পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
কৃষকরাই যে এদেশের প্রাণ; আর কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে- এটা আরও একবার প্রমাণিত হলো বৈশ্বিক মহামারি করোনাকালে। বিশ্বের সঙ্গে এ দেশের ব্যবসায়ী, চাকুরীজীবী, শ্রমিক, উদ্যোক্তা, ছাত্র, শিক্ষকসহ সকল শ্রেণি পেশার মানুষ যখন লকডাউনে ঘরবন্দি ছিল, ঠিক সেই সময়ও মাঠে ছিলেন বাংলার কৃষকরা। নিজের হাতে ফলিয়েছেন ফসল। আর সেই ফসলই বাঁচিয়ে রেখেছে ঘরবন্দি ১৭ কোটি মানুষের জীবন। বাঁচিয়ে রেখেছে অর্থনীতি। সরকারের কৃষিবান্ধব নীতি প্রণয়ন আর সময়োপযোগী বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিতের পদক্ষেপ গ্রহণ করায় করোনা মধ্যেও খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে রেকর্ডের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
করোনার এই দুঃসময়ে মধ্যেও দেশের কৃষির জন্য দুটি সুসংবাদ পেল বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কৃষি বিষয়ক সংস্থা ইউএসডিএ মতে, চাল উৎপাদনে কয়েক বছরের সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ইন্দোনেশিয়াকে পেছনে ফেলে বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ তিনের মধ্যে উঠে আসছে দেশ। অপরদিকে বৈশ্বিক খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য বলছে, চলতি বছর বাংলাদেশে পালনকৃত গরুর সংখ্যা ২ কোটি ৪০ লাখেরও বেশি। শুধু তা-ই নয়, গবাদিপশুটি পালনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে দ্বাদশ অবস্থানে রয়েছে। কয়েক বছর আগেও প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমার থেকে আমদানিকৃত গরু দিয়েই মিটত দেশের মাংসের চাহিদা। প্রতি বছর কোরবানির সময় দেশ দুটি থেকে আমদানি হতো ২২ থেকে ২৫ লাখ গবাদিপশু। কিন্তু সেই নির্ভরতা কমিয়ে এখন স্বয়ংসম্পূর্ণতা পথে বাংলাদেশ।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্যানুযায়ী, সবজি ও মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। পাট উৎপাদনে বিশ্বে ভারতের অবস্থান শীর্ষে এবং বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয় হলেও রপ্তানিতে বিশ্বে প্রথম। ধান ও আলু উৎপাদনে যথাক্রমে চতুর্থ ও সপ্তম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। ছাগল উৎপাদনেও বিশ্বে আয়তনের দিক থেকে অনেক পেছনে থাকা বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ, আমে সপ্তম এবং ফলে দশম। আর ছাগলের মাংস উৎপাদনে বিশ্বে পঞ্চম। সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে, বিশ্বে যে পরিমাণ ইলিশ উৎপাদন হয়, তার ৮৬ শতাংশই হয় আমাদের দেশে। লন্ডনভিত্তিক ‘ইন্টারন্যাশনাল টি কমিটি’র প্রতিবেদন অনুসারে, চা উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান একধাপ এগিয়ে গত বছর ৯ম স্থানে উন্নীত হয়েছে। চীন ও ভারত পণ্যটি উৎপাদনে বিশ্বে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে আলু, সবজি আর আম রফতানি হচ্ছে বিদেশে। এমনকি ২০১৪ সালে আমরা চাল রপ্তানি করেছি। একই জমিতে বছরে একাধিক ফসল চাষের দিক থেকেও বাংলাদেশ এখন বিশ্বের জন্য উদাহরণ। এছাড়া বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও দুর্যোগসহিষ্ণু শস্যের জাত উদ্ভাবনেও শীর্ষে বাংলাদেশের নাম। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে ধানের উৎপাদন তিন গুণেরও বেশি, গম দ্বিগুণ, সবজি পাঁচ গুণ এবং ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে দশ গুণ।
জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো কৃষি উৎপাদন বাড়িয়ে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করায় বাংলাদেশের সাফল্যকে বিশ্বের জন্য উদাহরণ হিসেবে প্রচার করছে। সরকারের ডিমওয়ালা ইলিশ সংরক্ষণ এবং জাটকা নিধন নিষিদ্ধকরণের নীতিমালা বাস্তবায়নের ফলে এখন ইলিশের উৎপাদন বহুল পরিমাণে বেড়েছে। চিংড়ি রফতানি থেকে প্রতি বছর আমাদের আয় ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া পুষ্টির অন্যান্য উৎপাদন ডিম, দুধ ও মাংসের উৎপাদনও বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাতে বৃদ্ধি পেয়েছে এসব পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্যের জনপ্রতি প্রাপ্যতা।
একবার ভেবে দেখুন, প্রতি বছরই কিন্তু লোকসংখ্যা বাড়ছে। সে তুলনায় কৃষি জমি কি বাড়ছে? উত্তর না। বরং প্রতি বছরই কৃষিজমি ১ শতাংশ হারে কমছে। তাছাড়া কৃষিজমিতে প্রতিদিনই কলকারখানা, নতুন রাস্তা, স্থাপনা, তৈরি হচ্ছে। এছাড়া রয়েছে ঝড়, জলোচ্ছ¡াস, বন্যা সাথে জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কায়। এসব সামলাতে কৃষি কাহিল হওয়ার কথা। কিন্তু না, ক্ষণিক থেমে গেলেও মুহূর্তে আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে কর্মবীর কৃষক কৃষিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আনছে বিস্ময়কর সাফল্য ও অভাবনীয় উন্নতি। দুই যুগ আগেও দেশের অর্ধেক এলাকায় একটি ও বাকি এলাকায় দুটি ফসল হতো। বর্তমানে দেশে বছরে গড়ে দুটি ফসল হচ্ছে।
দেশ স্বাধীনের বছরে ধান, আলু ও গম মিলিয়ে মোট ১ কোটি ১৮ লাখ টন খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়। সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য যা পর্যাপ্ত ছিল না। স্বাধীনতার পর মানুষের মুখে দু’বেলা অন্ন তুলে দেওয়াই ছিল নতুন সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ। চাহিদা মেটাতে তখন বিদেশি সহায়তা ও আমদানির ওপর নির্ভর করতে হতো। তবে বর্তমানে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ১৭ কোটি হলেও দেশে উদ্বৃত্ত খাদ্যের মজুদ রয়েছে। যদিও এ সময়ে আবাদি জমির পরিমাণ প্রায় ৩০ শতাংশ কমেছে। আমন, আউশ ও বোরো মৌসুমে ধানের বাম্পার ফলনে বছরে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টন উৎপাদনের রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। বিশ্বে গড় উৎপাদনশীলতা প্রায় তিন টন। আর বাংলাদেশে তা ৪ দশমিক ১৫ টন।
গমের উৎপাদন, শাকসবজির উৎপাদনেও সক্ষমতা বেড়েছে। মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান উন্নত হয়েছে, পশুপালন ও হাসমুরগির খামারেও অগ্রগতি এসেছে। ছাদ-কৃষিতেও ব্যাপক সাফল্য, আগ্রহ ও জনপ্রিয়তা আশাব্যঞ্জক। আমাদের মহিলারও বসে নেই। তারা বাড়ির আঙিনায় সবজি আবাদ, কুটির শিল্পে জড়িত হয়ে সাবলম্বী হচ্ছে। আসলে কৃষিসমৃদ্ধ আবহাওয়া আর জলবায়ুর এত সুন্দর দেশ বিশ্বে খুবই কমই আছে। এ আবহওয়া আর জলবায়ুকে কাছে লাগিয়ে গ্রামে ও মাঠের কর্মবীররা বিপ্লব ঘটাচ্ছে। এখন কৃষি বিজয় নীরবে নয়, ঘটছে সরবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে- এটা কীভাবে সম্ভব হয়েছে? উত্তর খুবই সহজ হলেও বাস্তবায়ন কিন্তু খুবই কঠিন। এর পিছনে রয়েছে সরকারের যুগোপযোগী পরিকল্পনা, পরিশ্রমী কৃষক এবং মেধাবী কৃষিবিজ্ঞানী ও সম্প্রসারণবিদদের যৌথ প্রয়াসেই এ সাফল্য। এছাড়া রয়েছে কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তি, বীজ, সার এবং আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার। তার সঙ্গে বিশেষ অবদান রয়েছে আমাদের কৃষিবিজ্ঞানীদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর নিবিষ্ট গবেষণায় উচ্চফলনশীল, কম সময়ে ঘরে তোলা যায় এমন জাত ও পরিবেশসহিষ্ণু নতুন জাত উদ্ভাবন। এছাড়া সময়ের বিবর্তনে এসেছে নতুন নতুন ফসল, প্রসারিত হচ্ছে নব নব প্রযুক্তি। আর এভাবেই প্রধান খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশের তালিকায় উঠে এসেছে বাংলাদেশ। শুধু মাঠে নয়, নানামুখী ইতিবাচক পদক্ষেপের কারণে কৃষির আরেকটি উপ-খাত মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতেও ব্যাপক সাফল্য অর্জিত হয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে কৃষকের নিরলস পরিশ্রমের যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন প্রযুক্তি। সাফল্য আসছে ধারাবাহিক গতিতে।
পরিশেষে বলতে চাই, বাংলাদেশে কৃষির প্রচুর সম্ভাবনা রয়ে গেছে। সেসব সম্ভাবনা ব্যবহার করা প্রয়োজন। কৃষিকে আধুনিকায়ন করতে হবে। একরপ্রতি উৎপাদন আরও বাড়াতে হবে। ব্যবহার করতে হবে উন্নত প্রযুক্তি। শুধু কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নিলেই চলবে না, কৃষিপণ্যের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করতে হবে। কৃষককে ভর্তুকিসহ উন্নত সার ও বীজের নিশ্চয়তা দিতে হবে। এজন্য প্রয়োজন দেশে কৃষিভিত্তিক শিল্পের ওপর জোর দেয়া।
লেখক: উপ-পরিচালক, জনসংযোগ ও প্রকাশনা দফতর, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।