিদ্রোহ। কিন্তু ইংরেজ শাসন তখন সমগ্র ভারতবর্ষেই সুপ্রতিষ্ঠিত। এই কঠিন বাস্তবতা উপল স্বাধীন বাংলাদেশের ঐতিহাসিক পটভূমি করে উত্তর ভারতে স্যার সৈয়দ আহমদ খান এবং বাংলার নবাব আবদুল লতিফ প্রমুখ ইংরেজদের বিরোধিতার পথ পরিহার করে তাদের সাথে মিত্রতার পথ গ্রহণ করে যতটা সম্ভব দেশের জনগণের উন্নতি বিধানের পথ গ্রহণ করেন।

তারা এই পথ গ্রহণ করায় শাসক ইংরেজদের মনে এই ধারণা সৃষ্টি হয় যে, মুসলমানরা আর ইংরেজদের বিরোধিতা করবে না। এই পটভূমিতে একশ্রেণির খৃস্টান ধর্ম প্রচারক ইসলামের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও খ্রিস্ট ধর্মের প্রচারের কাজ শুরু করে। তখন দেশে আলেম-ওলামার অভাব ছিল না। তবুও এসব অপপ্রচারের বিরুদ্ধে তারা কিছু না বলে নীরবতা পালন করেন। এই পটভূমিতে খ্রিস্ট ধর্মের এই প্রচারণার বিরুদ্ধে এগিয়ে আসেন যে মহাপুরুষ তাঁর নাম মুন্সী মেহেরুল্লাহ। পেশায় তিনি ছিলেন একজন দর্জি। এই গ্রাম্য দর্জিই পাদ্রীদের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ দিয়ে প্রকাশ্য বাহাসে অবতীর্ণ হন। প্রথম প্রথম ইংরেজরা এই গ্রাম্য দর্জির কর্মকান্ডকে গুরুত্ব দেননি। কিন্তু বড় বড় খ্রিস্টান পাদ্রী একের পর এক বাহাসে পরাজিত হবার পর আর নতুন করে বাহাসে যোগ দিতে সাহস পেতেন না।

পরবর্তীতে রাজনীতিতে নেমে পড়েন সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী এবং তাঁর উত্তরসুরী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। পরিস্থিতির অনুকূলে দেশে এসময়ে ইংরেজ বিরোধী মুসলিম রাজনীতির সূচনা করেন নবাব সলিমুল্লাহ। তিনি ১৯০৫ সালে নিখিল ভারত মুসলিম শিক্ষা সম্মেলনের বিশেষ রাজনৈতিক অধিবেশনে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন নিখিল ভারত মুসলিম লীগ নামে।

এই সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো হয় মুসলিম ভারতের উদীয়মান মুসলিম নেতা মুহম্মদ আলী জিন্নাহকেও। কিন্তু তিনি এই যুক্তিতে এই সম্মেলনে যোগ দিতে অস্বীকৃত জানান যে, এর ফলে কংগ্রেস ক্ষতিগ্রস্ত হবে । যে মুহম্মদ আলী জিন্নাহ তখন কংগ্রেসের স্বার্থে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠায় আপত্তি উত্থাপন করেন, পরবর্তীকালে কঠোর বাস্তবতা উপলব্ধি করে সেই তিনিই মুসলিম লীগে যোগ দিয়ে কংগ্রেসের স্বাধীন অখন্ড ভারতের আন্দোলনের বিরোধিতা করেন। তিনিই পরবর্তীকালে ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তের মুসলিম প্রধান অঞ্চলকে নিয়ে পাকিস্তান নামে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।

১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ মুসলিম লীগের ঐতিহাসিক সম্মেলনে উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলে যে দুটি মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব গৃহীত হয় তার উত্থাপক ছিলেন শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক। তিনি তখন ছিলেন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী। পরবর্তীতে ওই প্রস্তাব সংশোধন করে একটি মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। সে অনুযায়ী পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়। তার সেই দুই রাষ্ট্রের প্রস্তাবই বাস্তবায়িত হয় ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন, পূর্ববঙ্গের স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন থেকে শেষ পর্যায়ে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: স্বাধীন-বাংলাদেশ
আরও পড়ুন